এক দেশে এক রাজা ছিল। রাজার সাতটি মেয়ে ছিল। সবাই বেশ সুখে-শান্তিতেই বসবাস করছিল। হঠাৎ একদিন দেশে যুদ্ধ লেগে গেল। আর তাদের বাঁচাতে হাজির হলো সাত রাজপুত্র। যুদ্ধ জিতে তারা রাজ্যকে বাঁচাল, পরে খুশি হয়ে রাজা তার মেয়েদের রাজপুত্রদের সঙ্গে বিয়ে দিলেন। এরপর সবাই সুখে–শান্তিতে বসবাস করতে লাগল।
এ রকম রাজা–রানি, রাক্ষস-খোক্কস, শিয়াল পণ্ডিতের গল্প ছোটবেলায় শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে যেত তোমাদের। বাস্তবে এমন ঘটনার অস্তিত্ব না থাকলেও ঘুম ঘুম চোখে গল্পগুলো সবার চোখে ভাসত ছোটবেলায়।
অ্যানিমেটেড মুভি ট্যাঙ্গেলড, ফ্রোজেন কিংবা সিন্ডারেলা মতো নারী চরিত্রকেন্দ্রিক মুভিগুলোর মতো আজকের প্রিন্সেসের মিল অনেক।
ইয়োশিকো কাওয়াশিমার জীবনটা মুভির মতো। চায়নিজ এই প্রিন্সেসের জন্ম বিশ শতকের শুরুর দিকে। চিং রাজবংশের পতনের মুখে যার ঠিকানা হয়েছিল জাপান। বলা ভালো, চিংরা সতেরো শতকের দিকে মিং রাজবংশকে পরাজিত করে ক্ষমতায় আসে। ইয়োশিকোর জন্ম হতে হতে সেই ২০০ বছরে চিংদের রাজত্ব বেশ দুর্বল হয়ে পড়েছিল।
পরবর্তী সময়ে চিং রাজবংশের পতনের মধ্য দিয়েই ১৯১১ সালে ‘রিপাবলিক অব চায়না’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইয়োশিকোকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় জাপানে, তাঁর বাবার বন্ধুর কাছে। যখন তাঁর বয়স আটের কাছাকাছি। ছোট্ট ‘আইসিন গিয়োরো শিয়ানইয়্যু’র নাম হয়ে যায় ‘ইয়োশিকো কাওয়াশিমা’, যে নামে সবাই তাঁকে চেনে।
কিন্তু প্রিন্সেস তো প্রিন্সেসই। নাম পাল্টালেও স্বভাব তো আর পাল্টায় না! ইয়োশিকো স্কুলে যেতেন ঘোড়ায় চড়ে, কাপড় পরতেন ছেলেদের মতো। বব কাট দেখে অনেকে তো ছেলে ভেবেও ভুল করত।
তখনকার সময়ের মেয়ের থেকে আলাদা ছিলেন ইয়োশিকো। হয়তো প্রিন্সেস হওয়ার জন্যই! ইয়োশিকো বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ হিরোইন ‘জোয়ান অব আর্ক’-এর মতো হতে চাইতেন। গল্পে গল্পে স্কুলের বাচ্চাদের কাছে বলতেন, আমার যদি তিন হাজার সৈন্য থাকত, তবে আমি চীন দখল করে নিতাম!
ইয়োশিকোর দত্তক বাবা কিন্তু এসব খেয়াল করতেন। তিনি বারণ না করে বরং উৎসাহ দিতেন। বলতেন, চীনে ফিরে পরিবারের ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করতে হবে।
১৯৩১ সালের কথা। ২৪ বছর বয়সী ইয়োশিকোর জীবন স্বাভাবিকভাবেই চলছিল। ঘুরে বেড়ানো, নাচ-গান-আড্ডা। আর আয়ের জন্য কাজের সন্ধান। ঠিক সে সময় তিনি ডাক পেয়েছিলেন জাপানি কুয়ান্তাং আর্মির।
কোরিয়ার পাশেই অবস্থিত মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে জাপানের কুয়ান্তাজ আর্মির নজর ছিল অনেক দিনের। কারণ, সেটা ছিল জাপানি এম্পায়ারের সম্পত্তি। ইয়োশিকোর মঙ্গোলিয়ান আর মাঞ্চুরিয়ান মিশ্রণের সঙ্গে অ্যাডভেঞ্চারের নেশা ও ছেলে ছদ্মবেশ ধারণের ক্ষমতা আর্মির চোখে পড়ে। জাপানি মিলিটারি ইন্টেলিজেন্সে তিনি জেনারেল কেনজি দোইহারার সঙ্গে কাজ শুরু করেন।
মিশন শুরুতেই মাঞ্চুকুওর বিতাড়িত কিং (Qing) রাজত্বের রাজা পিয়্যুকে রাজত্ব গ্রহণের জন্য রাজি করান ইয়োশিকো। যার ফলে ওই অঞ্চলে আবার ক্ষমতা দখল করা হয়। এভাবেই শুরু হয় ইয়োশিকোর অ্যাডভেঞ্চার।
ধীরে ধীরে জাপানিরা ইয়োশিকোকে পাবলিক ফিগার বানিয়ে ফেলে। ১৯৩৩ সালের বিখ্যাত উপন্যাস দ্য বিউটি ইন মেনস ক্লদিং বইটি ছিল ইয়োশিকোকে নিয়েই লেখা। ইয়োশিকো জাপানে ফিরে অংশ নেন বিভিন্ন রেডিও অনুষ্ঠানে, এমনকি তাঁর মঙ্গোলিয়ান লোকগীতির অ্যালবামও মুক্তি পায়।
ইয়োশিকো কিন্তু নিজের পরিচয়ে চায়নিজ প্রিন্সেস ও জাপানের হিরোর কথা বলতেন। কিন্তু ১৯৪০ সাল নাগাদ জাপানিরা মনে করে, এই প্রিন্সেসের প্রয়োজনীয়তা আর নেই।
দৃশ্যমান এই গুপ্তচর আর কাজে আসবে না। ঘটনাক্রমে ১৯৪৫ সালে তাঁকে হাউস অ্যারেস্টে রাখা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৪৮ সালের ২৫ মার্চ ইয়োশিকো কাওয়াশিমাকে জেলের কোর্ট ইয়ার্ডে গুলি করে হত্যা করা হয়।
চীনা হয়েও চীনের মানুষের কাছে বিশ্বাসঘাতক আর জাপানিদের কাছে হিরো ইয়োশিকো। কিন্তু এসব বিষয় বাদ দিলে তাঁর সারভাইভালের ক্ষমতা, সৌন্দর্য, কৌশল, এমনকি গোপনে পালিয়ে যাওয়ার গুজবও মানুষের মুখে মুখে ঘুরতে থাকে। অনেকের কাছে ভালো, অনেকের কাছে খারাপ খেতাব পাওয়া ইয়োশিকো কাওয়াশিমার জীবনের ইতি ঘটে এখানেই!