ফিরিয়ে দাও সে খাদ্য লহ এ নগর!

বাকরখানি ছিল সবার নাশতার একটি অপরিহার্য উপাদান
বাকরখানি ছিল সবার নাশতার একটি অপরিহার্য উপাদান

গেল তো সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেই তোমার মনটা খারাপ হয়ে! এই শীত শীত ভোরে টেবিলে বসে সেই তো হয় জেলি-পাউরুটি, নইলে রুটি-ভাজি কিংবা নুডলস চিবুতে হবে। বা দুপুরবেলার কথাই ধরো না কেন—হয় টিফিন টাইমে ফ্রাইড রাইস, না হলে বন্ধুদের সঙ্গে পিত্জা-বার্গার। বড়জোর ছুটির দিনে আব্বু-আম্মুর সঙ্গে খিচুড়ি!

ঠিকই তো! প্রতিদিন গম্ভীর মুখে একই খাবার আর কত খাওয়া যায়? জিবের প্রতিও সুবিচারের একটা ব্যাপার আছে, তাই না? এর চেয়ে বরং চলো একটা মানস ভ্রমণ হয়ে যাক। ধরো, একলাফে পিছিয়ে গেলে শ খানেক বছর! তুমি একাই না, ধরো বাবা-মাসহ সবাই পিছিয়ে গেলে সেই সময়ের ঢাকা শহরে! মাসের হিসাবটা না হয় একটু এদিক-সেদিক করে নিলে। আশ্বিন মাসই ধরো, শীত শীত ভাব আছে একটু, আবার হাড়কাঁপানো শীত না! নতুন চালের পিঠা বানানোও শুরু হয়েছে, আবার ইলিশেরও রমরমা!

সেই সময়ের ঢাকা! নবাব সলিমুল্লাহ গত হয়েছেন বছর খানেক হলো। ঢাকার মসনদে তখন নবাব হাবিবুল্লাহ। আহসান মঞ্জিলে বসে শীত শীত সকালে বাকরখানি-শিরমাল রুটি দিয়ে দিব্যি নাশতা সেরে ছেলে ছোকরাদের ঘুড়ি ওড়ানো দেখেন।

তুমি তো আর নবাব-উজিরদের মতো হোমরাচোমরা কেউ না, কিন্তু নাশতার বেলায় তখন ঢাকার সমাজে গভীর সাম্যবাদ। মুটে-মজুর থেকে মহল্লার সরদার, কুস্তি আখড়ার পালোয়ান থেকে লিকলিকে তালপাতার সেপাই—সবার নাশতাতেই থাকতে হবে বাকরখানি। সঙ্গে থাকতে পারে সরিষা তেলে ভাজা ডিম, দুধের পুরু সর কিংবা রাতা মুরগির ঝোল।

আজকের ব্যাপার অবশ্য আলাদা, মহা খুশির একটা দিন। বাবা কলকাতা যাচ্ছেন বিশেষ কাজে। একটু ঘ্যানঘ্যান করায় তোমারও যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। ১০০ বছর আগে তো আর কলকাতা মানে বিদেশ যাওয়ার মতো কিছু না! পাসপোর্ট-ভিসার ঝামেলা নেই!

সিন্দুকে বিশেষ যত্নে রাখা চোগাখানা বাবা বহুদিন পর গায়ে চাপিয়েছেন। হাতের কবজিতে মেখেছেন ইয়েমেন থেকে আসা আতর। তুমিও চাপিয়েছ ছোটখাটো একখানা চোগা। আর ওদিকে মা রান্নাঘরে ব্যস্ত তোমার অতি প্রিয় চিতই পিঠা বানাতে। তখন বাংলার বড় বড় নদীতে খলবল করত ইলিশ। তোমাদের রসুইঘরে উঁকি দিলেও সেটা টের পাওয়া যায়। ইলিশের কাঁটা বেছে ছোট ছোট টুকরা ভালো করে মসলা মাখিয়ে রাখা হয়েছে। সেগুলো চিতই পিঠার কাইয়ের সঙ্গে চুলায় ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পিঠার সঙ্গেই সেদ্ধ হয়ে যাচ্ছে ইলিশ। ফুঁ দিয়ে ফুঁ দিয়ে তৃপ্তির সঙ্গে সেই পিঠা খেয়ে নিলে গরম-গরম। চেয়ার-টেবিলের প্রচলন ওভাবে হয়নি। বাবা দস্তরখানেই হাত মুছে গুড়ুক গুড়ুক টান দিলেন হুঁকায়। এরপর যষ্টিমধু দেওয়া পান। তোমার জন্য রয়েছে সুগন্ধি এলাচির দানা, না হলে কাটা সুপারি। চায়ের প্রচলন তখন বাংলায় সেভাবে চালু হয়নি, তুমি আর তাতে চুমুক দিতে যাবে কোন দুঃখে?

ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে টাঙা। তাতে শপাং শপাং চাবুকের শব্দ তুলে মুহূর্তেই গাড়োয়ান তোমাদের উড়িয়ে নিয়ে গেল ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন। কমলাপুরের রেলস্টেশনের তখনো জন্ম হয়নি! একরাশ কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে তোমরা রেলগাড়ি থেকে যখন নামলে, সামনেই নারায়ণগঞ্জের স্টিমারঘাট। বেলা গড়িয়ে যখন দুপুর, ততক্ষণে সেই স্টিমারে করেই তোমরা শীতলক্ষ্যা পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছেছ গোয়ালন্দ ঘাটে!

তখনকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন দেখতে ছিল এমন
তখনকার ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশন দেখতে ছিল এমন

দীর্ঘ ভূমিকা শেষ, আমাদের গল্প তাহলে এখান থেকেই শুরু...

মাথার ওপরে তখন সূর্য। এবার কেন জানি শীতটা আসি আসি করেও সেভাবে আসছে না। দুপুরে গরম লাগে বেশ। বাহারি চোগার কারণে তোমার হাঁসফাঁসও লাগছে। কিন্তু তাতে আর সমস্যা কী? গোয়ালন্দ ঘাট থেকে কলকাতার শেয়ালদা যাওয়ার ট্রেন ছাড়ার তখনো ঢের দেরি। ভ্রমণের ক্লান্তি ভুলতে একটা গামছা পরে সবাই নেমে পড়ছে যমুনায় ডুব দিতে। বাবা বললেন, কিরে ডুব দিবি নাকি?

বাবা বলেছেন সেটাই যথেষ্ট। তুমি চোগা খুলে লাফ দিয়ে তাতে শামিল হয়ে গেলে।

গোসল সেরে গা-মাথা মুছে তুমি যখন আবার ফিটফাট হয়ে উঠেছ, তখন টের পেলে যমুনার নির্মল বাতাসে তোমার খিদে খিদে লেগেছে বেশ! ঘাটের ধারেই সারি সারি ভাতের দোকান। ওপরে বাঁশের চালা দিয়ে ছোট চৌকির ওপর বেশ খোলামেলা খাবার ব্যবস্থা।

বাবা সামনে রাখা বদনা দিয়ে হাত ধুয়ে চৌকিতে বসে ভাত দিতে বললেন। সঙ্গে কী খাওয়া যায়? কী আবার? এমন সময়ে নদীর তীরে বসে ইলিশ ছাড়া অন্য কিছুর হুকুম দেয় কোন মূর্খ? কাঁসার থালায় করে গরম ভাত এল। আর এল কলাপাতায় করে ইলিশ ভাজা। একেকজনের জন্য গাদার অংশ দুটো। সরিষার তেলে মুচমুচে করে ভাজা। মাছের সঙ্গে ভাজা হয়েছে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ আর রসুনের কোয়া। তুমি তার ভাগও পেলে। মাছের তেলে সঙ্গে সঙ্গেই মাখিয়ে ফেললে তপ্ত ভাত। মুখে দিয়েই চোখ বন্ধ হয়ে এল। অভ্যাসবশতই বিড়িবিড় করে বেরিয়ে এল, আহা!

ইলিশ মাছ ভাজা যুগে যুগেই ছিল বাঙালির প্রিয় খাবার
ইলিশ মাছ ভাজা যুগে যুগেই ছিল বাঙালির প্রিয় খাবার

ঠিক পাশের চুলাতেই বসানো হয়েছে ইলিশের ব্যঞ্জন। আলু আর বেগুন দিয়ে সোনালি রঙের পাতলা ঝোল। তোমার ইলিশ ভাজা শেষ করতে করতে তাদের রান্নাও শেষ। নামানোর ঠিক আগে চামচের বড় হাতায় করে দুই চামচ সরিষার তেল দিয়েই কড়াই নামিয়ে ফেলা হলো।

সে ব্যঞ্জন যখন কলাপাতায় এনে তোমার পাতে ঢেলে দেওয়া হলো, প্রথমেই সরিষার তেলের ঝাঁজ ধক করে নাকে গিয়ে ধাক্কা লাগল। সে সুবাসের ধাক্কায় তুমি হয়ে গেলে প্রায় বেসামাল। ইলিশকে তখন মনে হচ্ছে আরাধনার দেবী; গাপুস-গুপুস মুখে পুরে তার পূজা দিতে হয়...

তৃপ্তির ঢেকুর তুললে শব্দ করেই। ভবিষ্যতের মতো মেকি ভদ্রতা রক্ষার জন্য ঢেকুর আড়াল করার ভব্যতা তখনো সৃষ্টি হয়নি। হাত-মুখ ধুয়ে দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা গামছাখানায় মুছে তুমি আর বাবা এগিয়ে গেলে সামনের দিকে। কড়া পাকের রাবড়ি বিক্রি হচ্ছে বেশ সস্তায়। এক আনায় তার অনেকখানি শালপাতায় তুলে দিল ময়রা। খাঁটি ঘাস খাওয়া গরুর বিশুদ্ধ দুধের সেই রাবড়ির জন্য বাংলা বিখ্যাত আগে থেকেই। ইতিহাসের সন্তান হিসেবেই সেই পরমান্ন তুমি জিবে ছুঁইয়ে জন্ম সার্থক করলে!

ওদিকে হতচ্ছাড়া রেলের ইঞ্জিন কয়লার ধোঁয়া ছাড়া শুরু করেছে। গোরা সাহেব-মেম আগে থেকেই ফার্স্ট ক্লাসে উঠে বাবু হয়ে বসে আছে। তোমাদের জন্য বরাদ্দ হলো থাড্ডকেলাস, সেটাও চোখের সামনে আলুর বস্তার মতো ভর্তি হয়ে যাচ্ছে।

কী আর করা...যমুনার পারের অত্যুত্তম স্বাদের সব খাবার পেছনে ফেলে তোমরা তখন ছুটছ ট্রেনের হাতল ধরতে। রওনা দেওয়ার হুইসেল এই বাজল বলে...