সুন্দরবনের ভোর!
গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্ত—সব ঋতুতেই মোহনীয় এক সময়ের নাম।
বর্ষার সময়ে বৃষ্টি না হলে সুন্দরবনের দিনগুলো অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড গরমে হাঁসফাঁস করতে হয়। বৃষ্টি শুরু হলে সব বদলে যায়। আবহাওয়া সহনীয় হয়, রাতের দিকে ঠান্ডাও পড়ে।
তুমি যদি বড় কোনো বোটে বেশ কয়েকজন মিলে বড় নদীতে নোঙর করে বর্ষার সুন্দরবনের ভোরের রূপ দেখতে চাও, তাহলে ঠকবে।
ভোরের রূপ উপভোগ করতে হলে তোমাকে ছোট যান্ত্রিক যানে বা বড় নৌকায় বনের মাঝারি কোনো খালে থাকতে হবে। আগের রাতেই লঞ্চের সারেংকে জানিয়ে দেবে, তোমার বোটটি যেন কেওড়াগাছের বাগানের কাছাকাছি নোঙর করেন। সুন্দরবনের গাছপালা একেবারে নদী-খালের পাড় পর্যন্ত জন্মায়। কিন্তু কেওড়া বা বাইনবাগানের গাছগুলো বেশ উঁচু, তলায় ঝোপঝাড় খুব একটা জন্মায় না, বোট থেকেই জঙ্গলের অনেকখানি দেখা যায়।
ভোরের দিকে বৃষ্টি না পড়লে গায়ে একটি বর্ষাতি চড়িয়ে বাইনোকুলার হাতে বোটের সামনে কোথাও বসে পড়ো। আলো যেহেতু ভালো করে ফোটেনি, তাই কান সজাগ রাখো। পূর্ণিমা বা অমাবস্যার কাছাকাছি হলে জোয়ার–ভাটার তীব্র টান টের পাবে। নানা গাছের পত্রপল্লব সরসর করে গা ঘেঁষে চলে যাবে। খালের পানি মাঝেমধ্যে ছলকে উঠলে জানবে পারশে মাছের ঝাঁকে আড়িয়াল বা ভেটকি মাছ ঝাঁপিয়ে পড়েছে। হঠাৎ দূরে কোথাও ‘কুক কুরুৎ কুক’ শব্দে বনমোরগ ডেকে উঠবে, আর ঠিক এরপরই তোমার পাশের জঙ্গল থেকে আরেকটি মোরগ সাড়া দিয়ে উঠবে। তোমার দুই পাশে বনভূমি থাকায় তুমি দেখতে পাবে না। কিন্তু পাখিরা ঠিক দেখতে পাবে, দিগন্তে সূর্য উঠছে।
বনের জন্য সময়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নিশাচরেরা এ সময় বিশ্রামের জন্য আশ্রয় খোঁজে আর দিবাচরেরা আশ্রয় থেকে ফাঁকায় বের হয়ে আসে।
এমন সময় খয়েরি ডানা মাছরাঙা ক্যাঁক ক্যাঁক করে বন কাঁপিয়ে ডেকে উঠল হয়তো। বাইনোকুলার দিয়ে তাকে দেখতে দেখতেই জলের ধারে নলঘোঙ্গা পাখি দেখা যাবে। আলো একটু বাড়লেই বনভূমি মুখর হবে পাখির কলকাকলিতে। দরজি টুনটুনি, বাবলার, ফিঙে, কাঠঠোকরা, সহেলী, ফটিকজল, শ্বেতাক্ষী, আরও কত পাখি!
বিশাল ডানা ছড়িয়ে হয়তো মদনটাক বা সিন্ধু ইগল উড়ে যাবে। অবিরাম ডাক শুনতে পাবে ম্যানগ্রোভ পিটারের।
সুন্দরবনের বেশির ভাগ পাখিই বাচ্চা তোলে বর্ষায়। তাই তাদের কর্মতৎপরতা, ডাকাডাকিও বর্ষায় বেশি দেখা যায়।
কেউ একজন ফিসফিস করে তোমার কানের কাছে জানাল, ‘হরিণ! হরিণ!’
কেওড়াবনে তাকিয়ে দেখলে, কখন তিনটি হরিণ চলে এসেছে।
এত সব দেখতে দেখতে কখন যে সাতটা বেজে গেছে, সেটা টের পাবে পেটের টানে। সুন্দরবনে খিদে লাগে বেশি!
বৃষ্টিপাত যদি বন্ধ থাকে, তবে আর দেরি করবে না। নাকে–মুখে নাশতা গুঁজে কফির মগ হাতে নিয়ে সবান্ধব উঠে পড়বে বোটের সঙ্গে থাকা ডিঙিনৌকায়। নৌকাচালককে বলবে, নৌকা যেন খালের ধার দিয়ে চালায়। চালাতে হবে না, স্রোতের সঙ্গে চললেই হবে। খেয়াল রাখতে হবে, স্রোতের টানে নৌকা যেন ঝোপঝাড়ের মধ্যে ঢুকে না পড়ে! বৃষ্টির অত্যাচারে এ সময় অনেক সাপখোপ গাছে উঠে পড়ে। আর কে না জানে, বর্ষাকালে সাপের আনাগোনা বাড়ে। সুন্দরবন সাপের আড়ত হলেও মানুষকে খুব কম কামড়ায়।
নৌকাভ্রমণের দুই ঘণ্টায় অনেক পাখি, সাপ, ভোঁদড়, বানর, শূকর, গুইসাপ দেখতে দেখতে তুমি খেয়াল করতে পারোনি কখন আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে গেছে। তাড়াতাড়ি বোটে ফিরতে ফিরতে একপ্রস্থ ভিজতে হলো। কী আর করা!
শুরু হলো নিরবচ্ছিন্ন বৃষ্টিপাত। তিরতিরিয়ে পড়ছে তো পড়ছেই! দুপুরে জম্পেশ করে খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, ডিম ভাজা, পারশে মাছের দোপেঁয়াজি, পটোল ভাজা দিয়ে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে নিয়ো। এ সময় হয়তো কোনো একটি জেলেনৌকা তোমার কাছে এল। তাঁদের কষ্টের সীমা নেই। বাদলাতে তাঁদের রান্না হয়নি। পারলে তাঁদের কিছু সাহায্য কোরো। তাঁদের কাছ থেকে উচিত দামে চাকা চিংড়ি, ভেটকি মাছ কিনে নাও। রাতে চিংড়ির টেম্পুরা, ভেটকির বারবিকিউ হবে।
তিনটার দিকে বৃষ্টি ধরে এলে ফরেস্ট গার্ডসহ কেওড়াবাগানে নেমে পোড়ো। সুন্দরবনে হাঁটার জন্য আমি বহু ধরনের জুতা ট্রাই করেছি। জলকাদা, শুলোর অত্যাচারে কোনো জুতাই উপযুক্ত মনে হয়নি। তবে মৌয়ালরা প্লাস্টিকের জুতা ব্যবহার করেন দড়ি দিয়ে পায়ের সঙ্গে বেঁধে। এই জুতা কিছুটা কাজের।
কেওড়াবনে জোয়ারের জলে তলিয়ে না গেলে নানা ধরনের জীবজন্তুর পায়ের ছাপ দেখতে পাবে। বনটি যদি অনেকখানি বিস্তৃত হয়, তাহলে কোনো একটি এলানো কেওড়াগাছে সবান্ধব উঠে পোড়ো। পাঁচটা পর্যন্ত চুপচাপ সেখানে থাকো। কত কিছু যে দেখতে পাবে! শুনতে পাবে আরও অনেক কিছু। সাবধানে ফিরে বিকেলের চা-পর্ব সন্ধ্যায় সারো। খাওয়ার সময়ও কান খাড়া রাখতে ভুলবে না। সন্ধ্যাগমে মোরগ ডাকবে, নাইটজার ডাকবে, দূরাগত হরিণের আর্তস্বর নিয়ে তবেই না বনে সন্ধ্যা নামবে। এই করে তোমাদের সঙ্গে থাকা ফরেস্ট গার্ডকে ডেকে তাঁকে অনুরোধ কোরো তাঁর বনের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে। তোমাদের খুশি করতে তিনি হয়তো দুঃসাহসিক ঘটনা বাড়িয়ে বলবেন, কিন্তু তাঁকে অবিশ্বাস করবে না। জেলেনৌকাটি যদি তোমাদের কাছে থাকে, তবে তার সরদার মাঝিকে সসম্মানে ডেকে বনের অজানা-অভূতপূর্ব কাহিনি শুনতে পারো। নিকষ রাতে সেসব কাহিনি ক্ষণে ক্ষণে রোমাঞ্চিত করবে তোমাকে।
তারপর ডিনার করে নিরুপদ্রব ঘুমের চেষ্টা করো।
গল্পের বাঘ যেন তোমার স্বপ্নে হানা না দেয়।