ফিস ফিস করা একদল তরুণ

নেচার অ্যাকোয়াটিকের চার তরুণ (বাঁ থেকে) রিযভি, ফাহিম, নবেল ও ইশতি

দোকানটা নাম নেচার অ্যাকোয়াটিক। ধানমন্ডি রাইফেলস স্কয়ারের পাশে, আমবালা মার্কেটের নিচতলায়। দোকানটার হর্তাকর্তাদের সঙ্গে গল্প করতে এক বিকেলে সেখানে গিয়েছি, সঙ্গে আছেন আলোকচিত্রী কবীর শাহরীয়ার। ছবিটবি তোলা হবে; খবর পেয়েই কি না কে জানে, কাকতালীয়ভাবে ঠিক সেই সময় দোকানে হাজির একজন ‘বিখ্যাত মডেল’! প্রথম আলোর নকশা, অধুনা পাতায় বিভিন্ন সময় তোমরা হয়তো তার ছবি দেখেছো। নাম টিয়ারা। অ্যাকোয়ারিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে কখনো কাচে নাক ঠেকিয়ে বলছিল, ‘তোই, ফিস তোই?’(কই, ফিস কই?)। আবার কখনো আঙুল তুলে বলছিল, ‘আম্মু তাতেল, দেখো তাতেল!’ (আম্মু টার্টেল, দেখো টার্টেল)। দোভাষী হয়ে ছোট্ট টিয়ারার কথাগুলো আমাদের বুঝিয়ে বলছিলেন মা। প্রাণবন্ত একজন মডেল পেয়ে কবীর শাহরীয়ার তখন মহানন্দে ক্লিক করেই যাচ্ছেন। আমরা আর দোকানে ভিড় না বাড়িয়ে, বাইরে মার্কেটের সিঁড়িতে বসলাম। শুরু হলো গল্প।

মাছের কাছে, গাছের কাছে

তিন বন্ধু—মাহবুবুর রহমান ফাহিম, ফাহিম জামান নবেল আর আশরাফ সিদ্দিকী রিযভি। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাছের প্রতি তাঁদের যে কী ভীষণ ভালোবাসা, একদিন তাঁদের সঙ্গে জম্পেশ আড্ডা না দিলে বুঝবে না। মাহবুবুর রহমান যেমন হাসতে হাসতে বলছিলেন, ‘আমাদের রক্তের ভেতর মাছ চলাচল করে। মানুষের ব্রেইন স্ক্যান করলে ধমনি-শিরা-উপশিরা কত-কী দেখা যায়। আমাদের ব্রেইন স্ক্যান করলে হয়তো দেখা যাবে, দুইটা মাছ ছোটাছুটি করছে!’

অ্যাকোয়ারিয়াম ছিল স্রেফ শখ, এই শখকে পুঁজি করেই অনেক দূর পৌঁছে গেছেন তিন তরুণ। সাধারণত অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতর আমরা যেসব গাছ দেখি, সেগুলো হয় প্লাস্টিকের। গাছের নিচে মাটির বদলে ছড়ানো থাকে মোজাইক পাথর। ফাহিম, নবেল আর রিযভি মিলে সত্যিকার গাছ, মাটি, প্রবাল ইত্যাদি দিয়ে অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানোর কাজ শুরু করেছেন। তাঁদের ভাষায় একে বলা যায় ‘পানির মাঝে এক অন্য রকম বাগান’। অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানোর এ ধরনের কাজকে বলা হয় ‘অ্যাকোয়া স্কেপিং’। বাইরের বিশ্বে বহু আগে থেকে চালু থাকলেও বাংলাদেশে অ্যাকোয়া স্কেপিং শুরু করেছেন এই তিন বন্ধু। ২০১৪ সালে তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন আরেক তরুণ—ইশতিয়াক আহমেদ।

নবেল আর রিযভি সেদিন দোকানে ছিলেন না। তাই ফাহিমের সঙ্গেই আড্ডা জমল। ‘ছোটবেলা থেকেই আমার অ্যাকোয়ারিয়ামের শখ। বিভিন্ন সময় দেশের বাইরে গিয়েছি। সেখানে দেখেছি সত্যিকার জলজ উদ্ভিদ বসানো অ্যাকোয়ারিয়াম। আমি তখন ভারত থেকে বিবিএ শেষ করে দেশে ফিরেছি। পরিচয় হলো নবেল আর রিযভির সঙ্গে। ওদেরও এসব ব্যাপারে খুব আগ্রহ। তিনজন মিলে প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়াম বানানোর কিছু কিছু সরঞ্জাম বাইরে থেকে আনতে শুরু করলাম।’ এভাবেই ধীরে ধীরে তৈরি হলো কিছু ‘হবিস্ট’। সহজ করে বললে, অ্যাকোয়ারিয়ামের শখটা যাদের বাড়াবাড়ি পর্যায়ের, ফাহিমরা তাদের বলছেন হবিস্ট। দিনে দিনে হবিস্টের সংখ্যা বাড়তে শুরু করল। বাড়ল চাহিদাও। ‘২০১১ সাল। তখনো আমাদের দোকান ছিল না। ওয়েবসাইট আর ফেসবুক পেজের মাধ্যমে হবিস্টদের সঙ্গে যোগাযোগ হতো।’ ফাহিম বলছিলেন শুরুর দিকের কথা। একসময় মনে হলো, একটা দোকান না হলে চলছে না। ট্রেড লাইসেন্স করে নিয়ে তিন বন্ধু এরপর নামলেন আটঘাট বেঁধে। ইতিমধ্যেই জাপানি প্রতিষ্ঠান অ্যাকোয়া ডিজাইন অ্যামানোর সঙ্গে তাঁদের চুক্তি হয়েছে। নেচার অ্যাকোয়াটিক এখন আমদানি করছে অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানোর সরঞ্জাম, গাছ আর মাছ!

টিয়ারা বলছে, তোই, ফিস তোই?
ছবি: কবীর শাহরীয়ার

কত্ত কী!

ছোট্ট একটা কৌটা দেখিয়ে ফাহিম বলছিলেন, ‘এটা হলো বিশ্বের সবচেয়ে দামি মাছের খাবারগুলোর মধ্যে অন্যতম’। কৌটার গায়ে লেখা ‘এপি-থ্রি গোল্ড’। মজার ব্যাপার হলো, এ খাবার যেই প্রযুক্তিতে তৈরি হয়, মহাকাশচারীদের খাবার তৈরিতেও নাকি ব্যবহৃত হয় একই প্রযুক্তি। ব্যয়বহুল এ ধরনের খাবার খেলে মাছের নাকি বাথরুম করার প্রয়োজন হয় না! পুরো খাবারটাই শরীরের সঙ্গে মিশে যায়!

প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়াম তৈরির মাটি আসে জাপান থেকে। গাছ, মাছ আর প্রবালগুলোও সিঙ্গাপুর আর ইন্দোনেশিয়া থেকে আনা হয়। তবে ফাহিম জানালেন, ‘রোটেলা এসপি বাংলাদেশ’ নামে একধরনের জলজ গাছ সিলেটে পাওয়া যায়, যেগুলো প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়ামে ব্যবহার করা যায়। আবার বান্দরবানে পাওয়া যায় একধরনের গাছের গুঁড়ি, যেগুলো বিভিন্ন প্রক্রিয়াকরণের পর অ্যাকোয়ারিয়াম সাজানোর কাজে ব্যবহার করা যায়। কৃত্রিমভাবে লবণাক্ত পানি তৈরি করে সামুদ্রিক মাছ অ্যাকোয়ারিয়ামে রাখার কায়দাকানুনও জানা আছে তাঁদের। এ ছাড়া পানির তাপমাত্রা, পানিতে বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ—ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে নেচার অ্যাকোয়াটিকের কাছে আছে অত্যাধুনিক সব যন্ত্রপাতি। বিস্তারিত জানতে চাইলে একদিন তাদের ছোট্ট দোকানটা ঘুরে আসতে পারো। কিংবা যোগাযোগ করতে পারো তাদের ওয়েবসাইট অথবা ফেসবুক পেজের মাধ্যমে।

তুমি চাইলে নেচার অ্যাকোয়াটিক তোমার পুরো অ্যাকোয়ারিয়ামটি সত্যিকার গাছ-মাটি-প্রবাল-ঝিনুক দিয়ে সাজিয়ে দেবে। পাবে বিক্রয়োত্তর সেবাও। জানিয়ে রাখি, সর্বনিম্ন সাইজের প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়াম (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা ১২ ইঞ্চি) তৈরি করতে খরচ পড়বে ১২ হাজার টাকা। সর্বোচ্চ ১২ ফুট দৈর্ঘ্যের প্লান্টেড অ্যাকোয়ারিয়ামও বানাতে পারো। এ ছাড়া ছাদের ওপর অথবা বাগানে ‘পন্ড’ তৈরির কাজও করে তারা।

টিপস

কথায় কথায় ফাহিমের কাছে শেখা হলো অনেক কিছু। তোমাদের জন্য টুকে নিলাম অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ পালন সম্পর্কে কিছু টিপস।

  • যেকোনো মাছ কেনার আগে মাছটি সম্পর্কে পড়তে হবে। মাছটা কী খায়, কেমন পরিবেশে থাকে, কীভাবে বংশবৃদ্ধি করে ইত্যাদি খুঁটিনাটি গুগলে সার্চ করলেই জেনে নেওয়া যায়।

  • কখনোই অ্যাকোয়ারিয়ামের পুরো পানি বদলে ফেলা যাবে না। কিছু পানি রেখে তার সঙ্গে আরও পানি মেলাতে হবে। পুরোনো পানিতে বেনিফিশিয়াল ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা মাছের জন্য উপকারী। বেনিফিশিয়াল ব্যাকটেরিয়া আলাদাভাবে কিনতেও পাওয়া যায়।

  • অ্যাকোয়ারিয়ামে মোজাইক পাথর ব্যবহার করা ঠিক নয়। মোজাইক পাথর মাছের জন্য ‘স্লো পয়জন’ হিসেবে কাজ করে। প্রয়োজনে নদীর পাড়ে যে ধরনের নুড়িপাথর পাওয়া যায়, সেগুলো ব্যবহার করতে পারো। নুড়িপাথর মাছের দোকানগুলোতেও কিনতে পাওয়া যায়।

  • অ্যাকোয়ারিয়ামের ফিল্টার কলের পানি দিয়ে পরিষ্কার করা যাবে না। অ্যাকোয়ারিয়ামের পানিই মগে নিয়ে ফিল্টার পরিষ্কার করতে হবে।

  • অ্যাকোয়ারিয়ামে মাছ ছাড়ার আগে ৪০ দিন ফিল্টার চালু করে রাখতে হবে। অথবা মাছ ছাড়ার আগে পানির সঙ্গে মাইক্রোব্যাক ব্যাকটেরিয়া মিশিয়ে দিতে হবে।

  • অ্যান্টি-ক্লোরিন ছাড়া আর কোনো ওষুধ নিয়মিত ব্যবহার করা ঠিক নয়। জ্বর না হলেও প্যারাসিটামল খাওয়া যেমন মানুষের জন্য ক্ষতিকর, তেমনি মাছ অসুস্থ না হতেই অ্যাকোয়ারিয়ামে ওষুধ দেওয়া ঠিক নয়।

  • মাছ কিনে আনার পর যে পানিতে মাছ আনা হয়েছে, সেই পানি অ্যাকোয়ারিয়ামে দেওয়া যাবে না। একেবারে নতুন পানিতেও মাছ ছেড়ে দেওয়া যাবে না। ধরো, তুমি পানিসহ পলিথিনে করে মাছটা এনেছো। প্রথমে পলিথিনটা পানিভর্তি অ্যাকোয়ারিয়ামের ভেতর ছেড়ে দাও। কিছুক্ষণ পর পলিথিনের পানি আর অ্যাকোয়ারিয়ামের পানির তাপমাত্রা এক হয়ে গেলে পলিথিন থেকে মাছ বের করে অ্যাকোয়ারিয়ামে ছেড়ে দাও।

(কিশোর আলোর জুন ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত)