বন্ধুত্ব, ভালোবাসা আর ফারাজের গল্প

দুই বন্ধু বনের মধ্য দিয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ একটি ভালুক তাদের আক্রমণ করল। দৌড়ে তারা চলে এল একটি উঁচু গাছের কাছে। প্রথম বন্ধু দ্রুতই উঠে পড়ল গাছে। দ্বিতীয় বন্ধু গাছে উঠতে পারে না। কিন্তু প্রথম বন্ধু তার সাহায্যে এগিয়ে এল না। উপায় না দেখে দ্বিতীয় বন্ধু গাছের নিচে স্থির হয়ে শুয়ে পড়ল। সে শুনেছিল, ভালুক নাকি মরা মানুষ স্পর্শ করে না। ভালুকটি তার মুখের কাছে নাক নিয়ে শুঁকে-টুকে মনে করল, সে বুঝি সত্যিই মরে গেছে। তাই ভালুকটি চলে গেল। প্রথম বন্ধু তখন নেমে এসে বলল, ‘দেখে মনে হলো, ভালুকটি তোমার কানের কাছে কিছু বলছে!’ দ্বিতীয় বন্ধু উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ, ও বলল, যে বন্ধু তোমাকে বিপদে সাহায্য না করে পালিয়ে বাঁচে, সে প্রকৃত বন্ধু নয়।’

বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। তাই প্রকৃত বন্ধুত্বের কথা এলেই ইশপের এ গল্পটি আমাদের মনে পড়ে যায়। বিপদে বন্ধুর কথা ভুলে নিজেকে বাঁচানোর এই সংস্কৃতির ব্যতিক্রমের কথাও আমরা মাঝে মাঝে জানতে পারি। এমনই এক ব্যতিক্রম ফারাজ আইয়াজ হোসেন।

আর সব কিশোরের মতোই ফারাজ ছিল উচ্ছল, প্রাণবন্ত ছেলে। গান শুনতে পছন্দ করত, সময় কাটত হাসি-আনন্দ আর খেলাধুলায়। ফুটবলের প্রতি একটু বেশিই ভালোবাসা ছিল তার। খেলতও দারুণ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পাগল ফ্যান ছিল সে। ছোটবেলা থেকেই অদ্ভুত মজার এক স্বভাব ছিল—পরিচিত কেউ এলে পেছন থেকে লাফিয়ে তার ঘাড়ে চড়ে বসত! অন্যকে এভাবে চমকে দিতে ভালোবাসলেও ফারাজ নিজেই চমকে যেত ভূত দেখে! খুব বেশি ভূতের ভয় ছিল, তাই একা ঘুমাতে পারত না সে। ঘুমাত বড় ভাই যারেফের সঙ্গে। তার সঙ্গে খুনসুটি লেগেই থাকত। যারেফ ভাবত, মা ফারাজকে বেশি ভালোবাসেন। ফারাজ আবার ভাবত তার উল্টোটা। মাঝে মাঝেই হাতে একটা কাঁচি নিয়ে পেছন থেকে ভাইয়ের মাথার খানিকটা চুল কেটে দেওয়ার চেষ্টা করত সে। কিন্তু দিনশেষে ঠিক ঠিক চলে আসত সেই ভাইয়ের কাছেই।

ঢাকার আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে পড়ত সে। সেখানেই পরিচয় অবিন্তা কবীর আর তারিশি জৈনের সঙ্গে। একসঙ্গে দীর্ঘদিন পড়ার সুবাদে তিনজনের ছিল চমৎকার বন্ধুত্ব। তারিশি ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলিতে এবং অবিন্তা আর ফারাজ যোগ দিয়েছিল ইমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনজনই জড়িত ছিল সমাজসেবামূলক নানা কাজে। হাতখরচের টাকা থেকে জমিয়ে তিনজন দরিদ্র শিশুর পড়ার খরচ দিত সে। ফারাজ তার মাকে বলত, ‘আমি এমন কিছু করব যে সারা দেশ আর বিশ্ব চমকে যাবে!’ ভারতীয় হলেও বাবার চাকরির সুবাদে ছোটবেলাটা ঢাকায়ই কেটেছে তারিশির। ফলে বাংলাদেশের প্রতি তারও টান ছিল। সে জন্য সুযোগ পেয়েই ইন্টার্নশিপ করতে বাংলাদেশে আসে সে।

২০১৬ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যায় তিনজন দেখা করতে এসেছিল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে। কিছু সময় পরই আরও অনেকের সঙ্গে তারা সেখানে ভয়াবহ এক জঙ্গি হামলায় জিম্মি হয়। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমস-এর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জঙ্গিরা শুধু বিদেশিদের হত্যা করবে এবং বাংলাদেশিদের কিছু করবে না বলে জানিয়েছিল। একসময় তারা আরও কয়েকজন জিম্মির সঙ্গে ফারাজকেও ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। ফারাজ জানতে চেয়েছিল, তার দুই বন্ধুর কী হবে। জঙ্গিরা জানায়, তারিশি ভারতীয় হওয়ায় এবং অবিন্তার মার্কিন নাগরিকত্ব থাকায় তাদের ছাড়া হবে না। শুনে ফারাজ বলে, বন্ধুদের রেখে সে যাবে না। পরদিন তারিশি আর অবিন্তার সঙ্গে ফারাজেরও মরদেহ পাওয়া যায়।

ফারাজের এই আত্মত্যাগের কথা শুনে গর্বিত হয়েছে ফারাজের শোকার্ত পরিবার। গর্বিত হয়েছে সারা দেশ আর পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ। ফারাজ সারা দেশ আর বিশ্বকে চমকে দিতে চেয়েছিল, বন্ধুত্বের জন্য নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে সে সত্যিই চমকে দিল সবাইকে। ফারাজ গাড়ি চালাতে খুব পছন্দ করত। যেতে চাইত বহুদূর। যারেফকে প্রায়ই বলত, ‘ভাইয়ু, আমি তোমার চেয়ে ভালো চালাই। তোমাকে ছাড়িয়ে গেছি আমি।’ ফারাজ সত্যিকার অর্থেই ছাড়িয়ে গেছে সবাইকে। সে প্রমাণ করে দিয়েছে, বাংলাদেশিরা ইশপের গল্পের প্রথম বন্ধুর মতো পালিয়ে যায় না, বরং বন্ধুর বিপদে সামনে দাঁড়ায় বুক পেতে।

মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র বলেছিলেন, ‘অন্ধকার কখনো অন্ধকার দূর করতে পারে না, তার জন্য আলো প্রয়োজন। ঘৃণা কখনো ঘৃণা দূর করতে পারে না, একমাত্র ভালোবাসাই পারে তাকে দূর করতে।’ বিপথগামী জঙ্গি তরুণেরা যে প্রবল ঘৃণা নিয়ে হত্যা করেছে নিরীহ মানুষকে, তা দেখে আমরা হতাশ হই। তার চেয়েও বেশি অনুপ্রাণিত হই বন্ধুদের প্রতি ফারাজের ভালোবাসা দেখে। ভালোবাসা আর বন্ধুত্বের যে অনন্য নিদর্শন ফারাজ রেখে গেল, নিঃসন্দেহে তা সারা বিশ্বের কিশোর-তরুণ-মানুষের জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

(কিশোর আলোর আগস্ট ২০১৬ সংখ্যায় প্রকাশিত)