প্রাকৃতিক পরিবেশে কিংবা বসতবাড়ির আশপাশের সবুজ গালিচায় এমনি এমনি যে মাশরুম জন্মায়, তাকে আমরা ব্যাঙের ছাতা বলে কতই-না তুচ্ছ-তাচ্ছিল্ল করি। কুসংস্কার আর অজ্ঞতার বশে অনেকেই সেগুলো হাত দিয়ে ছঁুতে ভয় পাই। অজানা অসবুজ এই উপাদান আসলে মোটেই তুচ্ছ নয়। প্রকৃতিতে অল্প সময়ের জন্য এর আবির্ভাব হলেও এর সংখ্যা কিন্তু কম নয়। প্রকৃতিতে কী পরিমাণ মাশরুম আছে, তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। আমেরিকার মাশরুম বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি বলেছেন, শুধু উত্তর আমেরিকাতেই ১০ হাজার প্রজাতির মাশরুম আছে। এসব মাশরুমের বেশির ভাগই এখনো অনাবিষ্কৃত। বিজ্ঞানীরা আরও বলছেন, এসব মাশরুমের শতকরা ৫০ ভাগ খাওয়ার যোগ্য, ২০ ভাগ তোমাকে অসুস্থ করে দেবে, ৪ ভাগ চমৎকার রকমের সুস্বাদু, ১ ভাগ তোমাকে মেরে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
মাশরুম মূলত উচ্চশ্রেণির ছত্রাকের ফুল বা ফল। প্রশ্ন জাগতে পারে, এগুলো যদি ফুল-ফল হবে, তাহলে এর গাছ কই? প্রাণীর হাত-পায়ের মতো কিংবা সবুজ উদ্ভিদের ডালপালার মতো এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেই। ছত্রাকের দেহ মূলত সুতার মতো আণুবীক্ষণিক মাইসেলিয়াম দ্বারা গঠিত। এই দেহকাঠামো আমাদের অগোচরেই জৈববস্ত্তসমৃদ্ধ মাটিতে, উদ্ভিদের জীবিত বা মৃত কাঠের ভেতর জন্মাতে থাকে। বছরের বিভিন্ন আবহাওয়ায় অনুকূল সময়ে এগুলো তাদের বংশবিস্তারের জন্য এই মাশরুমের উৎপাদন করে। উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে যেমন বৈচিত্র্য আছে, তেমনি এই মাশরুমের মধ্যে অনেক বৈচিত্র্য আছে।
হাজার হাজার জাতের মাশরুমের মধ্য থেকে এ পর্যন্ত আমরা খাওয়ারযোগ্য দুই হাজার জাতের মাশরুমের নাম জানি। বিভিন্ন বর্ণের-গন্ধের খাওয়াারযোগ্য এবং বিষাক্ত মাশরুম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে রয়েছে। বসতবাড়ির আশপাশে কিংবা গহিন অরণ্যে—সর্বত্র মাশরুমের ছড়াছড়ি। তাই অনেক সম্ভাবনাময় খাবার হওয়া সত্ত্বেও ভালোভাবে না জেনে ভুল করে এগুলো খাওয়া উচিত নয়। আমরা অনেক ভুল বারবার করার সুয়োগ পাই, কিন্তু বিষাক্ত মাশরুম খাবার ভুলটি মাত্র একবারই সম্ভব।
বিষাক্ত মাশরুমেরও রয়েছে চমৎকার সব নাম। একটি মাত্র মাশরুম একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট, ছত্রাক তত্ত্ববিদেরা এমন মাশরুমের নাম দিয়েছে ‘ডেথ ক্যাপ’, বাংলায় এর নাম হতে পারে ‘মরণ টুপি’। একইভাবে ইংরেজরা আরেকটি মাশরুমের নাম দিয়েছে ‘ডেস্ট্রইং অ্যাঞ্জেল’, বাংলায় বলা যায় ‘মৃত্যুর দেবতা’! বিষাক্ত মাশরুমের খুব সুন্দর একটি প্রজাতির নির্যাস দিয়ে মাছি নিধনের প্রাগৈতিহাসিক চর্চার কথা জেনে ছত্রাক তত্ত্ববিদেরা এর নাম দিয়েছেন ‘ফ্লাই অ্যাগারিক’, বাংলায় এর কী নাম দেওয়া যায় বলো তো।
বেশির ভাগ বিষাক্ত মাশরুমই বিভিন্ন বনে নির্দিষ্ট কিছু উদ্ভিদের শিকড়ের সঙ্গে সহাবস্থান করে বেড়ে ওঠে। খুব বেশি আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই, বসতবাড়ির আশপাশে এমন জীবনহরণকারী মাশরুম পাওয়া যায় না। কিছু মাশরুম অল্পবিস্তর বিষাক্ত, যেগুলো জীবন কেড়ে নেবে না, তবে কয়েক দিনের জন্য পেটের পীড়া হতে পারে। কিছু কিছু খাবারযোগ্য মাশরুমও ভালোভাবে রান্না না করলে হজমে সমস্যা হতে পারে। আমাদের বাঙালিদের তেমন ভয়ের কিছু নেই। কেননা, আমরা সবকিছু বেশ ভালোভাবে রান্না করে খেতেই অভ্যস্ত।
মাশরুম প্রধানত মৃতজীবী, তবে উদ্ভিদের জন্য ক্ষতিকর পরজীবী মাশরুমও রয়েছে। আবার কিছু মাশরুম বিভিন্ন উদ্ভিদের শিকড়ের সঙ্গে উপকারী সহাবস্থান করে বেড়ে ওঠে। কিছু মাশরুম অপর মাশরুমের ওপর পরজীবী হিসেবে বেড়ে উঠতেও দেখা যায়। প্রাণীর মৃতদেহ থেকেও মাশরুম গজিয়ে ওঠে। এ এক আজব রহস্যময় গবেষণার ফাঁকা মাঠ! তোমরা কি এই রহস্যময় মাঠে বিচরণ করতে চাও?
কিছু কিছু মাশরুম অনেক ছোট হওয়ায় সেগুলো কখনোই খাবার কথা চিন্তা করা হয়নি। কিন্তু কে জানে ওই সব মাশরুমের মধ্যেই হয়তো রয়ে গেছে মহামূল্য কোনো ঔষধিগুণ, যেটি এখনো আবিষ্কৃত হয়নি! উদার প্রকৃতি আমাদের চারপাশে তো আর এমনি এমনি এত সব আয়োজনের পসরা সাজিয়ে রাখেনি। এখনকার প্রজন্মই হয়তো একদিন প্রকৃতির এই অবহেলিত ক্ষণস্থায়ী উপকরণ থেকে মহামূল্যবান মাশরুম খঁুজে পাবে, আমরা সে জন্য অপেক্ষা করছি। উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়ে সবচেয়ে বেশি গবেষণা হয়েছে। ছত্রাক বা ফাঙ্গাল কিংডম নিয়ে খুবই কম গবেষণা হয়েছে। কম গবেষণার অনেক কারণের মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে প্রকৃতিতে এর ক্ষণস্থায়ী অবস্থান। সারা বছর মাশরুমের মূল দেহকাঠামো মাটি, কাঠ বা অন্যান্য উদ্ভিজ্জ উপকরণের মধ্যে নিভৃতে বেড়ে ওঠে। অল্প সময়ের জন্য এর ফুল বা ফলকে আমরা মাশরুম হিসেবে দেখতে পাই। মাশরুমটির বংশ বৃদ্ধির জন্য এতে তৈরি হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্পোর। অনুকূল পরিবেশে এই স্পোর অঙ্কুরিত হয়ে মাশরুমের মাইসেলিয়াম গঠন করে। ক্ষণস্থায়ী মাশরুম ছাড়াও বিভিন্ন মৃত এবং জীবিত উদ্ভিদে কাষ্ঠল প্রকৃতির মাশরুম জন্মাতে দেখা যায় এগুলোকে ব্র্যাকেট মাশরুম বলে। পৃথিবী বিখ্যাত গ্যানোডার্মা মাশরুম এই ধরনের। গ্যানোডার্মাসহ আরও কিছু মাশরুম আছে, যেগুলো সবজি হিসেবে খাওয়া যায় না। তবে এদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গুণাগুণ। তবে সবজি হিসেবে খাওয়া হয়—এমন মাশরুমেও রয়েছে অনেক ঔষধি গুণাগুণ। আমাদের দেশের পাহাড়ি আদিবাসীরা মাশরুমকে দেবতার উপহার হিসেবে বিবেচনা করে এবং প্রতিবছর গ্রীষ্ম-বর্ষায় বসতবাড়ির আশপাশে ও পাহাড়ের মাশরুম সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। আমাদের পাহাড়িরাও ভুল করে বিষাক্ত মাশরুম খেয়ে অসুস্থ হয়। কিন্তু তারা মাশরুম খুবই পছন্দ করে, যে কারণে জীবনের ঝঁুকি নিয়ে এরা মাশরুম খায়। আমাদের কিছু পাহাড়ি নৃগোষ্ঠী এবং বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লোকজন ছাড়া অন্যান্য জনগোষ্ঠী মাশরুম খেতে খুব বেশি অভ্যস্ত নয়। আমাদের প্রতিবেশী চীনে পৃথিবীর ৪৬ শতাংশ মাশরুম উৎপাদিত হয়। মজার বিষয় হচ্ছে চীনারা তাদের উৎপাদিত মাশরুমের ৯৫ শতাংশই নিজেরা খায়, মাত্র ৫ শতাংশ রপ্তানি করে। চীন কি এ জন্যই এত এগিয়ে যাচ্ছে? আমাদের তো মাশরুম খেতে হয়! খেতে হলে এর উৎপাদন বাড়াতে হবে। উচ্চ ফলনশীল জাত তৈরি করতে হবে। তবে সবার আগে গবেষণা করে এ-ও দেখতে হবে, প্রকৃতি আমাদের কী কী মুল্যবান মাশরুম দিয়েছে, যাদের আমরা এখনো চিনতেই শিখিনি!