একলাফে পাথরের চাঁইটার ওপর উঠে মোহাম্মদ আশরাফুল সাফ জানিয়ে দিল, ক্রিকেট নয়, ফুটবলটাই আসলে তার বেশি প্রিয়। ক্রিকেটে নাকি তেমন জুত হয় না তার। আশরাফুল আমাদের ক্লাস সিক্সপড়ুয়া গাইড।
ক্রিকেটার না হলেও পাহাড়ের গা বেয়ে উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে যাওয়া নস্যি তার কাছে, বনবাদাড়েও ঘুরে বেড়াতে ভয় পায় না। স্কুলে নিয়মিতই যায়, আর যেদিন স্কুল ছুটি থাকে, সেদিন গাইড হিসেবে ট্যুরিস্টদের ঘুরিয়ে আনে ঝরনা, জঙ্গল আর পাহাড় থেকে। এলাকার সব কটি ঝরনার সব কটি রাস্তা নাকি তার হাতের তালুর মতো চেনা।
এই ছোট্ট টারজানের সঙ্গে আমাদের দেখা নাপিত্তাছড়া ট্রেইল ঘুরতে গিয়ে, নাপিত্তাছড়াপাড়া গ্রামে। গ্রামটা থেকেই ট্রেইলের নামকরণ হয়েছে, নাকি ট্রেইল থেকেই গ্রামের নামটা জুড়ে বসেছে, তা বলা মুশকিল। তবে নামকরণ যা–ই হোক, অনিন্দ্যসুন্দর এই ট্রেইল দেখতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা অতুলনীয়।
প্ল্যানটা হলো একদম হুট করে। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিনই খুব ভোরে বেরিয়ে পড়লাম চার বন্ধু। ভোর ছয়টার ফেনীর বাসে চড়ে বসলাম, যানজটের কারণে পৌঁছাতে সাড়ে ১১টা বেজে গেল। ইতিমধ্যে বাসের যাত্রাবিরতিতে সকালের নাশতা সেরে নিয়েছিলাম সময় বাঁচাতে। তাই ফেনীর মহীপালে বাস থামতেই দৌড়ে উঠে গেলাম চিটাগাংগামী আরেকটা বাসে। সাড়ে ১২টার দিকে বাস আমাদের নামিয়ে দিল সীতাকুণ্ডের আগে নয়দুয়ারবাজার এলাকায়।
যে রকম সময় ঠিক করেছিলাম, তার চেয়ে কিছুটা দেরিতে পৌঁছালেও ভাগ্য ভালো বলতে হবে—এই ভরদুপুরেও কোনো রোদ নেই। আকাশ মেঘে ছেয়ে আছে ভোর থেকেই, গত কয়েক দিনের বৃষ্টির ফলাফল।
নয়দুয়ারবাজারের ভেতর দিয়ে গেলেই নাপিত্তাছড়াপাড়া গ্রাম। আর সেখান থেকে শুরু হয়েছে নাপিত্তাছড়া ঝিরিপথ। বাজারের দোকান থেকে পছন্দসই বাঁশের লাঠি নিয়ে নিলাম চারটি, তখন থেকেই কিছু লোক ডাকাডাকি করছিল গাইড নেওয়ার জন্য। গাইড ছাড়াই এগোলাম। বৃষ্টির জন্য কাদা হয়ে যাওয়া গ্রামের রাস্তা ধরে কিছু দূর এগোলেই একটা রেললাইন পাওয়া যাবে, সেই রেললাইনের থেকে ১৫ মিনিট হেঁটে এগিয়ে গেলেই ঝিরিপথের শুরু।
রেললাইনের সামনেই বেশ কিছু দোকান আর হোটেল আছে, সেখানে আশরাফুলের সঙ্গে প্রথম মোলাকাত। প্রথমেই খুব চড়া একটা দাম চেয়ে বসে কিছুক্ষণ দামাদামি করে সাফ জানিয়ে দিল, এর চেয়ে কমে গেলে তার চলবে না। আমরা ততক্ষণে খাবার হোটেল ঠিক করে ফেলেছি, সেখানেই ব্যাগ রেখে ট্র্যাকিং শেষে ফিরে এসে খাওয়ার জন্য খাবারের অর্ডার দিয়ে যাব। প্রয়োজনীয় ফোন, মানিব্যাগ, ক্যামেরা ইত্যাদি একটা ছোট ব্যাগে নিয়ে নিলাম, ট্র্যাকিংয়ের জুতসই কাপড়ও পরে নিলাম। তখনই নির্বিকার মুখে আশরাফুল এসে জানাল, ‘আচ্ছা, চলেন যাই।’
রেললাইন পেরিয়ে হাঁটা শুরু করলাম পাঁচজনের ছোট্ট দল। আকাশ তখন পরিষ্কার, রোদ নেই, মৃদু বাতাসও আছে। খোলা খেতের মাঝে পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।
একটু সামনেই ঘন সবুজ পাহাড়। আশরাফুলের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে ১৫ থেকে ২০ মিনিট হেঁটে যাওয়ার পর পাহাড়ের একদম কাছে চলে এলাম। একদম নিচে গাছগাছালির সঙ্গে বাঁশ দিয়ে উঁচু বেশ কিছু চারপেয়ে ঘর। জানলাম, এটা মারমা গ্রাম—এটাই নাকি শেষ গ্রাম এই এলাকার। গ্রামের নিচ থেকেই ট্রেইল শুরু হয়ে গেছে, আমরা দৌড়ে নেমে পা ভেজালাম পানিতে, একদল মারমা ছেলেমেয়েও লাফালাফি করছিল সেখানে। ট্রেইলটা পাহাড়ের বাঁকে হারিয়ে গেছে, আমরাও সেই বাঁক ধরে যাত্রা শুরু করলাম পাহাড় আর বনের গহিনে।
ট্রেইল মানে ঝিরিপথ। ঝরনার নিচ থেকে পানি অনেক বছর ধরে বয়ে যেতে যেতে একটা পথের সৃষ্টি করে। কোনো ঝিরিপথের পানি অনুসরণ করে কেউ যদি যেতে থাকে, একসময় না একসময় ঝরনার দেখা মেলেই।
নাপিত্তাছড়ার ঝিরিপথ আমাদের মুগ্ধ করে দিল। পাহাড়ের বাঁক ধরে গহিনে চলে যাওয়া ঝিরিপথটা দেখতে খুবই সুন্দর, মনে হয়, একেবারে বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা। চারপাশে বন, তার মাঝে ঝিঁঝি পোকার একটানা গান আর মাঝেমধ্যে ঝোপের আড়াল থেকে চেনা-অচেনা পাখিদের ডাক ভেসে আসছে। মাথার ওপরে দুই পাশে উঁচু গাছপালা, ঘন সবুজ ডাল আর পাতার ফাঁক দিয়ে আলো ঠিকরে আসছে, পথে আলো–ছায়ার আলতো নকশা কেটে বসেছে। একটু পরপর পথের মাঝে বেখেয়ালে পড়ে উঁচু উঁচু পাথরের চাঁই, কোনোটা মসৃণ, কোনোটা ভেজা, কোনোটার শরীরে আবার শেওলা জেঁকে বসেছে। পায়ের তলায় ঝিরঝির করে বয়ে চলে যাচ্ছে ঠান্ডা ঝরনার পানি, আর পানির নিচে ছোট ছোট নুড়ি পাথর। একদম এক শ ভাগ আদর্শ ঝিরিপথ।
ঝিরিপথের অনেক অংশ কিন্তু খুব পিচ্ছিলও। সাবধান না হলে দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, আমরাও ছোটখাটো আছাড় খেয়েছি বেশ কয়েকবার। প্রায় আধা ঘণ্টা ঝিরি ধরে চলে পাহাড়, বড় বড় বোল্ডার পাথরের উঁচু–নিচু ফাঁক গলে আমরা পৌঁছে গেলাম একটা চওড়া ক্যাসকেডের সামনে, ক্যাসকেডটার গা বেয়ে ঝিরঝির করে পানি ঝড়ছে, আর নিচে জলাধারের মতো জমে আছে পানি। এই ক্যাসকেডটার নাম টিপরা খুম। ক্যাসকেড হলো ঝরনার ধাপ, আর বম ভাষার শব্দ ‘খুম’ অর্থ ঝরনার যে স্থানে প্রাকৃতিকভাবে পানি জমে জলাধারের সৃষ্টি করে, সারা বছরই সেখানে পানি থাকেই। ক্যাসকেডটার বাঁ পাশ দিয়ে খাড়া পাহাড়ের অংশ বেয়ে উঠে যেতেই দেখা মিলল কুপিকাটাখুম ঝরনার—এই ট্রেইলের প্রথম ঝরনার।
এই কুপিকাটা ঝরনার ডান পাশ দিয়েই প্রায় খাড়া একটা পাহাড়ের ঢাল, এটা বেয়েই পাহাড়ের আরও উঁচুতে উঠতে হবে—এ জায়গাটা তুলনামূলক কঠিন। মিনিটখানেক জিরিয়ে নিয়ে আমরা বেয়ে ওঠা শুরু করলাম, উঁচু পাহাড়ের গায়ের মাটি পিচ্ছিল হয়ে কাদা হয়ে গিয়েছিল। ফলে পাহাড়ের গায়ে গজিয়ে ওঠা গাছের ডালপালা ধরে টেনে উঠলাম আমরা।
এর পরের যাত্রা হলো পাহাড়ের ধারের খাঁজ বেয়ে আরও উঁচুতে ওঠার। বৃষ্টির জন্য অনেক বেশি ছিল সে অংশে, তাই সাবধানে যেতে হয়েছে। কারণ, সেই পথের এক পাশে পাহাড় আর অন্য পাশে খাদ। পাহাড়টা পেরিয়ে নিচে নেমে এলে আবার শুরু ঝিরিপথের।
এই ঝিরিটা আগের ঝিরিপথের চেয়ে আলাদা, বেশি নীরব, সুনসান। পায়ের নিচ দিয়ে পানিও যেন বয়ে যাচ্ছে প্রায় নিঃশব্দে। দুই পাশের জঙ্গলের গাছগুলো মাথার ওপর ছাতার মতো নুয়ে এসেছে, তাই একটু পরপরই শীতল অন্ধকার ছায়া পড়ে আছে। সেই পথ ধরে কিছু দূর যেতেই একটা চত্বরের মতো জায়গা এসে পড়ল, সেখান থেকে দুদিকে দুটি রাস্তা চলে গেছে। এই দুটি রাস্তার শেষেই দুটি ঝরনার দেখা মিলবে।
আশরাফুলের পরামর্শে আমরা প্রথমে রওনা দিলাম বান্দরখুম ঝরনার দিকে। এবার যাত্রাপথে আছাড় খাওয়া ছাড়াও আরেক সমস্যা যোগ দিল, জোঁক। জোঁককে তেমন কেউই ভয় পাই না, তবে অস্বস্তি লাগে কিছুটা। এই যাত্রায় সবার গায়েই একটা না একটা জোঁক খুঁজে পাওয়া গেল, দুজন তো আবার ডাবল স্কোর করে বসল। জোঁক ছুটিয়ে ২০-২৫ মিনিট উঁচু–নিচু পাথর বেয়ে দেখা মিলল বান্দরখুম ঝরনার। ঝরনাটা আকৃতিতে বিশাল, অনেক উঁচু থেকে পানির ধারা নামতে নামতে মাঝপথে বেঁকে গেছে। বর্ষার মৌসুমে ধারাটা কী বিশাল রূপ ধারণ করে, দেখেই বোঝা যায়।
কিছুক্ষণ বান্দরখুমে থেকে রওনা দিলাম উল্টো দিকে। এবার অন্য পথটায় যাব, শেষ ঝরনাটা দেখার জন্য।
এতক্ষণে বেশ কয়েকবার ব্যাগ বদল হয়ে গেছে, চারজনে পালা করে ব্যাগটা বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। এবার যাত্রা আরও নিস্তব্ধ, আরও নিঝুম। ঝিঁঝির ডাকও থেমে গেছে। একেই হয়তো বলে ‘সাউন্ড অব সাইলেন্স’। পুরো ট্রেইলটাতে শুধু আমরাই আছি, আর কোনো দল আসেওনি আজ ওদিকে। কোনো কথা না বলে একমনে হেঁটে যাচ্ছি, বড় বড় বোল্ডার পাড়ি দিয়ে, ঝিরিপথ ধরে। একমনে অনেক্ষণ এগিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ দেখলাম গাছপালাগুলো আরও ঘন হয়ে আসছে, কখন যে সেই চত্বরটা পার হয়ে চলে এসেছি, খেয়াল নেই। আঁকাবাঁকা পাহাড় আর পাথরের ফাঁক গলে এগিয়ে একটা উঁচু জায়গা দেখলাম, সেটায় বেয়ে উঠতেই মুগ্ধতা বেড়ে গেল কয়েক গুণ।
চোখের সামনে বাঘবিয়ানি ঝরনা। দুই পাশে প্রায় আকাশসমান উঁচু পাহাড়, তার শেওলা ধরা কালো পাথরের ওপর আছড়ে পড়ছে কলকল করে; একটানা, বিরতিহীন। নিচে পানি জমে সৃষ্টি হয়েছে খুম। এত দূর হেঁটে আসার যে ক্লান্তি, ঝরনা দেখে একনিমেষে উবে গেল সেটা। টি–শার্ট না খুলেই নেমে পড়লাম পানিতে। এমনকি এতক্ষণ ধরে যে ব্যাগে করে পানি বয়ে নিয়ে আসা, সেই পানি খাওয়ার কথাও মাথায় নেই কারও। কনকনে ঠান্ডা ঝরনার পানি, একদম হাড়ে কাঁপুনি ধরিয়ে দিল। দাঁতে বাড়ি খেতে খেতে এগিয়ে গেলাম ঝরনার দিকে, টের পেলাম, সে দিকটায় মাটি হঠাৎ করেই নিচে নেমে গেছে অর্থাৎ পানি বেশ ভালোই। আশরাফুল কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আমাদের দেখছিল, সাবধান করে দিল ঝরনার দেয়ালে গা না লাগাতে, সেখানে নাকি প্রচুর জোঁক। বলাই বাহুল্য, আমাদের তখন আর সেদিকে খেয়াল নেই, ঝরনার পানিতে মেতে উঠেছি।
প্রায় এক ঘণ্টা পর নিতান্ত অনিচ্ছায় উঠে আসতে হলো, ফেরার জোগাড়যন্ত্র করা শুরু করলাম। ভেজা কাপড় বদলে মাথা মুছে নিলাম। খেয়াল হলো, শখের হারমোনিকাটা নিয়ে এসেছিলাম সঙ্গে করে। অর্ণব আর অঞ্জনের কয়েকটা গানের সুর তুলতে তুলতে আরও কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে রওনা দিলাম ফিরতি পথে। দুপুর প্রায় শেষের পথে, সবাই একসঙ্গে গলা মিলিয়ে হেঁড়ে গলায় গান গাইতে গাইতে পুরো ট্রেইলটা পার করে ফিরে এলাম সমতলে, সেই মারমাপাড়ার কাছে। রেললাইনের পাশে খাবার হোটেলে পৌঁছাতে প্রায় সোয়া চারটা, সেখানে আরেক দফা ফ্রেশ হয়ে আশরাফুলকে সঙ্গে নিয়ে খেতে বসলাম। হোটেলের আলুভর্তা, মুরগি আর ডাল দিয়ে ভাত খেতে তখন রীতিমতো অমৃত লাগছিল, বোনাস হিসেবে হোটেলের ছোট টিভিতে চলছিল রিয়াজের বাংলা সিনেমা।
খাবার শেষে আশরাফুলের পাওনা মিটিয়ে বিদায় নিলাম নাপিত্তাছড়াপাড়া থেকে। নয়দুয়ারিবাজার পর্যন্ত হেঁটে এসে হাইওয়ে থেকে টেম্পো ধরে বড়তাকিয়ার বাস কাউন্টারে নেমে পড়লাম। সারা দিনের ধকলে ভীষণ ক্লান্ত একটা শরীর আর ঝরঝরে সতেজ একটা মন নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার বাসে ফিরতি যাত্রা শুরু করলাম ঢাকার উদ্দেশে। বন, পাহাড়, ঝরনা, বৃষ্টি ফেলে ঢাকায় ফিরতে একটু খারাপই লাগছিল। মনকে বোঝালাম, আবার হারাব সবুজের মাঝে।