পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে ফেরা এক উদার তরুণের গল্প
শিনজি মিকামোর সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছিল সেদিন, যখন হিরোশিমাতে পারমাণবিক বোমা পড়েছিল। এরপর তাঁর সঙ্গে ছিল শুধু বাবার পকেটঘড়ি। এই ধ্বংসযজ্ঞের জন্য তিনি কখনো আমেরিকার ঘাড়ে দোষ চাপাননি।
শিনজি মিকামোর মেয়ে আকিকো মিকামো। ছোটবেলায় জাপানি প্রথা অনুযায়ী গোসল করার সময় তিনি কখনো বুঝে ওঠেননি কেন বাবার কান ও শরীরে ক্ষত। দেখতে দেখতে যেন স্বাভাবিক মনে হয়েছে। আকিকোর মা কখনো বোমার কথা মুখ দিয়ে উচ্চারণ করেননি। জাপানি মেয়েরা নাকি কষ্ট নিজেদের মধ্যে রাখে, অন্যের ওপর বোঝা তৈরি করে না। কিন্তু বাবার মুখে আকিকো অনেক গল্প শুনেছে, সেগুলো তার বইয়ে জায়গা পেয়েছে।
বাবা সব সময় শিক্ষা দিয়েছেন ঘৃণা না করতে। ‘আমেরিকাকে দোষ দেওয়া যাবে না, সবটা এই যুদ্ধের কারণে হয়েছে’। ইনোলা গে, যে পাইলট সেদিন হিরোশিমাতে বোমা ফেলেছিলেন, তিনিও শুধু হুকুম পালন করছিলেন মাত্র।
হিরোশিমার গ্রীষ্মকাল অনেক ভয়ানক। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের সকালও সে রকমই ছিল। বেশ গরমও পড়েছিল। শিনজি মিকামো সেদিন কাজ থেকে ছুটি নিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আর্মির শিক্ষানবিশ ইলেকট্রিশিয়ান। তাঁদের বাড়ি আগেই আংশিক ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বোমার আঘাতে। সরকারের আদেশ ছিল বাড়িগুলো পুরোপুরি ভেঙে ফেলার। সেটার কাজ শেষ করার আর বাবাকে সাহায্য করতে ছুটি নেন শিনজি। জাপানের আকাশে থেকে মাসখানেক ধরে বোমা ফেলা হচ্ছিল। চারদিকে শুধু ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল।
শিনজির মা তখন অসুস্থ হওয়ায় গ্রামে ছিলেন। বড় ভাই তাকাজি ফিলিপাইনে যুদ্ধরত ছিলেন। ১৯ বছর বয়সী শিনজি ও তার বাবা কেবল শহরে ছিলেন। খাবার নিয়েও সংকট চলছিল। শিনজির বাবা ফুকুইচি মজা করে বলতেন, এখন আমি সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠি। কারণ, আমাকে পাখির খাবার দেওয়া হয়।
সেদিন আকাশে কোনো মেঘ ছিল না। ৭টা ৪৫ মিনিটে কাজের জন্যই বাড়ির ছাদে ওঠেন শিনজি। একবার পুরো শহরে চোখ বুলিয়ে নিয়েছিলেন তিনি। সকাল ৮টা ১৫ মিনিট। কাজ করতে করতে শিনজি হঠাৎ খেয়াল করলেন আকাশে এক আলোর ছটা, অনেকটা ফ্ল্যাশ লাইটের মতো জ্বলে উঠল। মুহূর্তেই চোখে পড়ে বিশাল এক আগুনের গোলা। সূর্যের চেয়ে পাঁচ গুণ বড় আর দশ গুণ উজ্জ্বল এ আলোয় শিনজির চোখ ধাঁধিয়ে গেল। হলুদ-সাদার এক অদ্ভুত মিশ্রণ সেই আলোয়।
কানের পর্দা ফাটিয়ে দেওয়া শব্দটা হয়েছিল একটু পরেই। শিনজির মনে হচ্ছিল তার শোনা সবচেয়ে বড় বজ্রপাতের শব্দ এটা। মনে হচ্ছিল, এক বালতি গরম পানি কেউ যেন গায়ের ওপর ঢেলে দিল।
চোখের পলকে শিনজি ঘরের মধ্যে পড়ে যায়। গায়ের ওপরে ঘরের ছাদ পড়েছিল। বাবার কণ্ঠে তিনি সজাগ হন। ৬৩ বছর বয়সী তাঁর বাবা ছেলেকে স্তূপ থেকে টেনে তোলেন। শিনজির বুক আর দেহের ডান পাশ পুড়ে গিয়েছিল। চামড়া দেহের সঙ্গে এমনভাবে ঝুলে ছিল, মনে হচ্ছিল কোনো কাপড় পরেছেন তিনি। পুড়ে মাংসের রং হলুদ হয়ে গিয়েছিল, মায়ের বানানো মিষ্টি কেকের মতো।
বাবা–ছেলে চারদিকে চেয়ে দেখলেন আশপাশের সেই শহর আর নেই। শুধু ইট-পাথর আর ছাই। শিনজি তখনো বুঝে ওঠেননি কী হয়েছে। সূর্য কি ফেটে পড়েছে? যদিও তাঁর বাবা সবটা বুঝতে পারছিলেন; হাসতে হাসতে বলেছিলেন, ‘ওরা একবারে সব কটি বাড়িই ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের কাজ কমে গেল।’
তখন আর কথা বলার সময় নেই। পুরো শহরে তখন আগুন জ্বলছে। পায়ের নিচে লাশের স্তূপ। এই সময় আবার দেখা দেয় বিশাল এক টর্নেডো। শহরের আগুন থেকে সৃষ্ট এই আগুনের গোলাককে শিনজি ‘আ ডার্ক মনস্টার’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ভেঙে পড়া বাড়িগুলো, জ্বলন্ত লাশগুলো আর নদীর পানি নিয়ে তাণ্ডব চালায় এই টর্নেডো। সেটি শেষ হলে নদীর দিকে যাত্রা শুরু করেন দুজন। উদ্দেশ্য শরণার্থীশিবির খুঁজে পাওয়া। কারণ, খানিক আগে এখানে আগমন ঘটেছিল ‘লিটল বয়’-এর!
জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয় যথাক্রমে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট। মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। সেখান থেকে বেঁচে ফেরা শিনজি মিকামো বলেন যুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী গল্প। তাঁর মেয়ে আকিকোর জন্ম এর ১৪ বছর পরে। কলমের খোঁচায় তিনি লিখে ফেলেন বাবার ঘটনা নিয়ে একটি বই, ৮টা ১৫ মিনিট (8:15)। যেখানে ফুটে ওঠে সেই গল্প, ক্ষমার এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত। বইয়ের নামকরণ করা হয় শিনজির বাবার ঘড়ি বন্ধ হয়ে যাওয়া শেষ সময় থেকে। কারণ, লিটল বয়ের আঘাতে ঘড়িটা পুড়ে গিয়েছিল, সময় থমকে গিয়েছিল সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে!