হাওর মানেই জলে ভাসা জনপদ। বছরের প্রায় সাত মাস হাওর অঞ্চলের গ্রামগুলো জলের ওপর ভাসতে থাকে! তখন সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলোকে দূর থেকে দ্বীপের মতো মনে হয়। বাতাসের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বর্ষার আদিগন্ত বিস্তৃত থইথই পানি কখনো শান্ত-সৌম্য আবার কখনো ভয়ংকর রূপ নেয়। যখন দুরন্ত বেগে প্রলংয়করী ঝড় আসে, তখন হাওর আগ্রাসী হয়ে ওঠে। তছনছ করে দেয় গাছপালা আর গ্রামের পর গ্রাম। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে অনেকটা বুক চিতিয়েই বেঁচেবর্তে থাকে হাওরের মানুষ।
বর্ষায় কেবল যে হাওরের প্রলয়ংকরী রূপ দেখা যায়, তা কিন্তু নয়; বরং এ সময়ে গ্রামের মানুষ নির্মল আনন্দে মেতে ওঠে। এক গ্রামের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরেক গ্রামের মানুষ আয়োজন করেন পালাগান, যাত্রাগান, বাউলগান, গাজির গানসহ নানা বৈচিত্র্যময় উৎসবের। গ্রামীণ নারীরা অলস সময়ে নকশিকাঁথা সেলাই থেকে শুরু করে বিয়ের আয়োজনে ধামাইল ও গীত পরিবেশনে নিজেদের মেধা ও সৃজনশীলতার পরিচয় দেন।
বর্ষায় কখনোই হাওরে উৎসব পালনে বৈচিত্র্য আসে না, যদি না ওই বছর বোরো ধানের ফলন ভালো হয়। হাওরের ৮০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী। হাওরের কৃষিজমি এক ফসলি, অর্থাৎ বোরো ধানভিত্তিক হওয়ায় বোরো ফসল ভালো না জন্মালে সারা বছর অভাব-অনটনে থাকতে হয়। তাই বোরো ফলনের ওপরই নির্ভর করে এখানকার মানুষের আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ। বর্ষার সাত মাস বাদে শুষ্ক মৌসুমের পাঁচ মাস এখানে কৃষকেরা হালচাষ করেন। জমিতে বোরো ধান ফলান। ফাল্গুন মাসের শেষ সময়ে ফলানো সেই সবুজ কচি ধান গাছে থোড় আসে। কয়েক দিনের ব্যবধানে সেই থোড় ফেটে ধানসমেত কাঁচা ডগাগুলো আকাশমুখী হয়ে হাওয়ায় দুলতে থাকে।
হাওরের লিলুয়া বাতাসে দুলতে থাকা ধানের ছড়াগুলো চৈত্র মাসের শেষ সময়ে এসে পেকে শক্ত ও বলবান হয়ে সোনালি আভা ছড়ায়। একসময় সেই সোনালি ধানে ভরে যায় খেতের পর খেত। তখন চলে ধান কাটার মহোৎসব। বৈশাখের প্রথম দিন থেকেই হাওরের মাঠে-ঘাটে শুরু হয় খেতভরা সেই ফসল কেটে শুকিয়ে ঘরে তোলার কাজ। যে বছর জমিতে বোরো প্রচুর জন্মায়, সে বছর বর্ষায় উৎসবের রং-ছন্দ বর্ণিল মাত্রা পায়।
বর্ষায় সব হাওর মিলেমিশে একাকার রূপ ধারণ করে। এ যেন অন্য রকম সমুদ্র। হাওর শব্দটি এসেছে কিন্তু সমুদ্রের অপভ্রংশ হয়ে। সমুদ্র থেকে ‘সায়র’, অতঃপর ‘হাওর’। জল-প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য লুকিয়ে রয়েছে হাওরের পরতে পরতে। আকাশে মাছরাঙা আর পরিযায়ী পাখিদের ওড়াউড়ি তো রয়েছেই।
রংবেরঙের কত শত পালতোলা নৌকা হাওরের বুকে দিনমান আসা-যাওয়া করে। মাঝিরা মনের আনন্দে গেয়ে ওঠেন ভাটিয়ালি গান। জেলেরা মাছ ধরতে ব্যস্ত। মাথার ওপর যখন সূর্য থাকে, তখন দুপুরের কড়কড়ে রোদ হাওরের পানিতে পড়ে চিকচিক খেলা করে। ছোট ছোট ঢেউয়ে রুপালি আলো দোল খায়। সেই ঢেউয়ে ছন্দময় তালে দুলুনি খেতে খেতে এগিয়ে চলে নৌকাগুলো। ক্ষণে ক্ষণে বদলায় হাওরের প্রাকৃতিক দৃশ্য। আকাশও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রূপ বদল করতে থাকে। কোথাও নীল আকাশের ফাঁকে তুলার মতো ভেসে যাবে সাদা মেঘ, কোথাও আকাশের বুকে থোকা থোকা হলুদের পরশ। বিকেলে দূরের পশ্চিম আকাশে অনেকটা শান্তশিষ্ট হয়ে লালচে সূর্যটা টুপ করে ডুব দেয় হাওরের জলে। গোধূলি পেরিয়ে সন্ধ্যা নামে। দূরে তাকালে দেখা যায়, বিদ্যুিবহীন গ্রামগুলোয় হারিকেনের আলো জোনাকি পোকার মতো মিটিমিটি জ্বলছে।
সকাল, দুপুর, বিকেল আর রাত—এ চার সময়ে হাওরের রূপবৈচিত্র্য ভিন্ন রূপ-রং ধারণ করে। জ্যোৎস্না রাতে সুনসান হাওরের পানিতে চাঁদের আলো উপচে পড়ে। যেন ‘আসমান ভাইঙা জ্যোৎস্না পড়ে’। রাত ধরে জ্বলতে থাকে চাঁদের আলো। সেই আলোয় ভিজে একাকার হয় হাওরের পানিতে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা হিজল-করচগাছ। রাতজাগা পাখিদের কিচিরমিচির উপেক্ষা করে আচমকা হয়তো কোনো এক পল্লিগায়ক হাওরে ডিঙি নৌকা ভাসিয়ে গন্তব্যে ফেরার পথে গাইতে থাকেন, ‘জ্বালাইয়া চান্দের বাত্তি, জাইগা রইলাম সারা রাত্রি গো’সহ কত শত গান। দূর থেকে ভেসে আসা এসব গানের ছন্দময় তালে হাওরের মানুষ সুখে নিদ্রা যায়।