আসিফ তার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছে। হঠাৎ করে বিকেলের মিষ্টি কমলা রোদ তার এক বন্ধুর মুখে পড়তে দেখল সে। সঙ্গে সঙ্গে সে পকেট থেকে মোবাইল বের করে একটা ছবি তুলে ফেলল। ছবি তোলার এমন দৃশ্য তো এখন আমরা অহরহই দেখি। কিন্তু পকেটের ফোনে এই ক্যামেরা আসার আগে ক্যামেরাকে কিন্তু একটা বড় পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
বিভিন্ন রকম আলো দিয়ে ছবি তোলা হয়। এই আলো যত দিন কোনো মাধ্যমে সংরক্ষণ করা যেত না, তত দিন কাগজে পেনসিল ঘষে ঘষে ছবি আঁকা হতো। আলো সংরক্ষণ করার এই মাধ্যম হলো ক্যামেরা।
আচ্ছা, আমরা কি খালি আলোই দেখব, নাকি আলোর সঙ্গে অন্য কিছুও দেখব। আলোর মধ্যে যদি আলো দেখি, তাহলে তো আর কিছু সংরক্ষণ করা গেল না। এই আলোকে অন্যভাবে দেখার চিন্তা থেকেই প্রথম তৈরি হয় ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’, যা পিনহোল ক্যামেরার পূর্বরূপ। ক্যামেরা অবসকিউরা হলো একটা বদ্ধ অন্ধকার কক্ষ, যেখানে একটা সরু ছিদ্রের মাধ্যমে আলো প্রবেশ করে বিপরীত দেয়ালে আলোর প্রতিফলন সৃষ্টি করে। আরব পণ্ডিত আবু আলি-আল-আসান ইবনে আল-আসান ইবনে আল হায়থাম (৯৬৫-১০৪০ খ্রিঃ), ১০১২ থেকে ১০২১ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে লেখা তাঁর বই ‘বুক অব অপটিকস’–এ (কিতাব আল-মানাযির) আলোর এই প্রতিফলনের কথা উল্লেখ করেন। তিনি ‘আল বাইত আল মুথলিম’ শব্দটি তাঁর বইয়ে ব্যবহার করেন, যার অর্থ ‘অন্ধকার কক্ষ’। তিনি এটি পরীক্ষা করার জন্য একটি কক্ষ পুরো অন্ধকার করে জানালায় সরু ছিদ্র করে সূর্যগ্রহণ দেখতে পান। কিন্তু সূর্যগ্রহণের প্রতিবিম্ব ছিল উল্টো। সেই সঙ্গে সেটি ছিল চলমান প্রতিবিম্ব।
ক্যামেরা অবসকিউরা পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের কাছে সূর্যগ্রহণ পর্যবেক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতে থাকে। সেই সঙ্গে এটি চিত্রশিল্পীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, যা ‘ক্যামেরা লুসিডা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ক্যামেরা লুসিডায় প্রিজম এমনভাবে লাগানো থাকে, যেটা চিত্রশিল্পীদের আরও নিখুঁতভাবে ছবি আঁকতে সাহায্য করে।
এভাবে আলোকচিত্রের ধারণা উদ্ভাবন হয়। সময়ের পরিবর্তনের আলো নিয়ে নানা ধরনের পরীক্ষা হয়। পরে উনিশ শতকের শুরু দিকে জোসেফ নিপসে বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে আলোকে সংরক্ষণ করতে সক্ষম হন। যে ছবিটি প্রথম সংরক্ষিত ছবি হিসেবে পরিচিত, সেটি ছিল তাঁর বাসার জানালা থেকে অন্য জানালার ছবি। টানা আট ঘণ্টার এক্সপোজার দেওয়ার কারণে এবং সূর্যের অবস্থান পরিবর্তনের জন্য বিল্ডিংয়ের দুই পাশই দেখতে পাওয়া যায়।
অন্যদিকে, লুইস দ্যাগুয়েরো নিজের চেষ্টায় ছবি সংরক্ষণের কাজ চালান। তাঁর প্রচেষ্টা তাঁকে পরবর্তীকালে ১৮২৯ সালে নিপসের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে ধাবিত করে। তাঁরা বিভিন্ন পরীক্ষা করতে থাকে। তারপরও ছবি একবারে স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করতে পারতে ব্যর্থ হন। এরপর ১৮৩৫ সালে নিপসে মারা গেলে দ্যাগুয়েরো একাই কাজ চালিয়ে যান। তিনি বিভিন্ন মাধ্যমে আট ঘণ্টার এক্সপোজার ৩০ মিনিটে নিয়ে আসেন এবং ১৮৩৭ সঙ্গে ছবি সম্পূর্ণরূপে স্থায়ী করতে সফল হন। সেই ছবির ডিটেল ছিল অতুলনীয়। পরে দ্যাগুয়েরো নিপসের ছেলের সঙ্গে চুক্তি করে সেই ক্যামেরার নাম দেন ‘দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরা’। নিপসের ছেলে ও দ্যাগুয়েরো ১৮৩৯ সালে দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরা ফ্রান্স সরকারের কাছে বিক্রি করে দেন। পরে ওই বছর ১৯ আগস্ট ফ্রান্স সরকার আলোকচিত্রের চর্চা পুরো পৃথিবীর জন্য উন্মুক্ত করে দেয়। তাই ১৯ আগস্ট বিশ্ব আলোকচিত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরার ছবি হলো ভীষণ স্পষ্ট, কিন্তু একটা বড় সমস্যা ছিল যে একটা নেগেটিভ থেকে একটা ছবি প্রিন্ট করা যেত। যেটি ছিল ওয়েট প্লেট নেগেটিভ। এই সমস্যার সম্মুখীন হন উইলিয়াম হেনরি ফক্স ট্যালবর্ট তাঁর রিসার্চের সময়। তাই তিনি নিজে আবার গবেষণা শুরু করেন এবং কাগজে ছবি তোলার চেষ্টা করেন। তিনি আলো সংবেদনশীল কাগজ তৈরি করতে সফল হন। তিনি তাঁর এই ক্যামেরার নাম দেন ‘ক্যালোটাইপ ক্যামেরা’। ক্যালোটাইপ ক্যামেরার পেপার নেগেটিভ থেকে অনেক ছবি প্রিন্ট করা যেত। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা ছিল। ক্যালোটাইপ ক্যামেরার ছবি বেশি স্পষ্ট ছিল না।
একাধারে পুরো বিশ্বে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু হয়। মজার বিষয় হলো আলোকচিত্রের চর্চা উন্মুক্ত হওয়ার এক বছরের মধ্যেই ভারতবর্ষে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু হয়। সেই সঙ্গে দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরার ওপর কাজ হতে থাকে। ১৮৫০ সালে ওয়েট প্লেট নেগেটিভ থেকে ওয়েট প্লেট গ্লাস নেগেটিভ আবিষ্কৃত হয়, যার মাধ্যমে দ্যাগুয়েরোটাইপ ক্যামেরায় তোলা স্পষ্ট নেগেটিভ থেকে অনেকবার ছবি প্রিন্ট করা সক্ষম হয়।
স্টিল ও পোর্ট্রেট ছবির পাশাপাশি আলোকচিত্র বিভিন্ন মুভমেন্ট যোগ হতে থাকে। এই মুভমেন্টের ছবি তোলার জন্য এডওয়ার্ড মুয়াইব্রিজ ১২ থেকে ২৪টি ক্যামেরা পাশাপাশি রেখে একসঙ্গে সাটার রিলিজ করে ছবি তোলেন। তাঁর এই কাজের সূত্র ধরে তৈরি হয় ‘ক্রোনফটোগ্রাফিক গান’। এই ক্যামেরা দিয়ে একসঙ্গে ১২টি করে ছবি তোলা সম্ভব হতো।
এত দিন ধরে কেউ শখে, আবার কেউ পেশা হিসেবে আলোকচিত্রের চর্চা শুরু করেন। বিশ শতকের শুরুর দিকে ‘কোডাক ব্রাউনি’ ব্যবসায়িক উদ্যোগে ক্যামেরা বিক্রি শুরু করে। বড় বক্স ক্যামেরা থেকে ক্যামেরা তখন ছোট হয়ে দুই হাতের মধ্যে চলে আসে। ক্যামেরার আকার ছোট হওয়ার পাশাপাশি ফিল্মের আকারও ছোট হতে থাকে। আলোকচিত্রে স্ন্যাপশটের যাত্রা শুরু হয়।
আস্তে আস্তে ক্যামেরার আকৃতি পরিবর্তন হয়। বক্স ক্যামেরা থেকে এসএলআর ক্যামেরা হয়। অ্যানালগ ফিল্ম থেকে ডিজিটাল সেন্সর যুক্ত হয় ক্যামেরায়। আবার সেই সেন্সর ছোট হতে হতে সংযোজিত হয় মুঠোফোনে। ২০০০ সালে আবিষ্কৃত হয় প্রথম ক্যামেরা ফোন।
বর্তমানে ক্যামেরা আমাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। আমাদের সবার কাছেই বিভিন্ন রকমের ক্যামেরা রয়েছে, যা আমাদের নানা স্মৃতি ধারণ করতে সাহায্য করে। আমরা চাইলে ছবি তুলে নিজের কাছে রেখে দিতে পারি, আবার প্রিন্ট করে সাজিয়ে রাখতে পারি। আমাদের জীবনের একটা বড় অংশে জড়িয়ে আছে এই ক্যামেরা।
সূত্র: ব্রিটানিকা, হিস্ট্রি অব ইনফরমেশন, ইবনে আল হায়থাম ডট কম ও স্প্রাস ক্র্যাফটস