পর্বতবালক জর্ডান রোমেরো

ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে দেয়ালে ঝোলানো একটা ছবি দেখে থমকে দাঁড়াল নয় বছর বয়সী জর্ডান। কী অদ্ভুত একটা ছবি! একটা পাহাড়ের ওপর আরেকটা পাহাড়, তার ওপর আরেকটা পাহাড়। গুনে দেখল জর্ডান, মোট সাতটা। সাতটা মহাদেশের সাতটা সর্বোচ্চ চূড়া। সেভেন সামিট।

সেদিন জর্ডান বাসায় এসেই বাবাকে প্রস্তাব দিল সেভেন সামিট জয় করার। না, বাচ্চা ছেলের আবদার বলে হেসে উড়িয়ে দেননি বাবা পল রোমেরো। দুর্দান্ত রোমাঞ্চপ্রিয় বাবা জানতেন এই ছেলে আর দশটা ছেলের চেয়ে আলাদা হবে।

জর্ডান বাবার বিশ্বাসের প্রমাণ দেয়। এ ঘটনার চার বছর পর মাত্র ১৩ বছর বয়সে কনিষ্ঠ পর্বতারোহী হিসেবে ২৯ হাজার ৩৫ ফুট উচ্চতার সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হিমালয় জয় করে জর্ডান রোমেরো। তবে এই অবিশ্বাস্য অর্জন এক দিনে সম্ভব হয়নি। পর্বতারোহণের শারীরিক ও মানসিক শক্তি অর্জনের জন্য কঠিন পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে তাকে। নিয়মিত জগিং, পিঠে ভারী ওজন নিয়ে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটা, কোমরে টায়ার বেঁধে দৌড়ানো এসব ছাড়াও এভারেস্ট অভিযানের এক মাস আগে জর্ডানকে বাসায় তৈরি কৃত্রিম হিম পরিবেশে ঘুমাতে হতো, যেন তার শরীর হিমালয় অঞ্চলের হাড় ঠান্ডা করা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে।

২০০৬ সালের জুলাই মাসে বাবা এবং সত্মাকে সঙ্গে নিয়ে ‘টিমজর্ডান’-এর সেভেন সামিট অভিযান শুরু হয়। লক্ষ্য আফ্রিকার সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট কিলিমানজারো। এরপর ২০০৭ সালের জুলাইয়ে ইউরোপের মাউন্ট এলব্রুস জয়। একই বছর ডিসেম্বরে দক্ষিণ আমেরিকার মাউন্ট একোনকাগুয়া জয়, ২০০৮ সালের জুন মাসে উত্তর আমেরিকার সর্বোচ্চ চূড়া ডেনালি, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ইন্দোনেশিয়ার মাউন্ট কার্সটেনজ পিরামিড এবং ২০১০ সালের মে মাসে বহুল প্রতীক্ষিত মাউন্ট এভারেস্ট জয় এবং সর্বশেষে ২০১১ সালে অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের সর্বোচ্চ চূড়া ভিনসন ম্যাসিফ জয় করে টিমজর্ডান। প্রতিটি অভিযানেই জর্ডানের সঙ্গী ছিলেন বাবা পল রোমেরো এবং সত্মা কারেন লুন্ডগ্রিন।

তিক্তমধুর অনেক ঘটনায় আচ্ছাদিত জর্ডানের এভারেস্ট জয়। প্রায় দুই মাসের এভারেস্ট অভিযানে স্কুলপড়ুয়া জর্ডানের স্কুল থেকে ছুটি পেতে সমস্যা হচ্ছিল। পরে দুই মাসের হোমওয়ার্ক দিয়ে তার ছুটি মঞ্জুর করা হয়। জর্ডান অবশ্য এ নিয়ে বেশ আনন্দিতই ছিল। অঙ্ক ভালোবাসত, এভারেস্ট অভিযানের ফাঁকে ফাঁকে তাই হোমওয়ার্ক শেষ করতে বেগ পেতে হয়নি তার।

জর্ডান রোমেরো

এভারেস্টের ক্যাম্প থ্রি থেকে শেষ মাথায় উঠতে প্রায় ১৫ ঘণ্টা সময় লাগে। চূড়ান্ত শারীরিক এবং মানসিক শক্তির পরীক্ষা হয় অভিযাত্রীদের এ সময়। এই রাস্তাতেই অপর দলের এক অভিযাত্রী মারা যায় জর্ডানের চোখের সামনে। ওই রকম পরিবেশে এ ধরনের ঘটনা যে কাউকে ভয় পাইয়ে দেবে, তবু ছোট্ট জর্ডান মানসিক শক্তি ধরে রেখে অভিযান শেষ করতে সক্ষম হয়। অবশ্য এবিসি নিউজের সাক্ষাৎকারে পরবর্তী সময়ে সে বলে, ‘এভারেস্ট ভয়ংকর ও বিপজ্জনক। সম্ভবত অন্য কোনো ১৩ বছর বয়সীকে আমি যেতে উৎসাহিত করব না।’

এভারেস্টে ওঠার বেশ কিছুদিন আগে জর্ডানের বন্ধু নাইজেলের ক্যানসার ধরা পড়ে। এভারেস্ট জয়ের বড় প্রেরণা হিসেবে নাইজেলের কথাই উল্লেখ করে জর্ডান। এ ছাড়া শেরপা আংপাহ সাংয়ের কথা বিশেষভাবে জর্ডানের উঠে আসে সাক্ষাৎকারে। ভিন্নধারার জীবনদর্শন সম্পর্কে ধারণা এই শেরপার কাছ থেকেই পায় জর্ডান।

১৯৯৬ সালের জুলাই মাসের ১২ তারিখ ক্যালিফোর্নিয়ায় জন্ম নেওয়া এই আমেরিকানের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে আমেরিকার ৫০টি প্রদেশের সর্বোচ্চ চূড়াগুলো জয় করা। এখন পর্যন্ত তার লেখা দুটি বই প্রকাশিত হয়েছে: দ্য বয় হু কনকয়ার্ড এভারেস্ট এবং নো সামিট আউট অব সাইট। এ ছাড়া জর্ডান তার প্রজেক্ট ‘নিজের এভারেস্ট খুঁজে বের করো’ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, যেখানে শিশু-কিশোরদের নিয়ে কাজ করে সে। বিশ্বজুড়ে শিশু-কিশোর এবং পর্বতারোহীদের প্রেরণার উৎস জর্ডান এভারেস্ট জয়ের পর এবিসি নিউজের সাক্ষাৎকারে বলে, ‘আমি চাই সবাই তার এভারেস্ট খুঁজে বের করুক, এরপর ধৈর্য, পরিকল্পনা এবং সতর্কতার সঙ্গে সেটা অতিক্রম করুক, যেমনটি এভারেস্ট জয়ে করা লাগে।’

এ মাসেই এভারেস্ট জয় করেছিলেন । প্রথম এভারেস্টজয়ী স্যার এডমন্ড হিলারির একটি বিখ্যাত উক্তি রয়েছে, ‘আমরা পর্বত অভিযানে পর্বতের বাধাকে জয় করি না, আমরা মূলত জয় করি নিজের বাধাগুলোকে।’ এডমন্ড হিলারির কথাকেই যেন নতুন রূপ দিয়েছে জর্ডান রোমেরো, পর্বতারোহণের এই বিস্ময়বালক।