আমরা যদি আকাশ থেকে পদ্মা সেতু দেখি, দেখব, সেতুটা সরলরেখার মতো সোজা নয়। সামান্য বাঁকা।
প্রশ্ন হলো, পদ্মা সেতু অনুভূমিকভাবে বাঁকা কেন?
একটা ব্যাখ্যা হলো, পদ্মা সেতু অনেক দীর্ঘ। ৬.১৫ কিলোমিটার। এত লম্বা পথ যদি সরলরেখার মতো সোজা হয়, তাহলে গাড়ির চালকেরা অনেক সময় অমনোযোগী হয়ে পড়েন। চালকদের হাত স্টিয়ারিংয়ে না–ও থাকতে পারে। একটু বাঁকা সেতুতে চালকদের হাত স্টিয়ারিংয়ের ওপরে থাকবে, মনোযোগও থাকবে গাড়ি চালানোর দিকে। ফলে দুর্ঘটনা ঘটার শঙ্কা অনেক কমে যাবে।
একটা স্থলসড়কে দুর্ঘটনা আর একটা সেতুর ওপরে দুর্ঘটনার মধ্যে পার্থক্য আছে। কোনো দুর্ঘটনাই কাম্য নয়; কিন্তু সেতুর ওপরে দুর্ঘটনা ঘটলে তা সমস্যার সৃষ্টি করবে অনেক বেশি।
আরেকটা কারণ আছে দীর্ঘ সেতু অনুভূমিকভাবে একটু বাঁকা করে তৈরি করার। তা হলো বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির হেডলাইট সরাসরি চালকের চোখে পড়বে না। তাতেও দুর্ঘটনার শঙ্কা কমে যাবে।
তবে অনেক সেতু যে লম্বালম্বি বা ভার্টিক্যালি ধনুকের মতো বাঁকা করা হয়, কচ্ছপের পিঠের মতো বা উটের পিঠের মতো; তার প্রধান কারণ, ওজন বা লোড সেতুর স্প্যান থেকে দুই প্রান্তে ভাগ করিয়ে দেওয়া। সেতুর নিচে ঘন ঘন পিলার দেওয়া যাবে না, কারণ নিচ দিয়ে জলযান যাবে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ইঞ্জিনিয়াররা অনেক সময় ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ করেন। অনেক উঁচু পিলার তৈরি করে সেখান থেকে লোহার দড়ি ঝুলিয়ে সেতুটাকে ধরে রাখেন। রাঙামাটিতে পর্যটন মোটেলের পেছনে পায়ে হাঁটার ঝুলন্ত সেতু হলো এর ছোট্ট একটা উদাহরণ।
পদ্মা সেতুতে দুই পিলারের মাঝখানের লোড বা ওজন ধারণ করার জন্য ট্রাস ব্যবহার করা হয়েছে। তোমরা যদি বড় হয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ো, ট্রাস কী জানতে পারবে। সোজা বাংলায় বলি, ট্রাসে কতগুলো ত্রিভুজের সমাবেশ ঘটানো হয়। পদ্মা সেতুর নিচের ডেকে দেখবে, তিনটা করে বাহু দিয়ে পরপর ত্রিভুজ সাজানো আছে। এতে লোড বা ওজন বহন করে পিলার পর্যন্ত নিয়ে আসতে সক্ষম হবে এই ট্রাসযুক্ত স্প্যানগুলো।
পদ্মা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় নদীগুলোর একটা। এর ওপরে সেতু বানানো শুধু আর্থিক দিক থেকেই একটা চ্যালেঞ্জ নয়, এটা কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং চ্যালেঞ্জও।
একটা বড় চ্যালেঞ্জ হলো, নদীকে সেতুর নিচ দিয়ে বইতে বাধ্য করা। বাংলাদেশ পলিমাটির দেশ, নদী খুব পাড় ভাঙে, গতি বদলে ফেলে। এ জন্য নদীকে ট্রেনিং দিতে হয়, বা নদীশাসন করতে হয়। তা না হলে দেখা যাবে, সেতু সেতুর জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে, আর নদী অন্য জায়গায় চলে গেছে।
পদ্মা সেতুর পিলারগুলোর নিচে অনেক গভীর পাইলিং করা হয়েছে। তা করতে গিয়েও নতুন নতুন সমস্যা ইঞ্জিনিয়ারদের মোকাবিলা করতে হয়েছে।
তোমরা শুনলে হয়তো বিস্মিত হতে পারো, সেতুর ওপর দিয়ে চলাচলকারী রেলগাড়ি বা যানবাহনের ওজন, সেসবের গতির প্রতিক্রিয়া কিংবা সেতুর নিজের ওজনই শুধু হিসাব কষতে হয়নি, মানে শুধু ভার্টিক্যাল লোড, স্থির ওজন, চলন্ত ওজন, তারই হিসাব রাখতে হয়নি, অবশ্যই পানির লোড, বাতাসের ধাক্কাও হিসাবে রাখতে হয়েছে, সবচেয়ে বড় কথা, ভূমিকম্পের কথাও মাথায় রাখতে হয়েছে। আবার দুর্ঘটনাবশত কোনো জাহাজ এসে পিলারে ধাক্কা দিলেও যাতে সেতুর ক্ষতি না হয়, তা–ও হিসাবে রাখা আছে। ভূমিকম্পের আঘাতকে ইঞ্জিনিয়াররা বলেন হরাইজন্টাল লোড বা অনুভূমিক ওজন। সেটা সামলানোর জন্য বিয়ারিং বসানো হয়েছে পিলারে।
আমার বুয়েটের শিক্ষক ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল, যিনি আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকো থেকে পদ্মা সেতুর আন্তর্জাতিক এক্সপার্ট প্যানেলে যুক্ত থেকেছেন, প্রথম আলোর ইংরেজি অনলাইন সাইটে তিনি লিখেছেন, ইস্পাতের তৈরি ওপরের বড় কাঠামোর নিচে যে বিয়ারিং বসানো হয়েছে, তা পৃথিবীর বৃহত্তম। এত বড় বিয়ারিং এর আগে এ দেশে ব্যবহার করা হয়নি। ২০০২ সালে সান ফ্রান্সিসকোর বেনিসিয়া মার্টিনেজ সেতুতে এ ধরনের বিয়ারিং প্রথম ব্যবহার করা হয়।
ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়াল আরও বলছেন, প্রায় চার বিলিয়ন ডলার খরচের এই পদ্মা সেতুতে এত এত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে যে এর খরচকে যৌক্তিক বা রিজনেবল বলতে হবে। স্যার জানাচ্ছেন, সান ফ্রান্সিসকোর ওকল্যান্ড বে ব্রিজ নির্মাণের সময়ও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছিল, আর ২০০২ থেকে আরম্ভ করে ২০১৩ সালে সম্পন্ন ওই সেতুর নির্মাণ খরচ পড়েছে ৬.৩ বিলিয়ন ডলার। (১ বিলিয়নে ১০০ কোটি)।
এসো, আমরা আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের জন্যও একটা হাততালি দিই, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের এই শুভ সময়ে।