শব্দের অর্থ চিরকাল এক রকম বা একটাই থাকে না। শব্দ ও তার অর্থের সম্পর্ক চিরস্থায়ী নয়। বহু শব্দ তার মূল অর্থ পরিত্যাগ করে সম্পূর্ণ নতুন অর্থ নিয়ে দেখা দেয়। একটি ভাষার শব্দভান্ডারে জমা হওয়া বিদেশি শব্দও যে ঠিকঠাক থাকে, তা নয়। সেসব শব্দেরও পরিবর্তন ঘটে যায়। বদলায় তার অবয়বও। যেমন ইংরেজি জেনারেল বাংলায় হয়ে যায় জাঁদরেল। কিংবা গার্ড হয়ে যায় গারদ। ভাষার সঙ্গে সম্বন্ধ মানুষের মনের। মানুষের মনের বিচিত্র মতিগতির কারণে শব্দ তার মূল অর্থ ছেড়ে দিয়ে নতুন অর্থ ধারণ করে। অর্থাৎ শব্দ তার অর্থ বদলায়। তবে শুধু মানুষের মন নয়, সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণেও শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে পারে। ‘অভিধানের গল্প’তে শব্দের অর্থ পরিবর্তনের নানা ঘটনা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় এবং তা যে বাংলা শব্দভান্ডারের শব্দ, তা বলা বাহুল্যমাত্র।
কিংবদন্তি
একাধিক অর্থ নেই, ভাষায় এমন শব্দ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিংবদন্তি শব্দের বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। কিংবদন্তি শব্দের মূল অর্থ হলো জনশ্রুতি। আর পাশাপাশি অন্য অর্থ হলো গুজব, লোকের মুখে মুখে ফেরা সত্য-অসত্য অপবাদ। কোনো কোনো অভিধানে বলা হয়েছে ইতিহাসের স্মৃতি যখন ধূসর হয়ে যায়, তখন তা পরিণত হয় কিংবদন্তিতে।
মোটকথা কিংবদন্তি সাম্প্রতিক কোনো ঘটনা বা বিষয় নয়। অনেক অনেক দূরের ঘটনা।
কিংবদন্তি শব্দের ব্যাকরণের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হলো, লোকেরা কী বলে বা বলাবলি করে। এর সঙ্গে অবশ্য অভিধানে দেওয়া প্রতিটি অর্থেরই মিল পাওয়া যায়।
কিংবদন্তি শব্দটি বিশেষ্য পদ। সম্প্রতি শব্দটিকে অদ্ভুতভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যেমন কিংবদন্তি কথাসাহিত্যিক, কিংবদন্তি শিল্পী ইত্যাদি। অথচ শব্দটির ব্যবহার হওয়া উচিত ছিল কিংবদন্তিতুল্য শিল্পী, কিংবদন্তিতুল্য অভিনেতা ইত্যাদি।
শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিটি ভাষার নিজস্ব রীতি বা ভঙ্গি থাকে। এই রীতি বা ভঙ্গির পরিবর্তন হয় না। ভাষার ভঙ্গিকে জানতে হয়, অনুভব করতে হয়। নইলে শব্দ ও শব্দের অর্থ চেনা যায় না।
শুনেছি ইংরেজি লেজেন্ড শব্দটার বাংলা হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে কিংবদন্তি শব্দকে। লেজেন্ড শব্দের আগে লিভিং শব্দটা বসে তৈরি হয় লিভিং লেজেন্ড। এ থেকে বাংলায় ইদানীং জীবন্ত কিংবদন্তি বলে অদ্ভুত এক বাক্যাংশও তৈরি হয়েছে।
ইংরেজরা আর যা–ই করুক, তারা তাদের ব্যাকরণকে শ্রদ্ধা করে, মেনে চলে। তারা কখনোই বলে না লেজেন্ড অ্যাকটর, লেজেন্ড রাইটার; তারা বলে লেজেন্ডারি অ্যাকটর বা রাইটার। তারা জানে, বিশেষ্য পদের আগে বিশেষণ বসে। কখনোই বিশেষ্য নয়। তাই লেজেন্ড থেকে লেজেন্ডারি।
বাঙালিও জানে। তবু কেন জানি না একটা বিশেষ্য পদের আগে আরেকটা বিশেষ্য পদ বসিয়ে মানুষ কী আনন্দ পায়! কিংবদন্তি শিল্পী বললে ব্যাকরণ বিনষ্ট হয়। বিকৃত ভাষায় শিল্পীকেও কি শ্রদ্ধা জানানো যায়?
জলজ্যান্ত
শব্দের অর্থের কালে কালে কত যে বিচিত্র পরিবর্তন ঘটতে পারে, তার জলজ্যান্ত উদাহরণ, জলজ্যান্ত শব্দটা নিজেই।
জলজ্যান্ত দিয়ে বাংলায় শব্দ অনেক—জলজ্যান্ত সত্য, জলজ্যান্ত মিথ্যা, জলজ্যান্ত প্রমাণ, জলজ্যান্ত মানুষ, জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত ইত্যাদি আরও কত কী!
জলজ্যান্ত শব্দের সাধারণ অর্থ অত্যন্ত স্পষ্ট, জীবন্ত ও প্রত্যক্ষ, বিশুদ্ধ, খাঁটি, ডাহা ইত্যাদি। ডাহা শব্দটাতেও তোমাদের খটকা লাগতে পারে—শব্দটা বসে মিথ্যা শব্দের আগে, যেমন ডাহা মিথ্যা কথা। জলজ্যান্ত মিথ্যা মানে ডাহা মিথ্যা।
জলজ্যান্ত শব্দের ব্যুৎপত্তি একেবারে সহজ–সরল। জলে জিয়ানো মাছের মতো সজীব—যা সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, তা-ই হলো জলে জিয়ন্ত বা জলজ্যান্ত।
বিশদ
বিশদ তৎসম শব্দ। কোনো বিষয়ের বিশদ ব্যাখ্যা বা বিশদ বিবরণ দেওয়া ছাড়া বাংলা ভাষায় বিশদ শব্দটির তেমন কোনো ভূমিকা নেই। সংস্কৃত থেকে বাংলা ভাষায় আসার পর শব্দটির দুর্গতির অন্ত নেই। সংস্কৃত ভাষার একটি অর্থও শব্দটি বাংলা ভাষায় আনতে পারেনি। সংস্কৃত ভাষায় শব্দটির নানা অর্থ, যেমন শুক্ল, ধবল, সাদা, মেঘমুক্ত, নিষ্কলঙ্ক ইত্যাদি। শত চেষ্টা করলেও কোনো বাঙালির কলমে বিশদ বস্ত্র, বিশদ আকাশ, বিশদ চরিত্র ইত্যাদি অদ্ভুত বাংলা কোনো দিনই আসবে না।
বাংলা ভাষায় এসে বিশদ শব্দের অবনতি—এমন দুর্ভাগ্য খুব কম শব্দের বেলাতেই ঘটেছে। শব্দের অর্থের এ রকম দুর্গতি দেখে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শব্দের মতিগতি বুঝে ওঠা বেশ মুশকিল।
বিভ্রম
মানুষের নানা রকমের বিভ্রম হয়, যেমন চিত্তবিভ্রম, দৃষ্টিবিভ্রম ইত্যাদি। বিভ্রমকে বলা যেতে পারে বিশিষ্ট ভ্রম।
এই ভ্রমগুলো দেখা যায় শুধু বাংলা ভাষায়। কিন্তু শব্দটির মূল যে সংস্কৃত ভাষা, সেখানে বিভ্রমের একেবারে ভিন্ন চেহারা। বিভ্রমের অর্থ অনেকগুলো। এর মধ্যে একে একে পড়ে ভ্রমণ, পর্যটন, ঘূর্ণন ইত্যাদি।
বিভ্রম শব্দের আরও যেসব অর্থ, তা তোমাদের জন্য উপস্থাপন করা গেল না। তোমরা অনেক বড় হলে বলতে পারতাম।
বিভ্রম যখন বাংলা ভাষায় আসে, তখন শুধু চোখের ভুল, মনের ভুল ইত্যাদি অর্থেই নয়, বিভ্রম একসময় সম্ভ্রমহীনতা, অপমান অর্থেও ব্যবহৃত হতো।
প্রশস্ত
তৎসম শব্দটি বাংলায় এসে তার তাবৎ অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। চওড়া, আয়ত, উদার—এসব অর্থেই প্রশস্ত শব্দটি বাংলায় ব্যবহৃত হয়। আমাদের লিখিত ভাষায় তৎসম শব্দের অযথা আধিক্য। ফলে রাস্তা চওড়া করার পরিবর্তে আমরা পাই রাস্তা প্রশস্তকরণ বা করা। চওড়া কপালের পরিবর্তে পাই প্রশস্ত ললাট। একইভাবে উদার হৃদয়ের জায়গায় পাই প্রশস্ত হৃদয়।
প্রশস্ত শব্দটি বিশেষণ। মূল সংস্কৃত ভাষায় শব্দটির অর্থ প্রশংসনীয়, নিরুপদ্রব, শুভ, দক্ষ, শ্রেষ্ঠ, উপযুক্ত, প্রসিদ্ধ ইত্যাদি। বাংলায় এর কোনোটারই ব্যবহার নেই। শব্দটি যখন বিশেষ্য পদে রূপান্তরিত হয়, তখন আবার সংস্কৃত শব্দের সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রশস্ত শব্দের বিশেষ্য রূপ প্রশস্তি, এ শব্দটার অর্থ প্রশংসা করা, গুণকীর্তন করা, কারও প্রশংসার জন্য রচিত কবিতা ইত্যাদি।