পিঠার পৃথিবী

সময়ের বিবর্তনে পিঠার স্বাদ, বানানোর উপকরণ ও সরঞ্জামে কিছু পরিবর্তন এলেও আজও কিন্তু নতুন ধানের গন্ধে মোড়া পিঠা জিবে জল এনে দেয়। পিঠা সেই আদিকাল থেকেই এ দেশে ছিল। তবে নবাবদের রাজদরবারে সাধারণদের মধ্যে দক্ষ পিঠা কারিগরদের যথাযথ মূল্যায়ন ছিল। রাজ্যে নতুন ধান উৎপাদন হলেই পিঠার আয়োজন হতো। মোগলদের আমলেও তাদের ভোজন রসের তৃপ্তি পূরণে পিঠার সুনাম ছিল।

পিঠার যুগ

সেই ঐতিহ্যবাহী সময়ের পিঠাগুলো ছিল মূলত নতুন ধান থেকে তৈরি চালের গুঁড়ার। পিঠায় মিষ্টি ব্যবহার করা হতো যেন মিষ্টান্ন হিসেবেও পরিবেশন করা যায়। তখনকার জনপ্রিয় পিঠা ছিল ভাপা, মালপোয়া, চিতই, ঢেপু, নবাব পিঠা, বিভিন্ন ধরনের পুলি পিঠা, পাকান পিঠা প্রভৃতি। এগুলোয় নতুন চালের গুঁড়া, দুধ, চিনি, নারকেল, আখের অথবা খেজুরের রস এবং বিভিন্ন ধরনের ফল ব্যবহার করা হতো। নবাবদের যুগের ভাপার আকার বড় ছিল। মাটির পাত্রে পানির ভাপে তৈরি করা হতো বলেই এই নাম। আবার চিতই তৈরি হতো মাটির সরায় (ছাঁচে)। তবে এখন লোহার সরাইও পাওয়া যায়। মালপোয়ার রসে ভরা স্বাদ যেন তৃপ্তির হাসিতে পূর্ণ। সেকালের চিতই ছিল টুপটুপে মিষ্টি রসে ভরা। দুধ, গুড় আর নারকেলের রসে ডোবানো চিতই মুখে দিলেই মুখ ভরে উঠত। পাকান আর পুলি পিঠায় থাকত বিভিন্ন ধরনের পুরের স্বাদ। নবাব পিঠা বানানো থেকে শুরু করে পরিবেশন পর্যন্ত ছিল নবাবির ছোঁয়া।

পিঠা যখন শিল্প

সেকালে পিঠার কারিগরদের পিঠার স্বাদের চেয়েও লক্ষণীয় ছিল পিঠার নকশা। পুলি পিঠার ওপরে তৈরি নকশাই ছিল পিঠার আভিজাত্য বিস্তারের এক হাতিয়ার। মোগল রাজারা পিঠার কারিগরদের সম্মান করতেন শুধু তাঁদের বৈচিত্র্যময় পিঠার জন্য। তাঁদের পিঠার গায়ে রাজ্যের ইতিহাস, ঐতিহ্য কিংবা চমৎকার প্রাকৃতিক নকশা তৈরি করা হতো। পুলি পিঠা নকশা করার জন্য সুবিধাজনক। পিঠায় নকশা আঁকার জন্য খেজুরের কাঁটা, বাঁশ ব্যবহার করা হতো। এই শিল্পের তেমন কোনো বিস্তার না থাকলেও তোমরা তোমাদের নানি-দাদিকে নকশি পুলি বানাতে বলে পিঠার স্বাদ ও সৌন্দর্য দুই উপভোগ করতে পারো।

পিঠা কি একা?

না, ভালো বন্ধুরা কখনো একা থাকে না। পিঠারও বন্ধু আছে। চিড়া, মুড়ি, খই, সন্দেশ, বিভিন্ন ধরনের রস—আখের রস, খেজুরের রস, তালের রস সবাই পিঠার খুব ভালো বন্ধু। তাদের নিয়েই জমে ওঠে পিঠার আয়োজন। শুঁটকি ভর্তা, মরিচ ভর্তা, সরিষা ভর্তা, ধনেপাতার ভর্তাসহ আরও অনেক কিছু নিয়েই ছিল পিঠার জগৎ।

কোথায় আছে পিঠা?

আম্মুকে বলে বাসাতেই নিতে পারো পিঠার স্বাদ। গ্রামে গেলে নানি দাদির হাতের পুরোনো সময়ের পিঠার স্বাদও নিতে পারো। এখন কিছু কিছু সুপার শপে হিমায়িত পিঠাও পেতে পারো। রাস্তার পাশে দোকানের পিঠা আম্মুকে না বলে খাবে না কিন্তু। তা ছাড়া শহর অঞ্চলে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়। চাইলে ঢুঁ মেরে আসতে পারো উৎসবগুলোয়। তাদের বাহারি পিঠা খেয়ে কিছুটা পুরোনো পিঠার স্বাদ পেতে পারো। এ ছাড়া কিছু বাঙালি রেস্তোরাঁয়ও পেয়ে যেতে পারো তোমার পছন্দের পিঠা।

একালের পিঠা কি পিঠা নয়?

অবশ্যই, এরাও পিঠা। তবে এরা একটু আধুনিক আরকি। এখন ভাপা পিঠায় মাংস, সবজি ও নানা রকম ফল ব্যবহার করা হয়, যা ভাপাকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে। লাল-সবুজে তৈরি হয় বিজয় পিঠা। স্বাদে না পারলেও আমাদের রক্তাক্ত ইতিহাস তুলে ধরে এই পিঠা। ডিম দিয়ে তৈরি রেইনবো পিঠাও সুস্বাদু ও আকর্ষণীয়। রসুন, পেঁয়াজ কিংবা মরিচের পিঠাও অন্য রকম স্বাদের। আর পিঠাগুলোর আকারেও আছে ভিন্নতা। পিঠা যে শুধু মিষ্টি হয়, তা-ও নয়। ঝাল, তিতা, নোনতাসহ নানা স্বাদের পিঠা আছে। নানা ফ্লেভারের ক্রিম দিয়েও তৈরি হয় এখনকার পিঠা। পিঠার স্বাদ নিতে চাইলে পুরান ঢাকায় ঘুরে আসতে পারো। দুধ বাকরখানি, চাপাতিশ, বালুকা পিঠা, ছিটা পিঠা, বিভিন্ন সন্দেশ তোমাকে নিয়ে যাবে পিঠার জগতে। একালের পিঠার নকশাও আধুনিক আশ্চর্যের বিস্ময়গুলো তুলে ধরে।

পিঠা আয়োজন

পিঠাকে আবার বাংলার ঐতিহ্যে ফিরিয়ে আনতে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ আয়োজন করে পিঠা উৎসব। তিন দিনব্যাপী পিঠা উৎসবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ অনুষদ থেকে পিঠার স্টল সাজিয়ে বসে। স্টলভিত্তিক প্রতিযোগিতা হয় ঐতিহ্যবাহী পিঠা প্রদর্শনের। কোনো কোনো স্টলে ছিল গরম সদ্য তৈরি পিঠা পরিবেশনের ব্যবস্থা।

শীতে নানা জায়গাতে চলে এমন পিঠা উৎসব। চাইলে তুমিও ঘুরে আসতে পারো এমন কোনো উৎসব থেকে।