আজকের অভিধানের গল্প বাংলা বছরকে নিয়ে। বছরকে বত্সর বললে ভালো হতো। কী করব বলো, মুখের কথায় বছর শব্দটাই এসে যায়। বত্সর তো একটু ভারী শব্দ। বর্ষ বললেও চলত। পয়লা বৈশাখ এলে তো আমরা বলি শুভ নববর্ষ। বাংলা সাল বা সন বলাটাও অবশ্য দোষের ছিল না। অব্দ বললেও মন্দ হতো না, তবে তা ঠিক মানানসই নয়। বাংলার যে প্রাচীন এক নাম—বঙ্গ, অব্দ শব্দটা তার সঙ্গে মেলে ভালো। বঙ্গ শব্দের সঙ্গে অব্দ মিলে হয় বঙ্গাব্দ। এ শব্দটা বেশ ভারী। এক খ্রিষ্টাব্দ, সহস্রাব্দ ও শতাব্দ ছাড়া অন্য কোথাও চলেও না। সবশেষে একেবারে অচল একটি শব্দের কথা বলি। শব্দটি হলো—হায়ন। হায়ন মানেও বত্সর।
বত্সর দিয়েই গল্প শুরু করা যাক। বত্সর শব্দের মূল অর্থ, যার মধ্যে ঋতুসকল বাস করে। বত্সরে ছয় ঋতু। এক ঋতুর মেয়াদ দুই মাস। ছয় ঋতু অর্থাৎ ছয় দুগুনে বারো মাসে এক বত্সর। সংস্কৃত বত্সর শব্দে তদ্ভব রূপটাই হলো বছর।
বর্ষ শব্দটা বড় বিচিত্র। বর্ষ শব্দের মূল অর্থ বর্ষণ, বৃষ্টি। বর্ষণধারা বা বৃষ্টি কী করে বত্সর হলো, তা জানার মতো জ্ঞানবুদ্ধি আমার নেই। আমি শুধু বলতে পারি অভিধানের কথা।
বঙ্গীয় শব্দকোষ—যেটি হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের বিশ বছর ধরে লেখা বিখ্যাত অভিধান, সেখানে বর্ষ শব্দের অর্থ বত্সর নয়। যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধির বাঙ্গালা শব্দকোষেও তাই ।
তবে দুই অভিধানেই রয়েছে বরষ শব্দের অর্থ বত্সর। আর বরষ শব্দটা আবার এসেছে বর্ষ থেকেই। আদি-মধ্যযুগের কবিদের বত্সর অর্থে বরষ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। উনিশ শতকে দু–একটা গানেও বরষকে বত্সর হিসেবে পাওয়া যায়।
সংস্কৃত শব্দ বর্ষ তদ্ভব বরষ রূপ ধারণ করে বত্সর হলো। তারপর কী যে ঘটল, বর্ষ পুনরায় ফিরে এল বাংলা ভাষায়, তবে বৃষ্টি ঝরিয়ে নয়, বত্সর হয়ে।
যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যাবিধি জানিয়েছেন, কোনো এক কালে বর্ষা দেখে বত্সর গণনা হতো। সেখান থেকে বর্ষ অর্থে বৎসর বোঝায়।
সন ও সাল দুটিই বৈভাষিক বা বাংলায় বিদেশি ভাষার শব্দ। এককালে বাংলাদেশে লেখা হতো সন ১৩২৯ সাল। সন শব্দটি আরবি। সাল ফারসি থেকে আগত।
অব্দ শব্দটিও বেশ রহস্যময়। সংস্কৃত ভাষায় শব্দটি—অব্দ, অকারান্ত অব্দ নয়। সংস্কৃত ভাষায় অব্দ শব্দের অর্থ মেঘ, জলদ। অব্দের বেলাতেও বর্ষণের আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
এবার আসি হায়ন শব্দের বেলায়। হায়ন সংস্কৃত শব্দ। হায়ন-এর অর্থ বত্সর। হায়নের অন্য একটি অর্থ হলো ধান। আমাদের বারো মাসের একটি মাসের নাম অগ্রহায়ণ। বাংলায় আঘন। খনার বচনে আছে, যদি বর্ষে আগনে, রাজা যায় মাগনে—অর্থাৎ ভিক্ষা করতে।
বত্সরের গল্প বলা শেষ। এবার আসি বারোমাসিতে। অর্থাৎ বারো মাসের নামের গল্পের ইতিহাসে।
মাসের নামে গল্পে জড়িয়ে আছে জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, পুরাণ কাহিনি, আকাশে নানা নক্ষত্র, আমাদের সূর্য এবং চাঁদ ও পৃথিবীর ঘোরাঘুরি। মাথা ঘুলিয়ে যাওয়ার অবস্থা। তার বিবরণ পাওয়া যাবে বাংলা সনের ইতিহাসে। আমাদের গল্প নাম নিয়েই থাক।
বছরের নামের ইতিহাসের মতো মাসের ইতিহাসও বেশ জটিল। বারো মাসে এক বছর হলেও মাস নামের অর্থ একটাই। মাস মানে চাঁদ। বিস্তৃত অর্থ হলো, কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষসহ সময়কাল। অর্থাৎ সেই চাঁদ। এ দুটি পক্ষ—যা হয় পনেরো দিনে এবং তা রয়েছে চাঁদেই। মজার ব্যাপার, ইংরেজি মান্থ শব্দের মূল অর্থও চাঁদ।
বর্তমান পৃথিবীতে দুই ধরনের সন বা সাল প্রচলিত রয়েছে। এক হলো সৌর সন, আরেকটি চান্দ্র সন। খ্রিষ্টীয় সন, বাংলাদেশে অনেকেই যাকে বলেন ইংরেজি সন, সেটি সৌরসন। বাংলাদেশে প্রচলিত বাংলা সনও সৌরসন। অন্যদিকে হিজরি হলো চান্দ্রসন এবং পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত বাংলা সনের দেহ সৌরসনের কিন্তু অন্তরটার চান্দ্রসনের।
এক অমাবস্যা বা পূর্ণিমা থেকে পুনরায় পরের অমাবস্যা বা পূর্ণিমায় চাঁদের যে ফিরে আসা, সে সময়টাকে বলা হয় চান্দ্রমাস।
শুক্লপক্ষ ও কৃষ্ণপক্ষের কথা আগেই বলা হয়েছে। পনেরো-পনেরো করে দুটি পক্ষের যে ত্রিশ দিন—সেই দিনগুলোকে বলে তিথি। এই তিথির মধ্যেই রয়েছে অমাবস্যা ও পূর্ণিমা। প্রতিটি পক্ষের কাল গণনা শুরু হয় প্রতিপদ দিয়ে। এরপর দ্বিতীয়, তৃতীয়া ইত্যাদি পেরিয়ে শেষ হয় চতুর্দশীতে গিয়ে। অমাবস্যার প্রতিপদে উদয় হয় একফালি সরু চাঁদের। সেই নতুন চাঁদ দেখে হিজরি চান্দ্রমাসের শুরু।
হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে তিথির গুরুত্ব অপরিসীম। তিথির আবার বেশ কয়েকটি ভাগ। প্রতিটি ভাগই গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিয়ে, যাত্রা-অযাত্রা, গৃহপ্রবেশ, শুভ-অশুভ দিন ইত্যাদি সবই তিথিনির্ভর। আর এ কারণেই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের পক্ষে বাংলা সনে চাঁদের হিসাব পরিত্যাগ করা সম্ভব হয়নি।
বাংলা সনের মাসের নামের সঙ্গে জ্যোতিষশাস্ত্র ও হিন্দু পুরাণের কাহিনি জড়িয়ে রয়েছে। সেটা পরে বলছি।
পৃথিবীর চারপাশে ঘুরতে গিয়ে চাঁদ সাতাশ দিনে বারো রাশি ও তার মধ্যকার সাতাশটি নক্ষত্র অতিক্রম করে। পত্রিকার পাতায় তোমরা যে রাশিফল দেখ, এই রাশি হলো সেই রাশি। তাই রাশির নাম আর বলতে চাচ্ছি না। তবে নক্ষত্রগুলো নিয়ে কথা বলতে হবে।
যে মাসে চাঁদ রাশিচক্রের বিশাখা নামের নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখায়। একইভাবে জ্যৈষ্ঠ মাসে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় জেষ্ঠা নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে।
এই নক্ষত্র প্রসঙ্গে হিন্দু পুরাণের দক্ষ প্রজাপতির নাম জড়িত। দক্ষ প্রজাপতি দেবতা ব্রহ্মার পুত্র। তাঁর স্ত্রীর নাম প্রসূতি। এঁদের অনেকগুলো কন্যা। তার মধ্যে ২৭ জন কন্যার সঙ্গে চন্দ্রদেব অর্থাৎ চাঁদের এবং কনিষ্ঠা কন্যা সতী বা দুর্গার সঙ্গে শিবের বিয়ে হয়।
দক্ষের সাতাশ কন্যাই হলো সাতাশটি নক্ষত্র। সাতাশ কন্যার অর্থাৎ নক্ষত্রের সংসার সামলাতে গিয়ে চাঁদকে প্রতি মাসে একেক স্ত্রীর ঘরে এক দিন করে থাকতে হয়। এরপর তিন দিন বিশ্রাম। এভাবে ঘর সামলাতে গিয়ে যে নক্ষত্রের ঘরে থাকতে পূর্ণিমা দেখা যায়—সেই নক্ষত্রের নামে হয় বাংলা মাসের নাম।
এবার আসল কথায় আসি। আমরা বৈশাখ সেই মাসকেই বলি—যে মাসে চাঁদ রাশিচক্রের বিশাখা নামের নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে পূর্ণিমা দেখায়। একইভাবে জ্যৈষ্ঠ মাসে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায় জেষ্ঠা নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে। আষাঢ় মাসে পূর্বাশা নক্ষত্রে, শ্রাবণ মসে শ্রবণা নক্ষত্রে, ভাদ্র মাসে ভাদ্রপদা নক্ষত্রে, আশ্বিন মাসে অশ্বিনী নক্ষত্রে, কার্তিক মাসে কৃতিকা নক্ষত্রে, অগ্রহায়ণ মাসে মৃগশিরা নক্ষত্রে, পৌষ মাসে পূষ্যা নক্ষত্রে, মাঘ মাসে মঘা নক্ষত্রে, ফাল্গুন মাসে ফাল্গুনি নক্ষত্রে এবং চৈত্র মাসে চিত্রা নক্ষত্রে দাঁড়িয়ে চাঁদ পূর্ণিমা দেখায়।
১২ জন স্ত্রীর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চাঁদের এই পূর্ণিমা প্রদর্শন করা থেকেই বাংলা মাসের এসব চমত্কার নাম।
বছরের কথা বলা শেষ করি সপ্তাহের সাত দিনের নাম দিয়ে। সপ্তাহ তো সপ্ত অহঃ বা দিনের সমাহার। সপ্তাহে রবি নামটি সূর্যের—যেটি কিনা নক্ষত্র, যাকে নিয়ে সৌর পরিবার। সোম চন্দ্রদের অর্থাৎ চাঁদেরই অন্য এক নাম। বাকি পাঁচটি নাম পাঁচটি গ্রহের শুক্র, শনি, বুধ, বৃহস্পতি ও মঙ্গল।
মাসের নামের কথা বলতে গিয়ে অগ্রহায়ণ মাসের কথা এসেছে। এটির সঙ্গে সম্পর্ক মৃগশিরা নক্ষত্রের। অগ্রহায়ণ শব্দের অর্থ হায়ন বা বত্সরের অগ্র। অনেক পণ্ডিত যেমন বলেন, আগে বর্ষ শুরু হতো বর্ষাকাল থেকে। তেমনি অনেক পণ্ডিতের মতে, বাংলা বছরের শুরু অগ্রহায়ণ মাস থেকে। অগ্রহায়ণের শেষেই তো নবান্ন। কৃষকের আনন্দের কাল। তাই অগ্রহায়ণ হলো মাসের শ্রেষ্ঠ এবং বছরের শুরুও বটে।
যাই হোক, এখন তো বর্ষ শুরু পয়লা বৈশাখে। এই দিনটাই আমাদের নববর্ষ। পুরোনো কথা জেনে রাখা ভালো। তবে তা নিয়ে বসে থাকা ভালো নয়। শুভ নববর্ষ।