বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের দেশ দিলেন
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম হয়েছিল অজপাড়াগাঁয়ে। গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। তাঁর আব্বা ছিলেন আদালতের কর্মচারী। সেখান থেকে উঠে এসে একজন মানুষ কীভাবে হয়ে উঠলেন বাংলাদেশের স্থপতি, জাতির পিতা। কেন দেশের মানুষ তাঁকে ভালোবেসে ডাকে বঙ্গবন্ধু বলে?
কোন কোন গুণ তাঁকে বাংলাদেশের স্থপতি হতে সাহায্য করল? আমরা সেই গুণগুলো নিয়ে আলোচনা করব।
স্বপ্ন
তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন অনেক আগে থেকে। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত প্রায় ২০০ বছর আমরা ছিলাম ইংরেজদের অধীন। ইংরেজরা চলে গেল, ১৯৪৭ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট হলো দুটো দেশ—পাকিস্তান আর ভারত। শেখ মুজিবের বয়স তখন ২৭। তিনি পড়তেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। থাকতেন বেকার হোস্টেলে। তাঁর নেতা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর শরৎ বসু মিলে ১৯৪৭ সালে চেষ্টা করেছিলেন একটা স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলো। বাংলা ভাগ হয়ে গেল। পশ্চিম বাংলা গেল ভারতে। পূর্ব বাংলা হলো পাকিস্তানের অংশ। শেখ মুজিব সেদিন থেকেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন।
চেষ্টা ও পরিশ্রম
শুধু স্বপ্ন দেখলেই হয় না। স্বপ্ন পূরণের জন্য চেষ্টা করতে হয়। সাধনা করতে হয়। তোমরা যদি শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী এবং কারাগারের রোজনামচা পড়ো, তাহলে দেখবে, তিনি প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। রাজনীতির বিষয়েও তাঁকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হতো। দিল্লিতে রাজনৈতিক সমাবেশে যোগ দিতে গেছেন। পকেটে টাকা নেই। তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছেন ট্রেনে। টাকা ছিল না বলে বড়লোকদের সার্ভেন্টদের কামরায় উঠেছেন। আবার নেতার নির্দেশে রাজনীতির কাজে একবার গিয়ে দিনরাত বহু ঘণ্টা কিছুই খেতে পাননি। রাজনীতির জন্য তাঁর মতো খাটতে আর কেউই পারত না। পাকিস্তান হওয়ার পরে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগ আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। সারা দেশ ঘুরে ঘুরে সংগঠন তৈরি করেছিলেন।
দয়া, মানবপ্রেম
তাঁর হৃদয় ছিল খুবই কোমল। ছোটবেলায় তিনি একবার গোপালগঞ্জে শীতের মধ্যে দেখেন, এক ছেলের গায়ে কাপড় নেই। পরনে শতচ্ছিন্ন একটা লুঙ্গি। তিনি তখন নিজে গায়ের চাদর পরে নিয়ে ছেলেটাকে লুঙ্গি আর শার্ট দান করে দিয়েছিলেন। ছোটবেলায় দুর্ভিক্ষের সময় নিজের গোলার ধান দান করতেন। সমিতি করে অন্যদের কাছ থেকেও ধানচাল সংগ্রহ করে গরিব ছাত্রদের মধ্যে বিলি করতেন। কলকাতায় একবার এক বৃদ্ধাকে রাস্তার ধারে পড়ে থাকতে দেখে তিনি কোলে করে হাসপাতালে দিয়ে এসেছিলেন।
মেধা
বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি ছিল তুলনাহীন। তিনি যাকে একবার দেখতেন, তাকেই মনে রাখতেন, বহু বছর পরে দেখা হলেও তার নাম ধরে ডাকতে পারতেন। তিনি যে বইগুলো লিখেছেন, সেগুলো লিখেছেন জেলখানায় বসে। হাতের কাছে কম্পিউটার ছিল না, কোনো নোটবই ছিল না। কিন্তু তিনি বহু বছর আগে দেখা তাজমহল বা চীন ভ্রমণের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতা, নজরুলের কবিতা তিনি মুখস্থ বলে দিতে পারতেন। দেশ-বিদেশের মনীষীদের জীবনী তিনি পড়তেন, তাঁদের জীবনের শিক্ষা কাজে লাগাতেন। গল্প উপন্যাসও পড়তেন। রাজনীতির বই পড়তেন। ইতিহাস পড়তেন।
আবার মেধার কদর করতে জানতেন। ছয় দফা দাবি প্রণয়নের সময়, আওয়ামী লীগের ইশতেহার লেখার সময়, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি কী হবে, সংবিধান কী হবে—এসব বিষয়ে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, আইনজ্ঞদের একখানে করতে পেরেছিলেন। তাঁদের সাহায্য নিয়েছিলেন।
লক্ষ্যে অটুট থাকা
বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে হবে, এই লক্ষ্য থেকে তিনি কখনো সরেননি। ১৯৬০-এর দশকে একবার তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলা চলে গিয়েছিলেন। তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন নেহরু। তিনি নেহরুর কাছে চিঠি লিখে জানতে চেয়েছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামে ভারত কীভাবে সাহায্য করতে পারে! ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগেও তিনি একজন পাকিস্তানি সাংবাদিককে এবং আমেরিকার কূটনীতিককে বলেছিলেন, তাঁর আসল লক্ষ্য স্বাধীন বাংলাদেশ। নির্বাচন হলে তিনি জয়লাভ করবেন। তখন তাঁর লক্ষ্য অর্জন সহজ হবে।
ত্যাগ স্বীকার
তিনি বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। অনেক নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। জীবনের ৩ হাজার ৫৩ দিন তিনি ছিলেন জেলে। জেলখানায় গোয়েন্দারা এসে তাঁকে বলত, ‘আপনি বন্ডসই দিন, মুচলেকায় স্বাক্ষর দিন, আর আন্দোলন করবেন না, তাহলে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।’ তিনি বলতেন, ‘আমার জীবন যেতে পারে। কিন্তু আমি বাংলার মানুষকে মুক্ত না করা পর্যন্ত আন্দোলন থামাব না।’ নিজের জীবন বাংলার মানুষের মুক্তির জন্য দিতে তিনি সর্বদা প্রস্তুত ছিলেন। কারাগারকে তো ভয় পেতেনই না। মৃত্যুকেও না। তিনি বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে গিয়েও আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা।’
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি জেলে যান। ১৯৫২ সালে অনেক মাস জেলে থেকে তিনি যখন মুক্ত হন, তখন শেখ হাসিনার বয়স চার বছরের বেশি। তাঁর ছেলে শেখ কামাল কেবল কথা শিখেছে। জেল থেকে বের হয়ে শেখ মুজিব গেলেন টুঙ্গিপাড়ার বাড়িতে। শেখ হাসিনা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই বলে আব্বাকে জড়িয়ে ধরল। কামাল দূরে দূরে থাকত। শেষে সে তার আপাকে বলল, ‘হাছু আপা, তোমার আব্বাকে আব্বা বলে ডাকতে পারি?’
শেখ মুজিবকে হত্যার চক্রান্ত অনেকবার হয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি যখন ক্যান্টনমেন্টে বন্দী, তখন তাঁকে বৈকালিক হাঁটার সময় পেছন থেকে গুলি করে মারার চক্রান্ত করা হয়েছিল। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পরও তাঁকে মারার জন্য ছোরা হাতে এক লোক তাঁর ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়িতে গিয়েছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের জেলখানায় তাঁর সেলের পাশে কবর খোঁড়া হয়েছিল। পাকিস্তানিরা বিচার করে তাঁর মৃত্যুদণ্ডের রায় দিয়েছিল। কিন্তু তিনি নিজের দেশের মানুষের মুক্তি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে সরে যাননি।
মানুষকে ভালোবাসা
তিনি মানুষকে খুব ভালোবাসতেন। দেশের মানুষও তাঁকে খুব ভালোবাসত। তিনি খুব ভালো বাগ্মী বা বক্তা ছিলেন। এটাও কিন্তু তিনি চর্চা করে অনুশীলন করে অর্জন করেছিলেন। দেখতে সুদর্শন ছিলেন। ছোটবেলা থেকে ফুটবল খেলতেন, ভলিবল খেলতেন। গান গাইতেন। বড় হয়েও ব্যাডমিন্টন খেলতেন। গোপালগঞ্জে তাঁদের বাসার আমগাছের নিচে দাঁড়িয়ে একা একা তিনি বক্তৃতা দেওয়া প্র্যাকটিস করতেন। মানুষকে সম্মান করতেন। যে একবার তাঁর সামনে যেত, তাঁর ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে যেত। শত্রু–মিত্র সবারই হৃদয় জয় করার ক্ষমতা তাঁর ছিল। তাঁর বিরোধীদেরও তিনি সম্মান করতেন। তাঁদের পরিবারের খোঁজ নিতেন। দেশের মানুষ তাঁর জন্য পাগল ছিল। ১৯৫০-এর দশকেই এক জনসভায় মাওলানা ভাসানী উপস্থিত, আতাউর রহমান উপস্থিত, কিন্তু জনতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব বলে চিৎকার করছিল। তাঁর ভাষণ তাঁরা শুনতে চায়। তিনি যেখানে যেতেন, সেখানেই তাঁকে ঘিরে ভিড় হয়ে যেত। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের সময় তিনি নদীপথে লঞ্চে যাচ্ছিলেন, লোকে নদীর তীর থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাঁর লঞ্চের কাছে আসার চেষ্টা করছিল। তাঁকে একনজর দেখা, তাঁর মুখের কথা একটু শোনার জন্য বাংলার মানুষ আকুল হয়ে গিয়েছিল।
সংগঠন ও নেতৃত্বের গুণ
তিনি জানতেন, লক্ষ্য পূরণ করতে হলে সংগঠন লাগবে। সে জন্য তিনি গ্রামগঞ্জে আওয়ামী লীগের সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। আর তাঁর ছিল মানুষের মনের কথা পাঠ করার গুণ। তিনি বুঝেছিলেন, দেশের মানুষ পাকিস্তানিদের জুলুমের অবসান চায়। তিনি সেই কথাই বললেন ছয় দফা দাবিতে। তিনি বুঝলেন, দেশের মানুষ দেশের স্বাধীনতা চায়। ভোট হলে তিনি জিতবেন। স্বাধীনতার দাবি তখন পৃথিবীর মানুষের কাছে বৈধ হয়ে উঠবে। তাই তিনি ১৯৭০ সালে নির্বাচন করলেন।
দূরদর্শিতা
তাঁর দূরদর্শিতার অনেক প্রমাণ আছে। শ্রেষ্ঠ প্রমাণ হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ। সেদিন ছাত্র–জনতা চাইছিল তিনি বলুন, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। কিন্তু তা করলে পাকিস্তানি সৈন্যরা আক্রমণ করে লাখো মানুষকে মেরে ফেলত, আবার পৃথিবীর মানুষ তাঁকেই দুষত পাকিস্তান ভাঙার জন্য। আমাদের স্বাধীনতাসংগ্রাম ব্যর্থ হয়ে যেত। আবার তিনি যদি স্বাধীনতার কথা না বলেন, দেশের মানুষ তাঁর পেছন থেকে সরে যাবে। তাই তিনি বললেন এক আশ্চর্য জাদুকরি মন্ত্র, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
ওই ভাষণে তিনি যার যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার নির্দেশ দিলেন। মানে যুদ্ধ শুরুর ঘোষণা দিলেন। কিন্তু একটাও অবৈধ নির্দেশ দিলেন না। পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট একটা কথাও বললেন না। দেশের মানুষ বুঝে গেল, যুদ্ধ করেই স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে।
তিনি আমাদের জাতির পিতা
বাংলাদেশ যে স্বাধীন হয়েছে, এটা দেশের মানুষ স্বাধীন হয়ে একটা দেশ বানাতে চেয়েছিল বলে সম্ভব হয়েছে। আর দেশের মানুষ যে এই স্বপ্নে বিভোর হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, পুরোটাই হয়েছিল এক জাদুকরের জাদুর কাঠির সম্মোহনে। তিনি শেখ মুজিব। তিনি এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। প্রস্তুত করেছিলেন। নির্বাচনে জিতে স্বাধীনতার দাবিকে বৈধ করে তুলেছিলেন। এবং ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ সারা দিন ধরে নির্দেশ দিচ্ছিলেন পুলিশ, আনসার, বাঙালি সৈন্যদের অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে রাখতে।
পাকিস্তানিরা যেই না গুলি চালাতে শুরু করল, ওয়্যারলেসে ঘোষিত হতে লাগল বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তিনি পাগলের মতো ওই রাতে হাসছিলেন আর হাজি মোরশেদ নামের তাঁর সঙ্গীকে বলছিলেন, ‘ওরা আক্রমণ করেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন।’
রক্তঋণ
বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ শেষ করে বলেছিলেন, ‘আপনারা আমাকে রক্ত দিয়ে মুক্ত করে এনেছিলেন। আপনাদের কাছে আমার রক্তঋণ। আপনাদের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করব। জয় বাংলা।’
তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি রক্ত দিয়ে মানুষের কাছে তাঁর যে ভালোবাসার ঋণ, তা শোধ করে গেছেন। আর আমাদের ঋণী করে গেছেন।
তাঁর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়েই আমরা তাঁকে প্রকৃত শ্রদ্ধা জানাতে পারি।