বৃষ্টিতে ভিজতে আমাদের সবারই কমবেশি ভালো লাগে। ষড়্ঋতুর এই দেশে বছরের অনেক সময় মাঝারি রকমের বৃষ্টি হয়। দিনে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলে গ্রামের আবহাওয়ায় আরাম হলেও শহরের রাস্তায় পানি জমে জনজীবনে নেমে আসে দুর্ভোগ। অসহ্য গরমের দিনে এমন বৃষ্টি আমাদের স্বস্তি দিলেও, স্বাভাবিক জীবনব্যবস্থায় সমস্যা তৈরি করে।
কিন্তু যদি এই বৃষ্টি মাত্র কয়েক ঘণ্টা নয়, দিনব্যাপী হয়? আর সেটা যদি চলে বছরজুড়ে? এমন অঝোর বৃষ্টিতে কেমন হবে আমাদের জীবনযাত্রা? এভাবে চিন্তা করলে শুরুতে অবশ্য অনেকেরই মনে হবে যে ভালোই হবে তাহলে। প্রতিদিন খিচুড়ি-মাংসের স্বাদ উপভোগ করা যাবে। কিংবা আলো নিভিয়ে উপভোগ করা যাবে আষাঢ়ে কোনো গল্প। শুধু মানুষ নয়, পুরো পৃথিবীতে প্রাণের টিকে থাকার জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন। গাছপালা থেকে শুরু করে কীটপতঙ্গেরও বেঁচে থাকার জন্য বৃষ্টির প্রয়োজন হয়। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি থেকে শুরু করে ফসল উৎপাদনে আমাদের বিপুল পরিমাণ পানির প্রয়োজন হয়। কিন্তু খুব ভালো কিছুও অধিক পরিমাণে ভালো নয়। এমনটা হলে সব সময় স্বাভাবিক পরিস্থিতি ব্যাহত হয়।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্র প্রতিনিয়ত বদলাচ্ছে। এভাবে অতিবৃষ্টির মাত্রা গোটা পৃথিবীতেই বাড়ছে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অব স্ক্যাচওয়াইনের একদল গবেষক বলেন, গত দশকে সারা পৃথিবীতে বৃষ্টির পরিমাণ বেড়েছে গড়ে ৭ শতাংশ। ইউরোপ আর এশিয়া অঞ্চলের ক্ষেত্রে এই মান ৮ দশমিক ৬ শতাংশ। ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় প্রাণ হারিয়েছে ৫ লাখ মানুষ। তাই বোঝাই যাচ্ছে, সারা বছর এমন বৃষ্টিপাত হলে তা আমাদের জন্য ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করবে।
কিন্তু এভাবে সারা পৃথিবীতেই বৃষ্টিপাত বাড়ছে কেন? কখনো চিন্তা করেছ, আকাশজুড়ে কী পরিমাণ ঘনীভূত মেঘ, মানে পানি জমা আছে? এই সংখ্যা নেহাত তোমার কল্পনারও বাইরে। গোটা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রায় ৩৭ দশমিক ৫ মিলিয়ন বিলিয়ন গ্যালন পরিমাণ পানি ভাসছে। এত মেঘ যদি একসঙ্গে বৃষ্টি হয়ে নামে, তাহলে পুরো পৃথিবী প্রায় ১ ইঞ্চি গভীর পানিতে ডুবে যাবে।
টানা এমন বৃষ্টিতে যে ভয়াবহ বন্যা হবে, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। তুমি যদি সমুদ্রের পাড়ে ছুটি কাটাতে যেতে ভালোবাস, তাহলে সেই পথও কিন্তু বন্ধ হয়ে যাবে। কেননা, এত পানির কারণে সমুদ্রের পাড়ে কোনো দ্বীপ থাকবে না। সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়ার ফলে নেদারল্যান্ডস ও জাপানের মতো রকম নিম্নভূমির দেশগুলো পানির নিচে দ্রুত তলিয়ে যাবে। সাধারণত বন্যার সময় মানুষকে উঁচু মাটির অঞ্চলে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু বৃষ্টির কারণে সেটিও সম্ভব হবে না। বরং পানির তীব্র স্রোতের কারণে উঁচু এলাকার মাটিও ধসে যেতে থাকবে। তাই সেই সব এলাকাও তখন আর নিরাপদ থাকবে না।
চারদিকের এত বাজে পরিস্থিতিতে তোমার শরীরও কিন্তু খারাপ করতে শুরু করবে। তুমি হয়তো ভাবছ, এত বৃষ্টি হলে আমরা আরও বেশি পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি পাব পান করার জন্য। কিন্তু চারদিকের মাটি থেকে আরও বেশি দূষিত পদার্থ মিশে যাবে পানিতে। তাই খাওয়ার পানি সংগ্রহে আরও বেশি ধকল পোহাতে হবে সবাইকে। ফলে পানিবাহিত রোগের প্রকোপ বাড়বে। অধিক বৃষ্টির কারণে আকাশে মেঘ জমে সূর্য দেখা যাবে না। সূর্যের আলোর কারণে আমাদের ত্বকের নিচে ভিটামিন ডি তৈরি হয়। বৃষ্টির কারণে সূর্যের আলো না থাকলে আমরা সহজে ভিটামিন ডি পাব না, যা আমাদের শরীরের জন্য ভয়ংকর সমস্যা সৃষ্টি করবে। শরীর ঠিক রাখতে তখন আমাদের কৃত্রিম ভিটামিন ডি–এর ক্যাপসুল নিতে হবে। তবে সূর্যের আলো না পাওয়ার জন্য মানুষ ধীরে ধীরে ডিপ্রেশনে ভুগতে থাকবে।
চারদিকে পরিবেশবিপর্যয়, সবাই অসুস্থ—ভারী বৃষ্টিতে এমন পরিস্থিতির কথা তুমি চিন্তা করলেও আমি বাজি ধরে বলতে পারি, তুমি কখনোই ভাবোনি যে বেশি বৃষ্টিতে আমাদের শ্বাস নিতেও সমস্যা হবে। বৃষ্টিতে যেহেতু মাটি নরম হয়ে যাবে, তাই দীর্ঘ সময় কোনো গাছ বেঁচে থাকতে পারবে না। গাছের সংখ্যা কমতে থাকলে ধীরে ধীরে বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকবে। এমন অবস্থায় সাধারণ গাছপালার পাশাপাশি ফলের গাছ, আমাদের খাদ্যশস্য—সবকিছুই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই খাবার উৎপাদন থেকে শুরু করে শ্বাস নেওয়া—সব অবস্থাতেই জটিলতা তৈরি করবে এই অতিবৃষ্টি।
এত পরিমাণে বৃষ্টি হলে আমাদের কী করার আছে? পুরো পৃথিবীতে এখনো এত পরিমাণে বৃষ্টি না হলেও কিছু অঞ্চলে কিন্তু সারা বছরই বৃষ্টি হয়। ভারতের মেঘালয় রাজ্যে প্রতিবছর গড়ে ১২ মিটার বৃষ্টিপাত হয়। ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের কাছাকাছি এলাকা হওয়ায় এই এলাকার বাতাসে প্রচুর অক্সিজেন থাকে। এমন এলাকাতেও মানুষ কয়েক শ বছর ধরে বসবাস করছে। এমন এলাকায় খাল ও নদী পার হওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয় রাবার ট্রি দিয়ে বানানো বিশেষ সাঁকো। এগুলো অতিবৃষ্টিতেও নষ্ট হয় না। একটি সাঁকো ৫০০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যায়। তাই এমন ভারী বৃষ্টিতেও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে, এমন আশা আমরা করতেই পারি।
তবে আশ্চর্যজনকভাবে সারা পৃথিবীতেই এমন ভারী বৃষ্টির এলাকাগুলো থেকে পানির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং, অর্থাৎ বৈশ্বিক জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণেই এমনটা ঘটছে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এ বিপর্যয়ের কারণে সারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুতেই ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।