প্রতিদিনের শব্দগুলো

শব্দের অর্থ সব সময় এক রকম থাকে না। শব্দ চিরকাল একই অর্থ বহন করে না। তাই শব্দের অর্থ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে, আগে থেকে তা বলা বেশ মুশকিল। শব্দের অর্থের পরিবর্তন ঘটতে কত দিন লাগতে পারে, তা আগে থেকে বলা একেবারে অসম্ভব। ১০০ বছর লাগতে পারে, আবার ৫০০ বছরও লাগতে পারে। কিংবা তারও বেশি। ভাষার শব্দ গতিময়। মুখ ও কলমের মাধ্যমে তার গতিময়তা প্রকাশ পায়। শব্দ গতিহীন হলে তার ঠাঁই হয় অভিধানে। প্রতিভাবান কোনো কবি বা লেখকের কলমে সেই শব্দ গতি ফিরে পেতে পারে। বদলে যেতে পারে তার অর্থও। আবার, তা ঠিকও থাকতে পারে। শব্দের মতিগতি বোঝা অসম্ভব। ‘অভিধানের গল্প’তে শব্দের সেই মতিগতি বুঝে ওঠার চেষ্টা করা হয়।
অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

বিমান

বিমান হলো আকাশে ওড়ার বাহন। এই বাহনটিকে আগে বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হতো। যেমন ব্যোমযান, বিমানপোত ইত্যাদি। অনেক ওড়াউড়ির পর আকাশকে আত্মসাৎ করে বাহনটির নাম হয় বিমান। পরে উড়োজাহাজ। বাংলাদেশে, রাষ্ট্রীয় আকাশযান সংস্থা—বাংলাদেশ বিমানের কল্যাণে, বিমান শব্দটা এখন বিমানযাত্রীদের মুখে মুখে। তবে সাধারণ মানুষের মুখে এখনো তা উড়োজাহাজ।

আকাশকে আত্মসাতের কথাটা বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। তাই খুলে বলি। বিমান শব্দের মূল অর্থ হলো আকাশ। বিমান আবিষ্কারের আগে পর্যন্ত বিমান বলতে শুধু আকাশকেই বোঝাত। তারপর, কী যে হলো, আকাশযান হয়ে গেল বিমান।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

ফায়দা

সংসারে ফায়দা লোটার লোকের অভাব নেই। তারা সর্বদাই তক্কে তক্কে থাকে কখন-কীভাবে ফায়দা ওঠানো যায়।

ফায়দা শব্দের আরও অনেক ব্যবহার রয়েছে। যেমন, এ কাজে ফায়দা কী? কিংবা এতে আমার তো কোনো ফায়দা নেই।

ফায়দা শব্দের প্রথম উদাহরণ খানিকটা নেতিবাচক। দ্বিতীয় উদাহরণ নেতিবাচক না হলেও খুব যে ইতিবাচক, তা নয়।

ফায়দা মূলত আরবি ভাষার শব্দ। আরবি অর্থ—লাভ। তবে বাংলায় আসার পর ফায়দা শব্দের বেশ কিছু অর্থ তৈরি হয়। যেমন: লাভ, উপকার, ফল, সুবিধা ইত্যাদি। এসব অর্থের কোনোটাই কিন্তু নেতিবাচক নয়, ফায়দার সঙ্গে যখন খাস বাংলা লোটা ও ওঠানো ক্রিয়া যুক্ত হয়, তখনই তা নেতিবাচক হয়ে পড়ে।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

কামাই

স্কুল কামাই, অফিস কামাই—এ ধরনের কথা এককালে খুব চলত। এখন কামাই শব্দের জায়গা নিয়েছে ইংরেজি অ্যাবসেন্ট শব্দ। তবে কামাই যে অচল শব্দ, তা কিন্তু নয়।

বাংলা কামাই শব্দের অনেক অর্থ। যেমন: আয়, উপার্জন, অনুপস্থিতি, বিরাম, ছেদ ইত্যাদি। ‘নিজের কামাইয়ে আমি চলি’—এমন কথার অর্থ তিনি তাঁর নিজের উপার্জনে চলেন। ‘তুমি কাল স্কুল কামাই করেছ’ বললে বোঝায় তুমি কাল স্কুলে গরহাজির ছিলে।

তো, কামাই নিয়ে বাগধারাও রয়েছে—‘কাজও নাই কামাইও নাই’ অর্থ হলো অকাজে ব্যস্ত অর্থাৎ বেকার।

আয়-উপার্জন রয়েছে যে কামাইয়ে—সে কামাই তা সংস্কৃত কর্ম্ম থেকে তৈরি। আর

গরহাজির, বিরাম ইত্যাদির কামাই শব্দ ফারসি কম শব্দ থেকে গঠিত। ফারসি কম শব্দটি আমরা অহরহ ব্যবহার করি। চায়ে চিনি কম বা বেশি বা মাপে কমবেশি হয়নি—সবই ফারসি শব্দ। কম শব্দের অর্থ—অল্প, ক্ষুদ্র ইত্যাদি।

শব্দের বিচিত্র গতিপ্রকৃতি দেখে বিস্ময় মানতে হয়। কামাই শব্দটি তার বড় একটা উদাহরণ।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

আসামি

আসামি শব্দটা যখন বাংলায় চালু হয় তখন তার অর্থ ছিল নামের তালিকা। তারপর তার অর্থ দাঁড়ায় খাতক, ঋণী, দেনাদার। তখন প্রজা বলতেও আসামি শব্দটা ব্যবহৃত হতো।

তারপর কোথা থেকে কী যে হয়ে গেল! আসামি শব্দটা তার আগের সব অর্থ পরিত্যাগ করে এখন হয়ে গেছে অভিযুক্ত, অপরাধী ইত্যাদি, যাদের কোমরে দড়ি বেঁধে কিংবা হাতে হাতকড়া পরিয়ে থানা থেকে আদালতে হাজির করা হয়।

এরপর, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে আদালতে হাজিরা দিতে হয়।

যার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, তাকে বলা হয় ফাঁসির আসামি। যে বারবার জেল খাটে, পুলিশের খাতায় সে হয় দাগি আসামি।

আসামি শব্দটার উৎস হলো আরবি। আরবি ইসম শব্দের বহুবচন—আসামি। ইসম শব্দের অর্থ নাম। আর আসামি হলো নামের তালিকা।

বাংলা ভাষার প্যাঁচে পড়ে আরবি শব্দটা তার আরবি অর্থ হারিয়ে ফেলেছে। আসামি এখন বাংলা শব্দ।

অলংকরণ: সালমান সাকিব শাহরিয়ার

গজকচ্ছপ

গজ ও কচ্ছপ মিলে তৈরি হয়েছে গজকচ্ছপ। গজ হলো হাতি আর কচ্ছপ হলো কাছিম। বাংলা ভাষায় শুধু গজকচ্ছপ শব্দের ব্যবহার নেই। ব্যবহার রয়েছে গজকচ্ছপের যুদ্ধ বা লড়াইয়ের।

শুধু গজকচ্ছপ শব্দের অর্থ হলো দুই প্রবল প্রতিপক্ষ এবং তারা আকারে বিশাল।

গজকচ্ছপের যুদ্ধ বা লড়াই বাগধারার অর্থ—প্রবল দুই প্রতিপক্ষের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। ভাইয়ে ভাইয়ে যে মারামারি, তাকেও অনেক সময় গজকচ্ছপের লড়াই বলা হয়।

গজকচ্ছপ শব্দ ও গজকচ্ছপের লড়াই বাগধারার মূলে রয়েছে হিন্দু পুরাণের কাহিনি। জনৈক ঋষির দুই পুত্র বিভাবসু ও সুপ্রতীক শাপগ্রস্ত হয়ে গজ ও কচ্ছপের রূপ ধারণ করে পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। যুদ্ধ চলে দীর্ঘদিন। যুদ্ধ কিছুতেই থামছে না দেখে কশ্যপ নামের এক ঋষি ভয়ানক বিরক্ত হন। তিনি পুত্র গরুড়কে নির্দেশ দেন দুজনকে বিনাশ করার। ক্ষুধার্ত গরুড় তৎক্ষণাৎ দুই ভাইকে ভক্ষণ করে। শেষ হয় সেই যুদ্ধ।

হিন্দু পুরাণে গরুড়কে নিয়ে অনেক কাহিনি রয়েছে। গরুড় অবশ্য মানুষ নয়, অতিকায় এক পক্ষী। দেবতা বিষ্ণুর বাহন।