পৃথিবী বিখ্যাত তিন ধাঁধারু

অ্যালিস ইন পাজলল্যান্ডের রেমন্ড

এপ্রিলের প্রথম দিন। বড় ভাই এমিল বলল, ‘রেমন্ড, আজ তো এপ্রিল ফুল। আজ তোকে এমন বোকা বানাব যে জীবনেও ভুলবি না!’

দশ বছরের বড় এমিল। বুদ্ধিতে এমিলের সঙ্গে ছয় বছরের রেমন্ড এঁটে উঠবে না। এটাই স্বাভাবিক। সারা দিন সতর্ক রইল রেমন্ড। বলা যায় না, ভাইয়াটা কখন আবার বোকা বানায় ওকে। কিন্তু সন্ধে পেরিয়ে গেল। এমিল তো ওকে বোকা বানাতে কোনো চালাকিই করল না। তবে?

রেমন্ড মেরিল স্মালিয়ন

রাতে ঘুমুনোর আগে এমিল বলল, ‘হ্যাঁ রে রেমন্ড, সারা দিন নিশ্চয়ই ভেবেছিস, আমি তোকে বোকা বানাব, তাই না?’

ওপর-নিচে মাথা নেড়ে রেমন্ড জানাল, সত্যিই তাই।

এমিল বলল, ‘তুই সত্যিই ধরে নিয়েছিস আমি তোকে বোকা বানিয়েই ছাড়ব। ঠিক?’

‘ঠিক।’

এবার হাসতে হাসতে বলল এমিল, ‘তার মানে, সত্যিই তোকে বোকা বানাতে পেরেছি।’, বলেই হো হো করে হেসে উঠল এমিল।

বিছানায় শুয়ে ভাবতে থাকে রেমন্ড। ভাইয়া কি সত্যিই ওকে বোকা বানিয়েছে? ও তো ভেবেছিল কোনো না কোনো প্যাঁচে ফেলে ওকে বোকা বানাবে। কিন্তু তেমন কিছু হয়নি। সুতরাং ও বোকা হয়নি। কিন্তু অন্যভাবে ভাবতে গেলে ও যা ভেবেছিল, তা হয়নি। মানে ও বোকা বনেছে। তাহলে?

ছোট্টবেলায় বড় ভাই তাঁর মনে যে ধাঁধার বীজ ঢুকিয়ে দিয়েছিল, সেটাই একসময় বিশাল বৃক্ষ হয়ে ওঠে। তাঁর পুরো নাম রেমন্ড মেরিল স্মালিয়ন। জন্ম ১৯১৯ সালের ২ মে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। গণিতে পিএইচডি করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। ক্ল্যাসিক্যাল পিয়ানো সংগীতে পারদর্শী, দাবাবিশারদ, দার্শনিক, লেখক এবং ধাঁধাবিদ। ধাঁধা বিষয়ে তাঁর প্রথম বই হোয়াট ইজ দ্য নেম অব দিস বুক? প্রকাশিত হয় ১৯৭৮ সালে। সাড়া ফেলে দেয় বইটি। ধাঁধা বিষয়ে তাঁর বিখ্যাত বইগুলো হচ্ছে অ্যালিস ইন পাজলল্যান্ড, দ্য রিডল অব শেহেরজাদ, দ্য ম্যাজিক গার্ডেন অব জর্জ বি অ্যান্ড আদার লজিক পাজল ইত্যাদি।

এলিস ইন দ্য পাজলল্যান্ড বইটিতে লুই ক্যারলের বিখ্যাত বই অ্যালিস ইন দ্য ওয়ান্ডারল্যান্ডের চরিত্রগুলোকে ব্যবহার করেছেন রেমন্ড। তৈরি করেছেন মজার সব সমস্যা।

ছোট্ট মেয়ে অ্যালিস একদিন ঢুকে পড়েছিল ভুলোবনে। ওখানে ও সবকিছু ভুলে যায়। ওকে দেখে লালরানি জানতে চাইল, ‘অ্যালিস, তুমি কি ভাগ করতে পারো?’

জবাব দিল অ্যালিস, ‘পারি তো।’

‘বেশ। তাহলে এগারো হাজার এগারো শ এগারোকে তিন দিয়ে ভাগ করে দেখো তো অবশিষ্ট কত থাকবে? ইচ্ছে করলে কাগজ-কলম ব্যবহার করতে পারো।’

বলেই কাগজ বাড়িয়ে দিল লালরানি। অ্যালিস কাগজে লিখল ১১১১১১। ৩ দিয়ে ভাগ করে অবশিষ্ট রইল ২।

অ্যালিস বলল, ‘ভাগশেষ থাকবে ২।’

মাথা নেড়ে লালরানি বলল, ‘উঁহু। পারলে না অ্যালিস। ভুল। একেবারে ভুল করে বসলে। তুমি ভাগই জানো না!’

অ্যালিসের মতো ভুলটা ছোটরা হামেশাই করে। এগারো হাজার এগারো শ এগারো হলো বারো হাজার এক শ এগারো (১১,০০০ + ১,১০০ + ১১)। বারো হাজার এক শ এগারোকে তিন দিয়ে ভাগ করলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।

ইচ্ছে করলে তুমি করে দেখতে পারো।

ধাঁধার যুবরাজ

১৮৫৮ সাল। নতুন একটি ধাঁধা ধাঁধিয়ে দিয়েছে অনেককেই। তিনটি বিচ্ছিন্ন লাইনের চারকোনা বর্ডারের মধ্যে দুটো গাধা আর দুজন সওয়ার রয়েছে। বর্ডারগুলো যদি কাটা যায়, তাহলে তিনটি চতুর্ভুজ পাওয়া যাবে। এই তিনটি চতুর্ভুজ এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে দুজন সওয়ার দুটো গাধার ওপর বসে পড়ে। চেষ্টা করে দেখো তো পারো কি না।

স্যাম লয়েড

ধাঁধাটি পি টি বারনামস সার্কাস থেকে প্রচার করা হয়েছিল কার্ডের ওপর ছাপিয়ে। তখন ওটা পি টি বারনারস ট্রিক নামে বিখ্যাত ছিল। লাখ লাখ কপি কার্ড বিক্রি হয়েছিল। ১৮৭১ সাল পর্যন্ত ওই কার্ড বিক্রি থেকে আয় হয়েছিল ১০ হাজার আর ২০১৪ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ডলার। তবে ধাঁধাটা এখন বিখ্যাত ট্রিক ডাংকিস নামে। ধাঁধাটি তৈরি করেন স্যাম লয়েড। ১৮৪১ সালের ৩০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ায় জন্ম তাঁর। মাত্র হাইস্কুল পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। দাবা খেলার তীব্র নেশায় পেয়ে বসেছিল তাঁকে। দাবার বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ছিলেন ১৫তম। তখন যুক্তরাষ্ট্রে দাবা খুবই জনপ্রিয়। বিভিন্ন পত্রিকায় দাবার জন্য আলাদা বিভাগও থাকত। ওসব বিভাগে নিয়মিত লিখতেন লয়েড। মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে নিউইয়র্ক স্যাটারডে কুরিয়ারে দাবাবিষয়ক লেখা ছাপা হয় তাঁর। পরের পাঁচ বছর দাবা দুনিয়ায় তিনি বিখ্যাত হয়েছিলেন এ ধরনের ধাঁধা তৈরি করে। ১৮৫৭ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে চেস মান্থলি পত্রিকার দাবাবিষয়ক সমাধান সম্পাদক হয়েছিলেন। আর ১৮ বছর বয়সে তাঁর তৈরি ট্রিক ডাংকির ধাঁধাটাই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। তাঁর আরেকটি ধাঁধা গণিতবিদদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল। ধাঁধাটি বস নামে বিখ্যাত। তবে ১৪-১৫ ধাঁধা হিসেবেও পরিচিত। চারদিকে ঘের দেওয়া একটি বোর্ডে পনেরোটি চারকোনা ঘুঁটি রাখা আছে। ঘুঁটিগুলো বোর্ডের ওপর পাশাপাশি সরানো যায়। খেলার প্রথমেই সব নম্বর ক্রমানুসারে সাজানো আছে কেবল ১৪ ও ১৫ নম্বর বাদে। সমস্যা হচ্ছে বোর্ড থেকে না তুলে শুধু সরিয়ে সরিয়ে সব নম্বর পরপর আনতে হবে।

লয়েড ঘোষণা দিয়েছিলেন, কেউ ধাঁধাটার সমাধান করতে পারলে এক হাজার ডলার পুরস্কার দেবেন। পুরস্কারের লোভেই হোক আর আনন্দের খাতিরেই হোক, হু হু করে ধাঁধার খেলনা বিক্রি হয়েছিল। কিন্তু এর সমাধান করতে পারেনি কেউ। রহস্যময় বিষয় হচ্ছে, স্যাম লয়েড নিজেই এর সমাধান জানতেন কি না, জানা যায়নি। যদিও গণিতজ্ঞরা প্রমাণ করেছেন এর সমাধান অসম্ভব। তবে লয়েড জীবিত থাকতে কেউ ধাঁধাটার সমাধান করে ওই পুরস্কারও দাবি করেনি। স্যামের বিখ্যাত ধাঁধাগুলোর মধ্যে আরও আছে ‘গ্রেট অব দ্য আর্থ’, ‘টেডি অ্যান্ড দ্য লায়নস’, ‘দ্য ওয়েট অব আ ব্রিক’ ইত্যাদি। তাঁর আরেকটা বিশেষ গুণ ছিল। খুব সামান্য সমস্যাকেও আকর্ষণীয় করে গল্পের মোড়ক দিয়ে সাজিয়ে তুলতে পারতেন। আর সেটাই পাঠকের কাছে ছিল পরম উপাদেয়। গাধা আর সওয়ারের ধাঁধাটার সমাধান পেতে চাও? তবে চলে যাও এই লিংকে— https://en.wikipedia.org/wiki/File:Donkeys_Animation.gif

স্যামের পত্রবন্ধু

স্যাম লয়েডের সঙ্গে হাজার মাইল দূরত্বে থাকা এক কিশোরের ছিল পত্রবন্ধুত্ব। বয়সে লয়েডের চেয়ে ষোলো বছরের ছোট। মাত্র নয় বছর বয়সে তাঁর তৈরি অঙ্কের ধাঁধা ছাপা হতো গ্রামের পত্রিকায়। আসলে তাঁর জন্মই হয়েছে এক গণিত পরিবারে। নাম তাঁর হেনরি আর্নেস্ট ডুডনি। ১৮৫৭ সালের ১০ এপ্রিল ইংল্যান্ডের সাসেক্স কাউন্টির মেফিল্ড গ্রামে জন্ম। বাবা এবং দাদা দুজনই ছিলেন স্কুলের গণিত শিক্ষক। বাড়িতে গণিত চর্চা হতো। সেখান থেকেই গণিত নিয়ে তাঁর আগ্রহ। তবে বেশি দূর লেখাপড়া করতে পারেননি। তেরো বছর বয়সে সরকারি অফিসে কেরানির চাকরি শুরু করেন। এর মাঝেই চলতে থাকে ধাঁধাচর্চা। লয়েডের সঙ্গে ধাঁধার আদান-প্রদান করতেন ডুডনি। এ কারণে দুজনের লেখাতেই অনেক সময় একই রকম ধাঁধা দেখা যায়। তবে ডুডনি ছিলেন এ ব্যাপারে সৎ। অন্যের ধাঁধা প্রকাশ করলে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে নাম প্রকাশ করতেন। অন্যদিকে স্যাম লয়েড অন্যের ধাঁধা নিলেও কৃতজ্ঞতা স্বীকার না করে নিজের বলেই জাহির করতেন। এ জন্য লয়েডের ওপর খেপেও গিয়েছিলেন ডুডনি। একসময় লয়েডের সঙ্গে ধাঁধা বিনিময় বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ডুডনির ধাঁধার মধ্যে চিন্তার খোরাক ছিল অনেক। অঙ্কের ধাঁধায় তাঁর সমকক্ষ তখন আর কেউ ছিলেন না। বিখ্যাত দ্য স্ট্র্যান্ড ম্যাগাজিনে তাঁর ধাঁধার পাতা চলেছিল প্রায় বিশ বছর ধরে। তাঁর প্রথম বই দ্য ক্যান্টারবারি পাজল প্রকাশিত হয় ১৯০৭ সালে। এরপর বেরোয় দ্য ওয়ার্ল্ডস বেস্ট ওয়ার্ল্ড পাজল, পাজল অ্যান্ড কিউরিয়াস প্রবলেমস, আ পাজল মাইন ইত্যাদি।

ডুডনি

ডুডনির একটা মজার ধাঁধা হলো সিঁড়ি লাফানোর ধাঁধা। সবার আগে দোতলায় পৌঁছানোর জন্য লাফিয়ে লাফিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠছে তিন বন্ধু—করিম, রহিম ও নাবিল। ছবিতে দোতলায় পৌঁছানোর ঠিক আগের ছবি দেখানো হয়েছে। দোতলার সবচেয়ে কাছাকাছি করিম। সে এক লাফে তিনটি করে সিঁড়ি পার হয়। তারপর রহিম। রহিম প্রত্যেক লাফে চারটি করে সিঁড়ি পার হয়। সবশেষে নাবিল। প্রতি লাফে সে পার হয় পাঁচটা সিঁড়ি। ছবি দেখে মনে হচ্ছে করিমই প্রথম দোতলায় পৌঁছাবে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, একতলা থেকে দোতলায় কটা সিঁড়ি?

উত্তরটা হচ্ছে—

সিঁড়ির সংখ্যা যদি এমন হতো যে প্রত্যেকে তাদের শেষ লাফেও অন্যান্যবারের মতো একই সংখ্যক সিঁড়ি পার হতো, তাহলে এটা হয়ে যেত সাধারণ ল.সা.গুর প্রশ্ন। এবং মোট সিঁড়ির সংখ্যা হতো ৬০। কিন্তু ছবিতে দেখা যাচ্ছে, করিমের শেষ লাফের আগে মাত্র একটা সিঁড়ি বাকি আছে। রহিম দোতলার সাতটা সিঁড়ি পেছনে। এরপরের লাফে চারটে সিঁড়ি পার হওয়ার পর, শেষ লাফে তাকে আর তিনটা সিঁড়ি পার হতে হবে। নাবিলের বেলায় শেষ লাফে চারটা সিঁড়ি টপকাতে হবে। অতএব মোট সিঁড়ির সংখ্যা হবে ন্যূনতম সেই সংখ্যা যাতে ৩, ৪ এবং ৫ দিয়ে ভাগ করলে যথাক্রমে ১, ৩ এবং ৪ অবশিষ্ট থাকে। এবার দেখা যাক কোন সংখ্যাকে ৫ দিয়ে ভাগ করলে ৪ অবশিষ্ট থাকে। সংখ্যাগুলো হচ্ছে ৯, ১৪, ১৯ ইত্যাদি। এদের মধ্যে ১৯ কে ৪ দিয়ে ভাগ করলে ৩ আর ৩ দিয়ে ভাগ করলে ১ অবশিষ্ট থাকে। অতএব উত্তর হবে ১৯টা সিঁড়ি।