বলা নেই কওয়া নেই, আকাশ ঘন কালো মেঘে ঢেকে যাবে। দিনভর চলবে ঝুম কিংবা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। এই তো বাংলাদেশে বর্ষার চিরচেনা চেহারা। তবে জুন মাস এলেই কেন বর্ষা নামে, অন্য মাসগুলোতে এত বৃষ্টি-মেঘ যায় কোথায়? বর্ষা এলেই কোথা থেকে হাজির হয় মেঘ-বৃষ্টির দল? মেঘ থেকে বৃষ্টি নামে, এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু সব মেঘ থেকেই কি বৃষ্টি ঝরে? তাহলে শরৎকালে আকাশজুড়ে যে সাদা মেঘের ওড়াউড়ি চলে, সেটা থেকে বৃষ্টি হতে দেখা যায় না কেন! তার মানে, সব মাসে সব মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় না।
বৃষ্টি নিয়ে অসংখ্য কবিতা লিখে গেছেন আমাদের কবিরা, এখনো লিখছেন। আবার বৃষ্টি না হলে নানা রকম নিয়মও পালন করেন গ্রামগঞ্জের মুরব্বিরা। অনেক দিন বৃষ্টি না হলে ব্যাঙের বিয়ে দেওয়ার নিয়ম প্রচলিত আছে এখনো। গ্রামে গ্রামে তরুণ-কিশোরেরা বৃষ্টির জন্য গানবাজনা বাজিয়ে ঘুরে বেড়ায়। পনেরো শতকের মাঝামাঝি সময়ে ভারতবর্ষের সম্রাট আকবরের দরবারে মিয়া তানসেন নামের একজন শিল্পী সংগীত করতেন। কথিত আছে, তাঁর সংগীতের সুরের ছন্দে বৃষ্টিহীন আকাশে মেঘ জমে যেত, শুরু হতো অঝোরধারায় বৃষ্টি। হিন্দুধর্মে তো বৃষ্টির একজন দেবতাও আছেন, যাঁর নাম ইন্দ্র।
শুধু যে ভারতবর্ষেই বৃষ্টি নিয়ে এত মাতামাতি, তা কিন্তু নয়। পৃথিবীর সব প্রাচীন সভ্যতা আর ধর্মে বৃষ্টিকে অনেক গুরুত্ব দেওয়া হতো। কারণ, মানবসভ্যতার বিকাশ ঘটেছে বৃষ্টি আর নদীকে কেন্দ্র করে। মানুষ বৃষ্টিবহুল আর নদীর তীরবর্তী এলাকায় বসতি গড়েছে সব সময়। পৃথিবীর অধিকাংশ বড় শহর ও সভ্যতা গড়ে উঠেছে প্রকৃতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই উপাদানকে কেন্দ্র করে। এ কারণে লাতিন আমেরিকার মায়া সভ্যতার অন্যতম দেবতা ‘চাক’ ইন্দ্রের মতোই বৃষ্টি নিয়ে আসতেন। একইভাবে চীনাদের দেবতা ইউ শি থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই দ্বীপের প্রাচীন অধিবাসীদের বৃষ্টি আর উর্বরতার দেবী ছিলেন লোনো।
অর্থাৎ বৃষ্টি আর বর্ষা মানেই মাটির উর্বরতা বেড়ে যাওয়া, ফসল বোনার সময় হওয়া আর নদীতে মাছের আনাগোনা বাড়তে থাকা। সারা বছর বৃষ্টির অভাবে শুকিয়ে যায় অনেক নদী, খাল-বিল ও হাওর। বর্ষা এলে প্রাণ ফিরে আসে সেখানে। একসময় আমাদের এখানে বছরে একটি ফসল হতো, সেটি হতো এই বর্ষায়। বৃষ্টির মিষ্টিপানির ছোঁয়া পেয়ে যে ফসল ফলত আর মাছ আসত, তা দিয়ে সারা বছরের খাবারের চাহিদা মিটত এখানকার মানুষের। বাংলাদেশে প্রাচীনকালে যে বিখ্যাত মসলিন কাপড় বোনা হতো, তা–ও বড় নৌকায় করে বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ত। বর্ষায় নদীর পানি বেড়ে গেলে বিশাল বিশাল নৌকা আসত ঢাকার পাশে নারায়ণগঞ্জ-মুন্সিগঞ্জে। সেগুলোতে করে পূর্ব এশিয়া থেকে মসলা আর হরেক রকমের শৌখিন পণ্য আসত। আর নিয়ে যেত মসলিন। বছরের অন্য সময়ে নদীতে পানি কম থাকায় এত বড় নৌকা আসতে পারত না। তাই কৃষি থেকে শুরু করে বাণিজ্য—সবকিছুই ছিল বর্ষানির্ভর।
বর্ষা শুধুই ফসল আর নদীকে জীবন দেয়, তা কিন্তু নয়। বর্ষার বৃষ্টি অনেক রোগবালাই সারিয়ে তোলে। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠজুড়ে গ্রামবাংলার দুরন্ত ছেলেমেয়েরা রোদে পুড়ে, ঘামে ভিজে মাঠে খেলে বেড়ায়। ঘাটে ঘুরে বেড়ায়। তাতে তাদের শরীরে ঘামাচি হয়, রোদে গায়ের রং পুড়ে হয়ে যায় তামাটে। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার পর প্রকৃতির সব জঞ্জালের মতো মানুষের শরীরের অনেক রোগবালাই দূর করে দেয়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে প্রচলিত স্পেন, ইতালি ও পর্তুগালে মায়েরা কোলের কয়েক মাসের শিশু থেকে শুরু করে কিশোর-কিশোরীদের নিয়ে একসঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজেন। বর্ষার প্রথম বৃষ্টিতে ভেজার মধ্য দিয়ে শিশু-কিশোরদের ঠান্ডা-কাশির মতো ভাইরাসজনিত রোগপ্রতিরোধের ক্ষমতা শরীরে তৈরি হয় বলেও বলে থাকেন বিজ্ঞানীরা।
তবে মনে রাখতে হবে, বছরের সব বৃষ্টি কিন্তু এক রকমের না। বাংলাদেশে মূলত জুন থেকে কাগজে–কলমে বর্ষা শুরু হয়। কারণ, ওই সময় সুদূর মাদাগাস্কারের কাছে ভারত মহাসাগর হয়ে বঙ্গোপসাগরের পথ ধরে বাংলাদেশ ও ভারতে মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করে। বিশাল আয়তনের ওই বায়ুর সঙ্গে আসে বিপুল পরিমাণে মেঘ আর জলীয় বাষ্প। ওই মেঘমালা কক্সবাজার উপকূল দিয়ে প্রবেশ করে বাংলাদেশে। জুনের মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে ওই বায়ু সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে শুরু হয় তুমুল বৃষ্টি। ওই বৃষ্টি থাকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমাদের এখানে বর্ষাকাল হিসেবে ধরা হয়। জুনে আসা মৌসুমি বায়ু হিমালয়ের বিশাল আর সুউচ্চ পর্বতমালায় বাধা পেয়ে দেশের উপকূল থেকে শুরু করে বৃষ্টি ঝরায় উত্তরাঞ্চলসহ সবখানে।
তবে বছরের অন্য সময়ের বৃষ্টির তুলনায় বর্ষার বৃষ্টির আলাদা একটি বিশেষত্ব আছে। বর্ষার মেঘমালাগুলো অনেক দীর্ঘ ও বিস্তৃত হয়। আর বৃষ্টি পড়েও অনেক সময় নিয়ে। এই সময়ে বাতাসের গতিবেগ থাকে কম। তাই তা মেঘগুলোকে সরিয়ে অন্যত্র নিতে পারে না। মেঘের ওপরে মেঘ জমে অনেক জায়গায় পুরো আকাশ কালো হয়ে যায়। বৃষ্টি চলে অনেক সময় ধরে। অনেক সময় টানা কয়েক দিন চলে বৃষ্টি।
তবে বছরের অন্য সময়ের তুলনায় বর্ষার বৃষ্টির পানি অপেক্ষাকৃত উষ্ণ বা কম ঠান্ডা থাকে। কারণ, আকাশের যত উঁচুতে মেঘ থাকবে, তার তাপমাত্রা থাকবে তত কম। বর্ষার বৃষ্টির মেঘ থাকে কিছুটা নিচে, সেখানে তাপমাত্রাও একটু বেশি থাকে। ফলে বর্ষার ঝিরঝিরে বা মুষলধারার বৃষ্টিতে অনেক সময় নিয়ে ভিজলেও খুব বেশি ঠান্ডা লাগে না। তবে মনে রাখতে হবে, বৃষ্টি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিজতে রওনা দিলে হবে না। কারণ, আমাদের এখানে বাতাসে প্রচুর ধূলিকণা, কার্বনসহ নানা ধরনের দূষিত বস্তু থাকে। সেগুলো বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে মিশে যায়। ফলে বৃষ্টি নামার প্রথম ৮-১০ মিনিট ওই দূষিত বস্তুগুলো থাকে, তারপর আসতে শুরু করে স্বচ্ছ ও পরিষ্কার বৃষ্টির পানি। তখন ভিজলে কোনো সমস্যা নেই।
কিন্তু বর্ষার আগেও যে বৃষ্টি হয় না, তা তো বলা যাবে না। এপ্রিল মাসজুড়েও দেশব্যাপী কালবৈশাখী আর থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। তবে এই বৃষ্টির উৎস ওই হাজার মাইল দূরের ভারত মহাসাগর থেকে আসা মৌসুমি বায়ু নয়। মূলত দেশের ভেতরে যে নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর ও জলাশয়গুলো রয়েছে, তা বৈশাখের খরতাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আমরা যেমন চুলায় পাতিলে পানি গরম করি, তেমনি বৈশাখের খরতাপে জলাশয়গুলো থেকে পানি জলীয় বাষ্প হয়ে ঊর্ধ্বাকাশে উঠে যায়। জলীয় বাষ্পগুলো পরে একসঙ্গে জোড়া লেগে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা হয়ে ঝরে পড়ে। তবে ওই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কিছুটা বড় আর ঠান্ডা হয়। বর্ষার বৃষ্টি যেমন সোজা হয়ে পড়ে, গ্রীষ্মের বৃষ্টি পড়ে কিছুটা বাঁকা হয়ে। এই বৃষ্টিতে ভিজলে ঠান্ডা-কাশি লাগার আশঙ্কা তাই বেশি। আবার গ্রীষ্মের বৃষ্টির সঙ্গে বজ্রপাতও হয়। দেশে প্রতিবছর দুই শ থেকে আড়াই শ মানুষ বজ্রপাতের আঘাতে মারা যাচ্ছে। ফলে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠের বৃষ্টিতে কম ভেজা ভালো।
গ্রীষ্ম ও বর্ষা ছাড়া শীতকালেও অনেক সময় বৃষ্টি নামে। বিশেষ করে নভেম্বর-ডিসেম্বরে যে বৃষ্টি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তার উৎস হচ্ছে বঙ্গোপসাগর। ওই সময়ে বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপ বেড়ে যায়। অর্থাৎ সাগরের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি গরম হয়ে যায়। ফলে বাতাস আরও হালকা হয়ে উঠে যায় ওপরে। ওই শূন্যস্থান পূরণ করতে চারপাশ থেকে যে বাতাস আসে, তা থেকে তৈরি হয় নিম্নচাপ ও ঘূর্ণিঝড়। এর সঙ্গে তৈরি হওয়া মেঘ বাতাসের সঙ্গে ভেসে চলে আসে বাংলাদেশে। আর তা জমে জমে নামে বৃষ্টি। বাংলাদেশে এপ্রিল-মে আর নভেম্বর-ডিসেম্বর হচ্ছে ঝড়ের কারণে নামা বৃষ্টির মৌসুম।
বৃষ্টির যেমন মৌসুম আছে, তেমনি এর ভূগোলও আছে। অর্থাৎ সব জায়গায় সমান বৃষ্টি হয় না। বাংলাদেশের কথাই যদি আমরা ধরি, এখানে সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় সিলেট আর মৌলভীবাজারে। এ ছাড়া কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ, নোয়াখালী, ফেনী, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড আর রাঙামাটিতে বৃষ্টি বেশি হয়। আর সবচেয়ে কম বৃষ্টি হয় রাজশাহীতে। আমাদের রাজধানী ঢাকাতে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি হয়ে থাকে। আর বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় ভারতের চেরাপুঞ্জিতে।
বৃষ্টি নিয়ে তো এতক্ষণ অনেক ভালো ভালো আর জ্ঞানের কথা হলো। কিন্তু বর্ষা এলে বৃষ্টির পানিতে যখন আমাদের বড় দুই শহর ঢাকা আর চট্টগ্রাম প্রায় ডুবে যায়, হাঁটুপানিতে হেঁটে হেঁটে আর ভিজে ভিজে বাড়িতে ফিরতে হয় অনেককেই। রাস্তায় কাজ করা দিনমজুর কিংবা ঘরহীন অনেক দরিদ্র মানুষ পড়ে বিপাকে। তখন কিন্তু বৃষ্টির মানে দাঁড়ায় দিনভর কষ্ট আর যন্ত্রণাও। তবু বৃষ্টি হোক গ্রামের মাঠেঘাটে নতুন ফসলের হালকা সবুজ রঙের আঁচড়। নদী-বিলজুড়ে রুপালি মাছের দাপাদাপির নিরাপদ আশ্রয়। আর আমাদের শহরগুলোকে গোসল করিয়ে পরিচ্ছন্ন করার নিপুণ কারিগর। সবার মনে এনে দিক শান্তির ছোঁয়া।