কৈশোরে যেমন ছিলেন বঙ্গবন্ধু
ছবির মতো একটি গ্রাম। গ্রামের নাম টুঙ্গিপাড়া। জেলা গোপালগঞ্জ। তখন গোপালগঞ্জ ছিল ফরিদপুর জেলার একটি মহকুমা। মধুমতী নদীর তীরে। মধুমতীর অনেক শাখা। তেমন এক শাখার নাম বাইগার নদী। টুঙ্গিপাড়া এই নদীর ধারে। গভীর মমতায় গ্রাম ছুঁয়ে বয়ে গেছে। মধুমতীতে গিয়ে মিশেছে।
নদীর দুই তীরে কত গাছপালা! হিজল বরুণ তাল তমাল। কত বুনোফুলের ঝোপ! বাঁশবন ছায়া ফেলে রেখেছে নদীর পানিতে। চারদিকে সবুজ আর সবুজ। নদীতে অনেক নৌকার চলাচল। হালে বসা মাঝি দরাজ গলায় ভাটিয়ালি গায়। গাছে গাছে ডাকে পাখিরা। হাওয়ায় ভাসে ফুলের গন্ধ। নদী বয়ে যায় কুলকুল শব্দে।
প্রায় ২০০ বছর আগে মধুমতী বয়ে যেত টুঙ্গিপাড়া ঘেঁষে। নদীর তীরেই গড়ে উঠেছিল বসতি। ধীরে ধীরে সরে গেছে নদী। চর জাগার পর নতুন নতুন গ্রাম হয়েছে। স্নিগ্ধ সুন্দর নিরিবিলি পরিবেশ। যাতায়াত করতে হতো নৌকায়। এই টুঙ্গিপাড়ায় জন্মেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, বাঙালি জাতির মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
২
দরবেশ শেখ আউয়াল ছিলেন ইরাকের লোক। এ দেশে এসেছিলেন পবিত্র ইসলাম ধর্মের প্রচারক হিসেবে। প্রায় ৫০০ বছর আগের কথা। তাঁর বংশধর শেখ বোরহানউদ্দিন টুঙ্গিপাড়ার শেখ বংশের গোড়াপত্তন করেন। এই বংশের শেখ আবদুল হামিদ হচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর দাদা। তাঁর পুত্র শেখ লুত্ফর রহমান বঙ্গবন্ধুর পিতা।
শেখ আবদুল হামিদের সময় থেকে এই পরিবারে ইংরেজি লেখাপড়া শুরু হয়। শেখ আবদুল হামিদ হঠাৎই মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর বড় ছেলেও মারা যান। তখন সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে শেখ লুত্ফর রহমানের ওপর। তিনি তখন এন্ট্রান্স পড়েন। লেখাপড়া ছেড়ে চাকরিতে ঢুকলেন। দেওয়ানি আদালতে সেরেস্তাদার হলেন।
শেখ আবদুল হামিদের বড় ভাই শেখ আবদুল মজিদের কোনো ছেলে ছিল না। ছিল চার মেয়ে। শেখ লুত্ফর রহমানের সঙ্গে তাঁর ছোট মেয়ের বিয়ে দেন। সেই মেয়ে সায়েরা খাতুনকে তাঁর সব সম্পত্তি লিখে দেন।
এই দম্পতির ঘরে জন্মান বঙ্গবন্ধু। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। দিনটি ছিল বুধবার।
টুঙ্গিপাড়ার শেখ বাড়ি ছিল বিশাল। ২০০ বছর আগে তৈরি হয়েছিল বড় বড় চারটি দালান। কলকাতা থেকে মিস্ত্রিরা এসে শুরু করেছিলেন বাড়ির কাজ। শেষ হয়েছিল ১৮৫৪ সালে। দিনে দিনে ক্ষয়ে যায় দালানগুলো। ধসে পড়ে। সেগুলোতে আর বসবাস করা যেত না। এসব দালানের পাশেই টিনের ঘর করা হয়েছিল। সে রকম এক ঘরেই জন্মান বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুর নানা শেখ আবদুল মজিদ আকিকার সময় তাঁর নাম রাখলেন শেখ মুজিবুর রহমান। মেয়েকে বললেন, ‘মা সায়েরা, তোর ছেলের এমন নাম রাখলাম যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’
এই নাম সত্যি সত্যি জগৎজোড়া খ্যাত হয়েছে। তিনি মিশে আছেন আমাদের রক্তে। আমাদের অন্তর আলোকিত হয়ে আছে তাঁর আদর্শে।
মা–বাবা বঙ্গবন্ধুকে ডাকতেন ‘খোকা’ নামে।
৩
শেখ লুত্ফর রহমানের সংসারে জন্মান চার মেয়ে ও দুই ছেলে। দুই মেয়ের পর প্রথম পুত্র শেখ মুজিবুর রহমান। তারপর আরও দুই মেয়ে ও এক ছেলে। মা–বাবার প্রথম পুত্র মুজিব হয়ে উঠলেন পরিবারের নয়নের মণি।
মুজিবের শৈশব কেটেছে পরিবারের প্রত্যেক মানুষের গভীর ভালোবাসায়। মা–বাবা, ভাই–বোন সবাই তাঁকে ভালোবাসেন। স্নেহ–মমতা–আদরে ভরিয়ে রাখেন। বিশাল শেখ পরিবারের সবাই খোকা বলতে অজ্ঞান।
শৈশবের দিনগুলো কত না আনন্দে কাটতে লাগল! গ্রামের মেঠোপথের ধুলো মেখে, বর্ষার বৃষ্টিতে ভিজে, শীতের কুয়াশায় পায়ে শিশির মেখে, হেমন্তের নীল আকাশের তলায়, ফসলের মাঠে ঘুরে ঘুরে বড় হতে লাগলেন মুজিব। বাইগার নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আর সাঁতার কেটে দিন কেটে যায়। তালগাছে বাসা বেঁধেছে বাবুই পাখি। কী অপূর্ব দক্ষতায় পাখিগুলো তৈরি করে তাদের বাসা! মাছরাঙা বসে থাকে খাল, পুকুর বা নদীর ধারের গাছপালায়। হঠাৎই ঝাঁপ দিয়ে পড়ে পানিতে। ডুব দিয়ে ধরে আনে মাছ। মুজিব মাছরাঙা পাখি খেয়াল করেন। ভোরবেলার দোয়েল পাখির ডাক তাঁকে মুগ্ধ করে। বাংলার প্রকৃতি তাঁকে আকৃষ্ট করে। এই দেশটি তাঁর অন্তরের সবখানি জায়গা দখল করে সেই শৈশবেই।
একদিন কোথা থেকে একটা শালিক পাখির ছানা ধরে আনলেন। আরেক দিন আনলেন একটা ময়না পাখির ছানা। অতিযত্নে ছানা দুটিকে খাওয়ান। তারপর বানর ও কুকুর পুষতে লাগলেন। এই প্রাণী দুটি এত ভক্ত হলো তাঁর, তিনি যা বলেন তা–ই করে। যতক্ষণ বাড়িতে থাকেন, ততক্ষণ বানর আর কুকুর আছে তাঁর সঙ্গে। শালিক পাখির ছানা আর ময়না পাখির ছানা কথা বলতে শিখেছে। শিস দিতে শিখেছে। এসব পোষা পাখি আর জীবজন্তুর প্রতি অপরিসীম মমতা তাঁর। এদের কেউ অবহেলা করলে তা সহ্য করতে পারতেন না।
শেখবাড়ির দক্ষিণ–পশ্চিম দিক ঘেঁষে সরু একটা খাল। খালের পাড়েই শেখবাড়ির কাচারিঘর। কাচারিঘরের পাশে মাস্টার, পণ্ডিতমশাই আর মৌলভি সাহেবদের থাকার ঘর। তাঁরা তিনজনই গৃহশিক্ষক। এই শিক্ষকদের কাছে মুজিব বাংলা, ইংরেজি, অঙ্ক ও আরবি শিখতে লাগলেন।
বাড়ি থেকে মাইলখানেক দূরে গিমাডাঙ্গা প্রাইমারি স্কুল। মুজিবকে এই স্কুলে ভর্তি করা হলো। ক্লাস থ্রি পর্যন্ত তিনি এই স্কুলে পড়াশোনা করেন। বর্ষাকালে নৌকায় করে স্কুলে যেতে হয়। একদিন ছুটির পর বাড়ি ফিরছেন। নৌকা খালে ডুবে গেল। মুজিব পানিতে পড়ে গেলেন। ঘটনা শুনে মা খুবই ভয় পেলেন। কিছুতেই তিনি তাঁর ছেলেকে আর ওই স্কুলে পাঠালেন না।
শেখ লুত্ফর রহমান তখন গোপালগঞ্জ শহরে চাকরি করছেন। মুজিব চলে গেলেন আব্বার কাছে। ক্লাস ফোরে ভর্তি হলেন গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে। মা শহরে গিয়ে থাকতেন না। কারণ, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি তিনি দেখাশোনা করতেন।
মুজিবের দাদা ও নানার ঘর পাশাপাশি। মা, ভাইবোনের সঙ্গে নানার ঘরেই থাকতেন তিনি। গোপালগঞ্জে গিয়ে আব্বার কাছে থাকেন। লেখাপড়া করেন। আব্বার গলা ধরে ঘুমান। মা যেমন ভালোবাসেন, আব্বাও তেমনই ভালোবাসেন।
গোপালগঞ্জে পড়াশোনা চলছে। মাঝখানে একবার মাদারীপুরে বদলি হলেন আব্বা। কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরে গিয়েও লেখাপড়া করতে হলো। পরে আবার ফিরে এলেন গোপালগঞ্জে। এখানেই কাটতে লাগল তাঁর কিশোরবেলা।
মুজিব ছিলেন খুব রোগা। মা সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কীভাবে তাঁর শরীর ভালো করা যায়। বড় বোনেরা ব্যস্ত থাকতেন। খেয়াল রাখতেন ভাইয়ের দিকে। ভাইবোনেরা তাঁকে ডাকতেন ‘মিয়াভাই’ বলে। তাঁদের দেখাদেখি গ্রামের মানুষজনের কাছেও তিনি ‘মিয়াভাই’ হয়ে গেলেন। সেই বয়সেই গ্রামের মানুষদের সঙ্গে সহজভাবে মেলামেশা করতেন। গ্রামের এবাড়ি–ওবাড়ি যাচ্ছেন। প্রত্যেকের খবর নিচ্ছেন। বেশ একধরনের ব্যস্ততা।
এদিকে মায়ের ব্যস্ততা তাঁর খোকাকে নিয়ে। খোকার শরীর কীভাবে ভালো রাখা যায়? দুধের গ্লাস নিয়ে ছেলের পেছনে ছুটছেন। ঘরে তৈরি হচ্ছে ছানা, মাখন, ঘি। সময়মতো ছেলেকে সেসব খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। বাগানের ফল আর নদীর তাজা মাছ হাতের কাছে রাখা হচ্ছে। তারপরও খোকার স্বাস্থ্য ভালো হয় না। ছিপছিপে পাতলা শরীর। এই নিয়ে মায়ের আফসোসের সীমা নেই।
বাড়ির এত ভালো ভালো খাবারের দিকে মোটেই নজর ছিল না মুজিবের। তিনি পছন্দ করেন ভাত আর মাছের ঝোল। পছন্দ করেন ডাল আর সবজি। খুবই সাধারণ খাবার। তবে সবশেষে দুধভাত, কলা ও গুড় থাকতে হবে।
ছোটবেলা থেকে মুজিব অত্যন্ত হৃদয়বান। মানুষের দুঃখকষ্ট সহ্য করতে পারতেন না। গভীর মমতা মানুষের জন্য। তখনকার দিনে পড়াশোনার এত সুযোগ ছিল না। বেশির ভাগ মানুষই ছিল গরিব। একটু সচ্ছল গৃহস্থবাড়িতে জায়গির থেকে পড়াশোনা করত। চার–পাঁচ মাইল দূরে স্কুল। সকালে ভাত খেয়ে হেঁটে যেতে হতো। সারা দিনে আর খাওয়া নেই। স্কুল ছুটির পর আবার এতটা পথ হেঁটে ফেরা। স্কুল থেকে ফেরার পর এসব ছেলেকে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে আসতেন তিনি। বাড়ি ফিরেই দুধভাত খাওয়ার অভ্যাস ছিল। সেই খাবার সবাইকে নিয়েই খেতেন।
প্রতি মাসেই মুজিবের জন্য বেশ কয়েকটি ছাতা কিনতে হতো। কারণ কী?
দেখা গেল কোনো গরিব ছেলে ছাতা কিনতে পারছে না। চার–পাঁচ মাইল পথ ঠা ঠা রোদের ভেতর দিয়ে হেঁটে যেতে হচ্ছে স্কুলে। বর্ষায় যেতে হচ্ছে তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে। নিজের ছাতা তিনি তাদের দিয়ে দিতেন।
বাড়িতে ঢোকার মুখে একটা আমগাছ ছিল। স্কুল ছুটির সময় হলে মা সেই আমগাছতলায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। ও রকম একদিন মা দেখেন, তাঁর খোকা শুধু গায়ের চাদরটা জড়িয়ে হেঁটে আসছেন। স্কুলে যেতেন পাজামা–পাঞ্জাবি পরে। শীতকালে চাদর পরতেন। সেদিন শুধু চাদর জড়িয়েই বাড়ি ফিরছেন। মা অবাক। কী ব্যাপার? পাজামা–পাঞ্জাবি কোথায়?
জানা গেল, তিনি তাঁর পাজামা–পাঞ্জাবি একটি ছেলেকে দিয়ে দিয়েছেন। সেই ছেলের পরনের জামাকাপড় একেবারেই ছিঁড়ে গিয়েছিল। পরার উপযুক্ত না।
একবার মাঘ মাসে বেজায় শীত পড়েছে। দিনরাত কনকনে ঠান্ডা। এ রকম একদিন ছুটির পর বন্ধুদের নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। দেখতে পেলেন রাস্তার ধারে বসে এক বৃদ্ধ ভিক্ষুক ঠকঠক করে কাঁপছে আর কাঁদছে। তিনি নিজের চাদর খুলে বৃদ্ধের গায়ে জড়িয়ে দিলেন।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়েই মুজিব জন্মেছিলেন। বড় হয়েছিলেন। এ জন্যই তিনি হতে পেরেছিলেন বাংলার জনমানুষের নেতা। মানুষ আর দেশকে ভালোবাসাই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র।
৪
মুজিব ক্লাস সেভেনে পড়েন। ১৯৩৪ সালের কথা। খেলাধুলা করেন, গান করেন, গ্রামের এদিক ওদিক ছোটাছুটি করেন। শরীর সেই আগের মতোই রোগা।
এ সময় বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলেন তিনি। ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। হার্ট দুর্বল হয়ে গেল। তাঁকে নিয়ে আব্বা রওনা দিলেন কলকাতায়। বড় বড় ডাক্তার দেখানো হলো। দুই বছর ধরে চিকিত্সা চলল। ধীরে ধীরে সেরে উঠলেন তিনি।
১৯৩৬ সাল। আব্বা মাদারীপুরে বদলি হয়ে এলেন। ছেলে অসুস্থ। এ জন্য মাকেও মাদারীপুরে নিয়ে এলেন। সে বছর চোখের অসুখ হলো মুজিবের। রোগের নাম গ্লুকোমা। মাদারীপুরের ডাক্তাররা পরামর্শ দিলেন কলকাতায় নিয়ে চিকিত্সা করানোর। রওনা দিতে হলো কলকাতায়। কলকাতার নামকরা চোখের ডাক্তার টি আহমেদকে দেখানোর ব্যবস্থা হলো।
ডাক্তার বললেন, চোখের অপারেশন করাতে হবে। নয়তো মুজিব অন্ধ হয়ে যাবেন। তাঁকে কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কিন্তু চোখের অপারেশন করাতে হবে শুনে তিনি খুবই ভয় পেলেন। মনে মনে ভাবলেন, অপারেশন করাবেন না। হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যাবেন।
সকাল ৯টায় অপারেশন হবে। তার আগে থেকেই তিনি পালানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। পারলেন না। অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হলো। ১০ দিনের মধ্যে দুই চোখের অপারেশন হলো। তিনি ভালো হয়ে গেলেন। তবে চশমা পরতে হবে আর কিছুদিন লেখাপড়া বন্ধ রাখতে হবে।
সেই যে ১৯৩৬ সাল থেকে চশমা পরা শুরু করলেন, তারপর থেকে সারা জীবন তাঁকে চশমা পরতে হয়েছে। চশমায় তাঁর ব্যক্তিত্ব আরও বেড়ে গিয়েছিল।
৫
১৯৩৭ সালে আবার লেখাপড়া শুরু হলো মুজিবের। আগের স্কুলে তিনি আর ফিরে গেলেন না। কারণ, সহপাঠীরা অনেক দূর এগিয়ে গেছে। অসুখের কারণে তিনি পিছিয়ে পড়েছিলেন। আব্বা তাঁকে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আব্বাও বদলি হয়ে এলেন গোপালগঞ্জে।
মুজিব খেলাধুলা পছন্দ করেন। ফুটবল সবচেয়ে পছন্দের খেলা। ভলিবল খেলেন, হকি খেলেন। স্কুলটিমে ভালো অবস্থান। কখনো কখনো খেলতে চলে যান মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মোল্লাহাটে।
আব্বাও ফুটবল খেলা পছন্দ করতেন। ছেলের খেলা থাকলে আব্বা তাঁর খেলা দেখতে যেতেন। কিন্তু ছেলে এত রোগা, মাঝেমধ্যে খুব জোরে বলে কিক করে মাঠে পড়ে যেতেন। তবে তাঁর কিকে গোল হতো।
আব্বারও একটা ফুটবল টিম ছিল। কখনো কখনো বাবা ও ছেলের দুই টিমের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো। সেই খেলায় কেউ কাউকে ছাড় দিতেন না। খেলা তো খেলাই। একদল হারবে, একদল জিতবে।
আব্বাকে যেমন ভালোবাসতেন মুজিব, তেমন ভয়ও করতেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সৎ, নির্ভীক এবং নীতিমান মানুষ। ছেলেকেও সেই শিক্ষাই দিয়েছিলেন। উদার হতে শিখিয়েছিলেন। মানুষকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন। দেশকে ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেন।
৬
স্কুলের বন্ধুদের মধ্যে মুজিবের বয়স একটু বেশি। অসুখের কারণে চার বছর পড়াশোনা করতে পারেননি। রোগা লম্বা শরীর। সবার ওপরে থাকে তাঁর মাথা। নিজের দল নিয়ে ঘুরে বেড়ান।
বাড়িতে গৃহশিক্ষক রাখা হয়েছে। তাঁর নাম কাজী আবদুল হামিদ। তিনি এমএসসি পাস। গোপালগঞ্জে আব্বা বাড়ি করেছেন। মাস্টার সাহেবের থাকার জন্য ঘর দেওয়া হয়েছে। এই কাজী আবদুল হামিদ মাস্টারের কাছেই সংগঠন করার প্রথম শিক্ষা পান মুজিব।
মাস্টার সাহেব একটি সংগঠন করেছেন গোপালগঞ্জে। নাম ‘মুসলিম সেবা সমিতি’। এই সমিতির কাজ গরিব ছেলেদের সাহায্য করা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে তিনি একমুঠ–দুমুঠ করে চাল তুলতেন। সেই চাল বিক্রি করে গরিব ছেলেদের বই কিনে দিতেন। পরীক্ষার ফি দিতেন। অন্যান্য খরচও দিতেন। যে ছাত্রের থাকা–খাওয়ার ব্যবস্থা নেই, সে রকম ছাত্রকে জায়গির ঠিক করে দিতেন।
মাস্টার সাহেবের সঙ্গে যোগ দিলেন মুজিব। রোববার স্কুল বন্ধ। মুজিব তাঁর দল নিয়ে মাস্টার সাহেবের সঙ্গে বাড়ি বাড়ি যাচ্ছেন। হাতে থলি। চাল তুলছেন। জনসেবার কাজ করছেন।
মাস্টার সাহেব যক্ষ্মারোগে মারা গেলেন। মুসলিম সেবা সমিতির ভার পড়ল মুজিবের ওপর। মাস্টার সাহেব যেভাবে সমিতি চালাতেন, তিনিও সেভাবেই চালাতে লাগলেন। স্কুলের আরেকজন মাস্টার ছিলেন সভাপতি। তিনি সম্পাদক। চাল বিক্রির টাকা জমা থাকত সভাপতির কাছে। এসব কাজে বাড়ির সবাই তাঁকে উত্সাহ দিতেন।
৭
যে মানুষটি সারা জীবন বঙ্গবন্ধুকে আগলে রেখেছেন, তাঁর নাম বেগম ফজিলাতুন্নেছা। ডাকনাম রেণু। আমরা শেখ মুজিবকে যেমন বঙ্গবন্ধু বলি, তিনি জাতির জনক; তেমনি বেগম ফজিলাতুন্নেছা হচ্ছেন জাতির জননী। মা। বঙ্গমাতা।
একজন মানুষ কখনো পরিপূর্ণ হয় না, যদি তাঁর জীবনসঙ্গী যোগ্য না হয়। মুজিবের সুযোগ্য সঙ্গী ছিলেন ফজিলাতুন্নেছা। স্বামীর জন্য তাঁর ত্যাগ–তিতিক্ষার শেষ ছিল না। বছরের পর বছর জেলে জীবন কাটিয়েছেন মুজিব। সংসার সামলেছেন বেগম মুজিব। অতিকষ্টে স্বামীর জন্য টাকা জমিয়ে রাখতেন। জেল থেকে ছাড়া পেলে বা রাজনীতির কারণে যখনই মুজিবকে ছোটাছুটি করতে হতো, ফজিলাতুন্নেছা তাঁর হাতে তুলে দিতেন জমানো টাকা। সাহস জোগাতেন, ভরসা দিতেন।
মুজিবের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়েছিল খুবই অল্প বয়সে। মুজিবকে তখন সবাই খোকা বলেই ডাকে। আর ফজিলাতুন্নেছা হলেন রেণু। যখন তাঁদের বিয়ে হয়, তখন খোকার বয়স ১০ বছর। তাঁরা চাচাতো ভাইবোন। একই বাড়িতে বসবাস। রেণুর বাবা মারা যাওয়ার পর তাঁর দাদা খোকার বাবাকে ডেকে বললেন, ‘তোমার বড় ছেলের সঙ্গে আমার এক নাতনির বিবাহ দিতে হবে। কারণ, আমি সব সম্পত্তি ওদের দুই বোনকে লিখে দিয়ে যাব।’
রেণুর দাদা ছিলেন শেখ লুত্ফর রহমানের চাচা। তাঁর হুকুমে বিয়ে রেজিস্ট্রি হয়ে গেল। রেণুর বয়স তখন ৩ বছর।
রেণুর বয়স যখন ৫ বছর, তখন তাঁর মা মারা যান। রইলেন শুধু দাদা। তিনিও মারা গেলেন রেণুর ৭ বছর বয়সে। রেণু চলে এলেন খোকার মায়ের কাছে। তাঁর ভাইবোনদের সঙ্গেই বড় হতে লাগলেন।
ধীরে ধীরে মুজিব হয়ে উঠলেন বাংলার জনমানুষের নেতা। বঙ্গবন্ধু। আর ফজিলাতুন্নেছা হয়ে উঠলেন বঙ্গমাতা।
৫৫ বছরের জীবনে ১২ বছরের বেশি সময় জেলে কাটিয়েছেন মুজিব। অবিরাম গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাঁকে। যখনই জেলে যেতেন, ফজিলাতুন্নেছা জেলগেটে গিয়ে খাতা–কলম দিয়ে আসতেন স্বামীকে। তাঁর জীবনের কথা লিখতে বলতেন। জেলে বসে বসে মুজিব লিখতেন। বেরিয়ে আসার পর সেসব খাতা অতিযত্নে রেখে দিতেন ফজিলাতুন্নেছা। তাঁর এই দূরদর্শী চিন্তার ফলে বাঙালি জাতি পেয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অমরগ্রন্থগুলো। এই বইগুলো পড়লে বোঝা যাবে, একজন মানুষ কতটা ত্যাগ স্বীকার করেছেন দেশের জন্য। কীভাবে তিনি হয়ে উঠলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। আমাদের জাতির পিতা। আর তাঁর পেছনে বেগম ফজিলাতুন্নেছার কতখানি অবদান।
৮
অধিকার কাকে বলে বা অধিকার কী, তা জানা দরকার। অধিকার হলো যে দেশে আমরা জন্মেছি, সেই দেশের সব রকম সুবিধা ভোগের সুযোগ। মানুষ যে পরিবারে জন্মায়, সেই পরিবারের মা–বাবা, ভাইবোন, আত্মীয়–পরিজনের সহায়তায় সে বড় হয়ে ওঠে। কোনো পরিবারই তার শিশুটির সব চাহিদা পূরণ করতে পারে না। ফলে শিশুটির যদি সত্যিকার মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে হয়, তাহলে তার দেশ ও সমাজের সাহায্য–সহযোগিতার প্রয়োজন। কিন্তু এসব পাওয়া সহজ নয়। না চাইলে পরিবার সমাজ দেশ কিছুই দিতে চায় না। চাইতে হয়। ক্ষুধার জন্য আহার চাইতে হয়, পরনের কাপড় চাইতে হয়, থাকার ঘর চাইতে হয়, অসুখের চিকিত্সা চাইতে হয় আর চাইতে হয় শিক্ষা। কারণ, শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে।
দেশের কাছে কোনো কিছুই একা চাইলে হয় না। চাইতে হয় একত্র হয়ে। না পেলে আদায় করে নিতে হয়। এই আদায় করে নেওয়ার ক্ষেত্রে যিনি পথপ্রদর্শক, তিনিই নেতা। আমাদের সেই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
কেমন করে চাইতে হয়, কেমন করে আদায় করে নিতে হয় নিজের অধিকার, সে রকম এক ঘটনা ঘটালেন মুজিব তাঁর কিশোর বয়সে।
বাংলা তখনো বিভক্ত হয়নি। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। বাণিজ্য ও পল্লী উন্নয়নমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ত্রিশের দশকের মাঝামাঝি সময়। এই দুই নেতা এসেছেন গোপালগঞ্জে। অন্যান্য কাজের পর মিশন স্কুল পরিদর্শনে এলেন। স্কুল পরিদর্শন শেষে ফিরে যাচ্ছেন, তখন ঘটল এক ঘটনা। হালকা ছিপছিপে গড়নের লম্বা একজন কিশোর দুই নেতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। শিক্ষকেরা ভয়ে অস্থির। দুই নেতা অবাক।
শেরেবাংলা বললেন, কী চাও তুমি?
কিশোর বলল, আমাদের হোস্টেলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ে। মেরামতের ব্যবস্থা হচ্ছে না। ছাদ মেরামতের ব্যবস্থা করে দিন।
সোহরাওয়ার্দী বললেন, তুমি কি জানো ছাদ মেরামতে কত টাকা লাগবে?
জানি। ১ হাজার ২০০ টাকা।
শেরেবাংলা হোস্টেলের ছাদ মেরামতের জন্য ১ হাজার ২০০ টাকা মঞ্জুর করলেন। সেদিন থেকেই দুই নেতার নজরে পড়লেন কিশোর। সোহরাওয়ার্দী সাহেব বিশেষ করে তাঁকে মনে রাখলেন।
এই কিশোর ছেলেটি শেখ মুজিব। আমাদের প্রিয় বঙ্গবন্ধু। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তিনি শুরু করেছিলেন অধিকার আদায়ের সংগ্রাম।
৯
রাজনীতি হলো অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করা। আন্দোলন নানাভাবে হতে পারে। লেখালেখি করে, বক্তৃতা দিয়ে, মিছিল করে, স্লোগান দিয়ে, হরতাল ডেকে, অনশন করে। সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েও আন্দোলন করা যায়। যেমন আমরা করেছিলাম ১৯৭১–এ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।...ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো।...এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তাঁর সেই ডাকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল বাঙালি। স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেছে। এই যুদ্ধে আমরা ৩০ লাখ প্রাণ হারিয়েছি।