বন্যেরা বনেই সুন্দর

ছবি: শফিকুল ইসলাম

২০১৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর। মিরপুর চিড়িয়াখানা। খাঁচায় একটা হাতি। পায়ে শিকল। আজ একটু বেশি ছটফট করছে ও। শিকল থেকে নিজেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে নিজেকে। হাতি কথা বলতে পারে না, তবু ওর দুটি চোখ দেখে যেন পড়া যাচ্ছে মনের কথা। তাহলে ও কি টের পেয়েছে, আজ ১৬ ডিসেম্বর? বিজয় দিবস? ওর তো এখন বনে থাকার কথা। অন্য হাতিদের সঙ্গে দাপট দেখিয়ে ঘুরে বেড়াবে। শুঁড় দিয়ে গা ভেজাবে। বড় বড় কলাগাছ ভেঙে খাবে। এ রকম একটা প্রাণীকে বেঁধে রাখলে ছটফট তো করবেই।

হাতিটার আচরণ দেখে মনে এসব কথাই ঘুরছিল ফটোগ্রাফার শফিকুল ইসলামের। ৩৫ বছর বয়সী শফিকুল ইসলাম মূলত একজন ব্যবসায়ী। ফটোগ্রাফির প্রতিও ঝোঁক আছে বেশ। ২০১৩ সাল থেকে ফটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত তিনি। ছবি তোলার চর্চার জন্য তিনি বেছে নেন চিড়িয়াখানাকে। সেই অভিজ্ঞতাই শুনছিলাম তাঁর মুখ থেকে।

শফিকুল ইসলাম।

মানুষের বনে গিয়ে বসবাস করতে হলে কেমন হতো ভেবে দেখো? তোমাকে গাছের লতা-পাতা, ফলমূল খেয়ে থাকতে হবে। পায়ের নিচে স্যাঁতসেঁতে মাটি, মশা, বিভিন্ন পোকামাকড়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে। ভাবতেই তো কেমন যেন লাগে! একইভাবে একটা বনের সিংহকে তোমার টাইলসের বাসার মধ্যে রাখা হলে কেমন হবে? বেচারা তো হাঁটতে গিয়ে পড়ে যাবে। চিড়িয়াখানার বিভিন্ন প্রাণীর অবস্থাও এই রকম। কথায় আছে না, ‘বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’।

ছবি: শফিকুল ইসলাম

বানর এক মহা দুষ্টু প্রাণী। এ গাছ থেকে ও গাছে ঘুরে বেড়ায়। বলা যায়, অন্য সব পশু-পাখির জন্য বিরক্তিকর একটা জন্তু সে। মাঝেমধ্যে তো দাঁতও ভেংচি দেয়। বড়-ছোট কাউকে মানে না। তোমরাও এমন দুরন্ত প্রাণীকে খাঁচায় নিস্তেজ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছ চিড়িয়াখানাতে। বেচারা বানর ঠিকই বেঁচে আছে, কিন্তু ওর ব্যবহারে ওকে চেনা যাচ্ছে না। চিড়িয়াখানার বানরগুলো কি বনের জীবনের সেই স্বাদ এখানে পাচ্ছে?

একইভাবে সিংহ বা বাঘের মতো হিংস্র প্রাণীর কথাও ভেবে দেখো। ওদের এমন একটা জায়গা চাই, যেখানে সে নিজের একটা রাজত্ব সৃষ্টি করতে পারবে। ঘোরাফেরা করতে পারবে। দৌড়ে একটু ব্যায়ামও করে নিতে পারবে আরকি। কিন্তু শফিকুল ইসলামের তোলা ছবিতে দেখা গেল এক নিস্তেজ সিংহকে। ‘বনের রাজা সিংহ’—চিড়িয়াখানাতে এসে খাঁচার কোনো এক আজব প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। দেখে আর চেনা যাচ্ছে না, এই সেই ভয়ংকর প্রাণী, যাকে নিয়ে বড়রা গল্প শোনায়!

চিড়িয়াখানা প্রাণীদের দেখে আনন্দ পায় সবাই। অথচ ওদের জীবনটা কী কষ্টের
ছবি: শফিকুল ইসলাম

উপযুক্ত পরিবেশ, পরিচর্যা, নিয়ম প্রয়োগের অভাবে প্রাণীগুলো অসহায়ের মতো দিন কাটাচ্ছে। বলা যায়, হাতিটার আচরণই নাড়া দেয় শফিকুল ইসলামের মনকে। আর এ ধরনের আচরণ যে শুধু হাতি করছে, তা নয়। আরও অনেক প্রাণীই আছে। প্রতিটি ক্লিকে তিনি তুলতে থাকেন এসব মর্মান্তিক ছবি। বানর, সিংহ, খরগোশ, কুমির—কোনো প্রাণীই বাদ যায়নি।

ছবি: শফিকুল ইসলাম

শফিকুল ইসলামের ছবিতে উঠে আসে খাঁচার ভেতর থেকে বাইরে হাত বের করে আছে একটা বানর। ও কি একটু মুক্ত বাতাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল? নাকি বৃষ্টির পানিতে হাতটা একটু ভিজিয়ে নিতে চেয়েছিল? একইভাবে আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, খাঁচার মধ্যে একটি রাজহাঁস দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে সঙ্গী হিসেবে আছে কেবল তার ‘ছায়া’।

এভাবে প্রায় দুই বছর ছবি তুলে গেছেন শফিকুল ইসলাম। ২০১৮ সালের শেষ দিকে এগুলো প্রকাশের তাগিদ অনুভব করলেন, যার অন্যতম কারণ, প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা। শফিকুল ইসলামের ফটোস্টোরি প্রথম প্রকাশিত হয় ৩ জুলাই, একটি বিদেশি অনলাইন সাইটে। এরপর ধীরে ধীরে বিভিন্ন অনলাইন মিডিয়াতে প্রকাশিত হতে থাকে সেগুলো। করুণ এসব ছবি সাড়া ফেলে ব্যাপকভাবে।

ছবি: শফিকুল ইসলাম

তোমাদের অনেকেই হয়তো চিড়িয়াখানাতে গিয়েছ। চিড়িয়াখানা মূলত প্রাণীর প্রজনন, প্রদর্শন, শিক্ষা ও গবেষণার জন্য বানানো হয়ে থাকে। আবার যেসব প্রাণীর জন্য বনে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে, সেগুলোও সংগ্রহ করা হয় চিড়িয়াখানাতে। কিন্তু এই পরিবেশে ভয়, ক্ষুধা এবং নির্জীবতা পিষ্ট করে ফেলছে এসব প্রাণীকে। বন্দীজীবন কে চায়? শফিকুল ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, এসব প্রাণীকে রাখা হচ্ছে অনেক ছোট ছোট খাঁচায়। সাফারি পার্কের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারলে এই ধরনের অবস্থা থেকে কিছুটা হলেও উন্নতি সম্ভব। কারণ, সাফারি পার্কে প্রাণীরা একটি নির্দিষ্ট বনের মধ্যে ঘুরতে পারে, দর্শনার্থীরা নিরাপদ দূরত্ব থেকে ঘুরে আসতে পারে।

শুধু তা–ই নয়। অনেক সময় দর্শনার্থীরা চিড়িয়াখানায় গিয়ে পশু-পাখিকে বিভিন্ন জিনিস খেতে দেয়। কিন্তু এটা মনে রাখতে হবে, আমাদের আর ওদের খাবার কিন্তু এক নয়। আমরা মসলা–জাতীয় খাবার, যেমন চিপস খেতে পারি। কিন্তু সেটা বনের একটা প্রাণীর জন্য কতটা উপযুক্ত, তা না জেনে না দেওয়াই ভালো। আবার অনেক সময় ছবি তোলা বা বিভিন্ন প্রাণীকে দেখার জন্য অনেকেই খোঁচা দেয়, আঘাত করে। সেটা ঠিক কি না, তোমরাই ভেবে দেখো।

প্রাণহীন চোখে খাঁচার বাইরে তাকিয়ে আছে এসব পশু-পাখি। পাখিগুলো হয়তো ভাবছে নীল আকাশে পাখা মেলে উড়ে যাওয়ার কথা, বাঘটা হয়তো ভাবছে বনের সেই সীমানার কথা, যেখানে সে ঘুরে ঘুরে নিজের রাজত্ব কায়েম করত। কুমিরটা হয়তো ভাবছে, অন্য কুমিরদের সঙ্গে নদীতে শিকারের সময়কার কথা। ওরা কী ভাবছে, সেটা হয়তো কেউ জানবে না। কোনো দিনই না!