নরওয়ের লেমিংরা দল বেঁধে আত্মহত্যা করে। তা ওদের আত্মহত্যা করারই কথা কিনা! চৌদ্দ শ পুরুষ ধরে দলে দলে এভাবে জীবন দিয়ে আসছে। তাদের বংশধরেরা এভাবে বীরের মতো জীবন উত্সর্গ না করলে কি আর বাপ-দাদার মুখ রক্ষা হয়! কিন্তু কেন ওরা আত্মহত্যা করে? ওদের জিনের ভেতর কী এমন বৈশিষ্ট্য লুকিয়ে আছে, যার জন্য কাতারে কাতারে সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে এই ইঁদুরজাতীয় প্রাণীরা? এ প্রশ্নের উত্তর অজানা। নরওয়েতে হ্যামিলন শহর নেই, নেই কোনো বাঁশিওয়ালাও। তবু কোন অদৃশ্য বাঁশির সুরে পাগল হয়ে মাইলকে মাইল দূর থেকে ছুটে আসে লেমিংয়ের পাল। ঝাঁকে ঝাঁকে খাড়া পাহাড়ের চূড়া থেকে লাফিয়ে পড়ে। ওরা কি শান্তির মৃত্যু চায়? কিন্তু এভাবে তো শান্তিতে মরা যায় না! পানিতে হাবুডুবু খেতে খেতে দুর্বিষহ কষ্ট সয়ে লেমিংদের প্রাণ যায়। তার আগে তারা সমুদ্রের উত্তাল ছোট ছোট ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে। শেষনিশ্বাস ফেলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করে যায় বুক চিতিয়ে। আরে ব্যাটা, বাঁচার জন্য অত লড়াই-ই যদি করবি, তাহলে অন্ধের মতো সাগরে লাফিয়ে পড়া কেন!
ওয়াল্ট ডিজনি একটা ছবি বানিয়েছিল লেমিংদের এই আত্মহত্যা নিয়ে। তাতেই এই বিষয় বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপক পরিচিতি পায়।
লেমিং যেমন আছে নরওয়েতে, আছে উত্তর আমেরিকায়, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অন্য দেশগুলোতেও। কিন্তু কোথাও নরওয়ের মতো এমন গণ-আত্মহত্যার নজির নেই। ওহ, ধান ভানতে শিবের গীত হয়ে গেল! এসেছিলাম প্রোফেসর শঙ্কুর ভুল ধরতে, চলে এল সাত সাগর তেরো নদীর ওপারের কোন ধেড়ে ইঁদুরের আত্মহত্যার খবর!
ধান ভানতে গিয়েও শিবের গীত হয়, তাতে ঢেঁকিতে পাড় দেওয়ার ক্লান্তি ভুলে থাকা যায়। লেমিংদের খবর প্রোফেসর শঙ্কুর ভুলের খবরের আগে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি করে। শঙ্কু এই ধেড়ে ইঁদুরদের আত্মহত্যার খবর খুঁজতে গিয়েই পড়ে গিয়েছিলেন ভুলের খপ্পরে। যে ভুলের শুরুটা হয়েছিল শঙ্কুর বন্ধু ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আর্চিবিল্ড অ্যাকরয়েডের হাত ধরে। অ্যাকরয়েড গিয়েছিলেন লেমিংদের আত্মহত্যা–রহস্যের অনুসন্ধান করতে। রহস্য তো ভাঙেইনি, বরং নিজেই হাপিস হয়ে জন্ম দিয়েছিলেন নতুন রহস্যের।
অ্যাকরয়েড কেন নিখোঁজ হলেন, তিনি কি বেঁচে আছেন? এ প্রশ্নগুলো শঙ্কুকে বিচলিত করে। সঙ্গে লেমিংদের আত্মহত্যার রহস্য তো আছেই। তাই সব মিলিয়ে নরওয়ে হয়ে ওঠে শঙ্কুর কাছে এক গভীর ধাঁধার নাম। কিন্তু চাইলেও তো নরওয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বিমানভাড়াও তো কম নয়। টাকাপয়সা শঙ্কুর তেমন ছিল না। শঙ্কু প্রায়ই এক ঢিলে দুই পাখি মারতেন, অন্যের খরচে চলে যেতেন ভিনদেশে। তারপর জড়িয়ে পড়তেন নতুন কোনো রহস্যের জালে।
সুইজারল্যান্ডের এক বিশ্ববিদ্যালয় শঙ্কুকে সম্মাননা দেয়। তাদের খরচেই শঙ্কু চলে যান উত্তর ইউরোপে। সুইজ্যারল্যান্ড থেকে নওরওয়ে কয়েক ঘণ্টার পথ মাত্র। ইউরোপের দেশগুলোতে ভিসা–জটিলতা নেই বললেই চলে। তাই শঙ্কু মনস্থির করেন, নরওয়ে যাবেন। একই সঙ্গে করবেন বন্ধুর অন্তর্ধান আর লেমিংদের আত্মহত্যা–রহস্যের অনুসন্ধান। কিন্তু নরওয়ে–যাত্রার আগেই পরিচিত হন সেখানকার এক শিল্পীর সঙ্গে। নাম গ্রেগর লিন্ডকুইস্ট। শিল্পী বলতে যেমন খেয়ালি, কাজপাগল কোনো চিত্রশিল্পী বা ভাস্করের চেহারা ভেসে ওঠে মনে, লিন্ডকুইস্ট মোটেও সে ধরনের শিল্পী ছিলেন না। বিখ্যাত ব্যক্তিদের খুদে পুতুল-মূর্তি বানাতেন। সেটাও তো শিল্প! তাঁর পুতুলগুলো এতটাই জীবন্ত মনে হয়, লোকটার প্রতি একধরনের শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হয় শঙ্কুর মনে। আসলে লোকটা মহা ধড়িবাজ। শিল্পের ‘শ’ তো জানেনই না, বরং বহু লোকের অনিষ্ট করে জীবন হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন। সেই লোকটাই কি না শঙ্কুকে পটিয়ে ফেলেন! তাঁর একটা পুতুল বানিয়ে সাজিয়ে রাখতে চান নিজের শোকেসে। শঙ্কুও তাঁর ভোলাভালা চেহারা আর শিল্পের নমুনা দেখে রাজি হয়ে যান। সুইজারল্যান্ড থেকে সোজা গিয়ে ওঠেন নরওয়ের সুলিটেলমা শহরে, লিন্ডকুইস্টের বাড়িতে।
শঙ্কুকে ধড়িবাজ লোকটা বুঝিয়েছিলেন, তিনি নিজেই লেমিংদের রহস্য ভেদ করতে সাহায্য করবেন। আদর-যত্নের ত্রুটিও করেননি। শুধু আদর-যত্নে তো আর শঙ্কুর মন গলানো যায় না, বরং তাঁর বৈজ্ঞানিক মন সব সময় খুঁতখুঁত করে। লিন্ডকুইস্টেও পুতুলের সংগ্রহ দেখে যেমন মুগ্ধ হন, তেমনি কিসের জানি একটা রহস্যের গন্ধও পান। পুতুলের সারিতে তাঁর বন্ধু অ্যাকরয়েডও আছেন। পুতুলগুলো বড্ড জীবন্ত মনে হয় শঙ্কুর কাছে। মনে হয়, তারা বুঝি এখনই কথা বলে উঠবে।
সন্দেহ থেকেই শঙ্কু জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাতদুপুরে হানা দেন লিন্ডকুইস্টের পুতুলের ঘরে। সেখানে গিয়ে তো হতবাক! পুতুলগুলো পুতুল নয়, সত্যিকারের মানুষ! লিলিপুট আকারের মানুষ। তারা কথা বলছে দিব্যি, নড়াচড়াও করছে। লিলিপুট আকারের অ্যাকরয়েডের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই কেঁচোর গর্তে সাপের দেখা পান শঙ্কু। পুতুলগুলো আসলে পুতুল নয়। জলজ্যান্ত মানুষকে কী একটা ইনজেকশন দিয়ে লিলিপুট পুতুলে পরিণত করেছে! অ্যাকরয়েড শঙ্কুকে সাবধান করে পালিয়ে যেতে বলেন, নইলে তাঁর পরিণতিও হবে পুতুলদের মতো। কিন্তু শঙ্কু পালাতে পারেন না। তার আগেই পেছন থেকে ইনজেকশন বিঁধে যায় শঙ্কুর কাঁধে। মিনিটের মধ্যেই সাড়ে পাঁচ ফুট উচ্চতার শঙ্কু পরিণত হন ছয় ইঞ্চির পুতুলে। তারপর কী হয়েছিল? ‘প্রোফেসর শঙ্কু ও আশ্চর্য পুতুল’ গল্পটা যারা পড়েছ, তাদের অজানা নয়। যারা পড়োনি, আজই পড়ে ফেলো।
শঙ্কু তো লিলিপুটে পরিণত হলেন, চরম নাটকীয়তার মধ্যে পড়ে আবার স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হন, কিন্তু ভুলটা কোথায়? এখানেই আসলে ভুল।
শঙ্কু নাহয় ইনজেকশনের প্রভাবে ছোট হয়ে গেলেন, তাঁর শরীরে রাসায়নিক প্রভাবে অণুগুলো নাহয় সংকুচিত হলোই, কিন্তু তাঁর পোশাক? পোশাক ছোট হলো কীভাবে? ওখানে যতগুলো পুতুল ছিল, সব কটি পুতুলের পোশাকই তাদের নিজেদের। লিন্ডকুইস্ট নিজ হাতে কারও পোশাক পরাননি।
এটা কল্পবিজ্ঞানের হিসাবের ভুল। শঙ্কুর ভুল বলছি ঠিকই, ভুলটা আসলে শঙ্কুর নয়, ভুলটা শঙ্কুর স্রষ্টা সত্যজিৎ রায়ের। এখন কথা হলো ভুলটা সত্যিই ভুল, নাকি সত্যজিৎ রায় ইচ্ছা করেই ভুলটা করেছিলেন?
দুটোই হওয়া সম্ভব। তবে আমরা ধরে নিতেই পারি, সত্যজিৎ রায় ইচ্ছা করেই ভুলটা করেছিলেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন, পাঠক গল্পের নাটকীয়তায় এতটাই মজে থাকবেন, কারও চোখে এতটুকু ভুল চোখে পড়বে না। ঠিক এমনটাই করেছিলেন বিশ্ববিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক এইচ জি ওয়েলস। তাঁর অমর সৃষ্টি অদৃশ্য মানব গ্রিফিন সাধারণ মানুষের মতোই চোখে দেখতে পেত। অথচ যার শরীর অদৃশ্য, তার রেটিনার কোথাও আলো বাধা পাওয়ার কথা নয়। সুতরাং অদৃশ্য মানবের রেটিনায় কোনো বস্তুর প্রতিবিম্বও তৈরি হতে পারে না। প্রতিবিম্ব তৈরি না হলে তার কিছু দেখতে পাওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ অদৃশ্য মানবকে যেমন কেউ দেখতে পায় না, তেমনি সে–ও কিছু দেখতে পায় না। মানে, অদৃশ্য মানব নিজেও অন্ধ হবে। অদৃশ্য মানব পড়তে গিয়ে পাঠক কাহিনির ভেতর এতটাই বুঁদ হয়ে থাকেন, এই ত্রুটি অধিকাংশের মাথায় আসে না। তেমনি শঙ্কুর এ কাহিনিতে সত্যজিৎ রায়ও হয়তো সচেতনভাবেই ভুলটা রেখেছিলেন।