অভিধানের গল্প
পরিচিত কিছু শব্দের উৎস
শব্দের অর্থ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে যে দাঁড়াবে বা দাঁড়াতে পারে, আগে থেকে তা বলা বেশ মুশকিল। কিছু শব্দের অর্থ অবশ্য নির্দিষ্ট থেকে যায়। কিন্তু অধিকাংশ অর্থের বেলায় তা আর নির্দিষ্ট থাকে না। পরিবর্তন ঘটে।
এই পরিবর্তন ঘটতে কত দিন লাগতে পারে, তা–ও আগে থেকে বলা অসম্ভব। ১০০ বছরও লাগতে পারে। আবার ৫০০ বছরও লাগতে পারে।
শব্দ গতিময়। মুখ ও কলপের মাধ্যমে তার গতিময়তা। শব্দ গতিহীন হয়ে গেলে তার ঠাঁই হয় অভিধানে। প্রতিভাবান কোনো কবি কিংবা লেখকের কলমে সে শব্দ আবার গতি ফিরে পেতে পারে। বদলে যেতে পারে তার অর্থও। শব্দের গতিপ্রকৃতি সত্যিই বড় বিচিত্র। অভিযানের গল্পের মধ্যে থাকে সেই বৈচিত্র্য খুঁজে দেখার প্রচেষ্টা।
দৌরাত্ম্য
দৌরাত্ম্য যে কত কিছুর হতে পারে, তার ইয়ত্তা নেই। দুর্বৃত্তদের সাংঘাতিক দৌরাত্ম্য, ভূতের রহস্যময় দৌরাত্ম্য, ছোট্ট বাচ্চাদের মিষ্টিমধুর দৌরাত্ম্য, স্নেহের দৌরাত্ম্য এবং এমনকি ভালোবাসারত দৌরাত্ম্যও হতে পারে। দৌরাত্ম্য সংস্কৃত ভাষার শব্দ। দুরাত্মান থেকে দৌরাত্ম্য। দুরবা শব্দটিরও উত্স একই। দৌরাত্ম্য শব্দের মূল অর্থ নিষ্ঠুরতা, অত্যাচার, উত্পীড়ন ইত্যাদি।
বাংলা ভাষায় দৌরাত্ম্য শব্দটির পরিচয় তত্সম শব্দ হিসেবে। তত্সম বলেই শব্দটির মধ্যে সংস্কৃতভাবের সঙ্গে বাংলাভাবও এসে গেছে। বাংলায় দৌরাত্ম্য শব্দের অর্থের মধ্যে তাই দুই রকম অর্থই বিদ্যমান।
দুর্বৃত্তদের যে দৌরাত্ম্য—তা সংস্কৃত ভাষার, অর্থাৎ এই দৌরাত্ম্য রয়েছে অত্যাচার, উত্পীড়ন। তবে বাংলা ভাষার দৌরাত্ম্য শব্দের অর্থ বেশ মোলায়েম। ভূতের দৌরাত্ম্যে রয়েছে রহস্যময়তা। এর কূলকিনারা পাওয়া মুশকিল। দৌরাত্ম্যের বাংলা অর্থ—জবরদস্তি, যেমন স্নেহ ও ভালোবাসার জবরদস্তি, দুরন্তপনা, উপদ্রব ইত্যাদি।
সই
আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সই একটা অতিপরিচিত শব্দ। প্রয়োজনীয় এই শব্দটার সঙ্গে পরিচয় নেই—এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না।
নানান কাজে সই দিতে হয়। সই নিতে হয়। আরবি ভাষা থেকে আসা কিন্তু বাংলা হয়ে যাওয়া এই শব্দটার সাধারণ অর্থ স্বাক্ষর বা দস্তখত। সই দিতে হলে লেখাপড়া জানতে হয়। না জানলেও অসুবিধা নেই। তখন দিতে হয় টিপসই। টিপসই হলো বাঁ হাতের বুড়ো আঙুলের ছাপ। টিপসইয়ের টিপ শব্দের অর্থ হলো আঙুলের ডগা।
আরবি ভাষায় সইয়ের সঙ্গে স্বাক্ষরের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। আরবিতে শব্দটার উচ্চারণ সই নয়—সহিহ্ যার অর্থ হলো সঠিক, বৈধ, যথার্থ। বাংলায় এসে শব্দটার শুধু অর্থই পাল্টায়নি, শব্দের অর্থের নানা ডালপালা গজিয়েছে এবং তার মাধ্যমে তৈরি হয়েছে নতুন সব শব্দ। এগুলোর মধ্যে জুতসই, মাপসই, পছন্দসই, লাগসই ইত্যাদি শব্দ বাঙালির মুখে মুখে ঘোরে। এসব শব্দের অর্থের মধ্যে আরবি সহিহ্ শব্দের অর্থের খানিকটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
আক্ষেপ
বাংলায় আক্ষেপ শব্দের দুই রকম অর্থ। একটি অর্থ রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত; যেমন তড়কা, হাত-পায়ের খিঁচুনি ইত্যাদি। অন্যটির সম্পর্ক মনের সঙ্গে; যেমন ক্ষোভ, দুঃখ, মনস্তাপ, পরিতাপ ইত্যাদি। বিশেষ বিশেষ রোগে দেহের যে আক্ষেপ এখন তাকে আর আক্ষেপ বলা হয় না। আগেকার দিনের কবিরাজরা শব্দটি ব্যবহার করতেন। হাল আমলের ডাক্তাররা আক্ষেপ শব্দের বদলে বলেন—কনভালসান।
মনের আক্ষেপের বদল হয়নি। এখনো রীতিমতো সচল। মনের আক্ষেপ নানা কারণে হতে পারে। সারা জীবন আক্ষেপ করেই কাটিয়ে দিলেন এমন লোকের সংখ্যা বিরল নয়। মনের আক্ষেপ সহজে দূর হওয়ার নয়। মানুষ পেয়েও আক্ষেপ করে, আবার না পেলেও করে।
আক্ষেপ বাংলা ভাষার শব্দ নয়। শব্দটি সংস্কৃত ভাষার। বাংলা ভাষায় এলেও আক্ষেপ শব্দের মধ্যে সংস্কৃত হাবভাব কিছুই নেই। সংস্কৃত ভাষা আক্ষেপ শব্দের অর্থ—ভর্ৎসনা, নিন্দা, আকর্ষণ ইত্যাদি।
রুমাল
সৈয়দ মুজতবা আলী তাঁর লেখার মধ্যে প্রায়ই চুটকি ছাড়তেন। সেসব চুটকি কোনোটাই অপ্রাসঙ্গিক নয়, সবটাই প্রাসঙ্গিক। একটার কথা মনে পড়ছে, তবে হুবহু নয়, কাছাকাছি। ভালো জামাকাপড় পরা এক তথাকথিত ভদ্রলোক এক চাষিকে চাষা সম্বোধন করে বলছেন, তোমরা বড় নোংরা, অভদ্র। চাষির চাঁছাছোলা উত্তর, নাক ঝেড়ে আমরা যা রাস্তায় ফেলে দিই, সেইটাই তোমরা কাপড়ের টুকরোয় নিয়ে রেখে দাও পকেটে—এটা কেমন ধারা ভদ্রতা?
কাপড়ের টুকরোর ভদ্র নাম যে রুমাল, চাষির তা জানা ছিল না। রুমাল শব্দটা অবশ্য এখন কোনো চাষিরই অজানা নয়। সন্ধ্যায় পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানে যাতায়াতের সময় তাদের পকেটেও এখন রুমাল থাকে।
রুমালের পরিচয় দেওয়ার তেমন কিছু নেই। রুমাল চেনেন সবাই। ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তা–ই। অভিধানে রুমাল শব্দের অর্থ দেওয়া হয়েছে—মুখের ঘাম ও হাত–মুখ মোছার ক্ষুদ্র বস্ত্রখণ্ড। রুমাল শব্দটি ফারসি। বাংলায় সরাসরি আগমন।
শৌখিন
বাংলা ভাষায় কৃত ঋণ শব্দ সব সময়ই যে মূল ভাষার অর্থ বহন করে এমনটা নয়। বাংলা ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ প্রচুর। হিন্দি-উর্দু ভাষাতেও রয়েছে প্রচুর আরবি-ফারসি শব্দ। দেখা গেল, একটা ফারসি শব্দ বাংলায় এসে তার মূল অর্থ হারিয়ে ফেলে নতুন অর্থ ধারণ করে বসে আছে। অথচ সেই একই শব্দ হিন্দিতে নিয়ে ফারসি অর্থ নিয়ে দিব্যি টিকে আছে। বিদেশি কৃত ঋণ শব্দের এমন আচার-আচরণ হরহামেশাই দেখা যায়।
শৌখিন শব্দটা এ ধরনেরই একটা শব্দ। শব্দটির মূল ফারসি। কিন্তু বাংলা শৌখিন শব্দে ফারসি উচ্চারণের ছাপ অনেকটা পাওয়া যায়, কিন্তু অর্থের মধ্যে ফারসি ছাপ পুরোপুরি অনুপস্থিত।
শৌখিন শব্দের ফারসি উচ্চারণ শওকিন বা শৌখিন। হিন্দিতে সেই একই উচ্চারণ। কিন্তু অর্থের বেলায় এসে সব এলোমেলো। ফারসি শওকিন শব্দের অর্থ—আগ্রহী, কামনাবাসী, আকাঙ্ক্ষী ইত্যাদি। হিন্দিতেও তাই। কিন্তু বাংলা শৌখিন শব্দের অর্থ হলো বিলাসী, রুচিসম্পন্ন, মনোহর, মনোজ্ঞ ইত্যাদি। এখন কে বলবে শৌখিন ফারসি শব্দ?