ব্যাপারটা কেমন হবে ভাবো তো। লন্ডনের ব্যস্ততম কোনো এক দুপুরে ট্রাফিক সিগন্যালে ‘ওস্তাদ বাঁয়ে প্লাস্টিক, ওই ফার্মগেট-মহাখালী’ বলে শাঁ করে ছুটে যাচ্ছে ছয় নম্বর বাস। পাশের লেনে টুংটাং শিস বাজিয়ে দূর গ্রামের সখিনাকে মনে করে গান গাইতে গাইতে ভিনদেশি স্বর্ণকেশীকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন আমাদের রিকশা মামা। এহেন অবাক দৃশ্যান্তের রেশ কাটতে না কাটতেই আবার শুনলে ‘এই মুরগি! মুরগি! দেশি মুরগি!’ শব্দের পিছু পিছু পা চালিয়ে মোড় ঘুরতেই অপেক্ষা করছে আরেক বিস্ময়! ঝাঁকাভর্তি মুরগি মাথায় নিয়ে লন্ডনের ফুটপাতে ফেরি করে ফিরছেন কোনো এক প্রৌঢ় মুরগিওয়ালা। ছানাবড়া চোখ আরেকটুকু মেলতেই ফুটপাতের শেষ মাথায় জ্যান্ত একটা টং দোকান খুলে বসে আছেন পাড়ার গলির মোড়ের টং মামা। সত্যি না হলেও লন্ডনে এক টুকরো বাংলাদেশ গড়াটা সম্ভব হয়েছিল স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে। লন্ডনের রয়েল ফেস্টিভ্যাল হলের গ্রিন সাইড লবির আলকেমি উৎসবে দুর্দান্ত এই আর্টে আমাদের চেনা পথের গল্পকে বিশ্বের মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন বাংলাদেশি কার্টুনিস্ট ও গ্রাফিক আর্টিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় এবং আসিফুর রহমান। সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাজ্যভিত্তিক গ্রাফিক নভেলিস্ট ক্যারি ফ্রান্সম্যান।
ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের আমন্ত্রণে কিছুদিন আগেই বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন ক্যারি ফ্রান্সম্যান। এ দেশের রাস্তায়, মানুষের প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের টুকরো স্কেচ, পথের ধারে চুন খসতে থাকা পুরোনো বিল্ডিং, আনমনা ব্যস্ত পথচারী, রিকশা-চলন্ত লোকাল বাস, মুদি দোকান, টংয়ের আড্ডা, ফুটপাত, কারেন্টের তার, তারে বসে দোল খাওয়া শহুরে কাক, ফেরিওয়ালা, এসব প্রতিদিনের পথের গল্প নিয়ে বাংলাদেশ ও যুক্তরাজ্যের এই তিন শিল্পীর নিজেদের শৈল্পিক অভিজ্ঞতা আর ঢাকা শহরের খুবই চেনা পরিচিত দৃশ্যপট নতুন এক ভঙ্গিমায় ফুটে উঠেছে এই স্থাপনা শিল্পে।
সৈয়দ রাশাদ ইমাম দারুণ খুশি এতে অংশ নিতে পেরে। তিনি বলেন, ‘এবারের উৎসবে ঢাকা শহরের ইন্সটলেশন তৈরি করতে পারার সুযোগ ও অভিজ্ঞতা দুটোই আমাদের জন্য ছিল অনেক আনন্দের এবং উত্তেজনার। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ফেস্টিভ্যাল দেখতে আসা মানুষের এই এক টুকরো বাংলাদেশের সঙ্গে মিশে যাওয়ার মুহূর্তগুলো কিংবা বিদেশ-বিভুঁইয়ে হঠাৎই রাস্তার পাশে বাংলা সাইনবোর্ড দেখে থমকে যাওয়া পথচারী বাঙালির নস্টালজিক চোখ, এসবই ছিল পথের গল্পের সার্থকতা।’
ওপাশ থেকে ক্যারি বলেন, ‘এই বিশাল ইন্সটলেশনের পুরোটা দেখার জন্য আমি এই সপ্তাহ ধরে বেশ উত্তেজনা নিয়ে মুখিয়ে ছিলাম। ব্রিটিশ কাউন্সিলের সঙ্গে আলকেমি ফেস্টের জন্য করা এ কাজটায় আমি ছাড়াও দুজন মেধাবী বাংলাদেশি ছিল আর এটা একটা বেশ বড় আকারে করা বাংলাদেশের পথঘাটের দৃশ্যের মঞ্চের মতো বিনির্মাণ, যার মাঝখান দিয়ে আপনি হেঁটে বেড়াতে পারবেন। অসাধারণ অভিজ্ঞতা।’
মূলত দুই বছর ধরে ব্রিটিশ কাউন্সিল বাংলাদেশ এখানকার গ্রাফিক এবং কমিকস ধাঁচের গল্প বলিয়ে শিল্পমাধ্যমগুলো নিয়ে কাজ করছে। বিভিন্ন কর্মশালা, দুই দেশের গ্রাফিক আর্টিস্টদের মধ্যে সাংস্কৃতিক এবং শৈল্পিক ভাববিনিময় ও যোগাযোগের ঘটনাগুলো ঘটে সে সূত্রেই। এরই ধারাবাহিকতায় আয়োজিত হয়েছিল এই উৎসব।
পথের গল্পের অন্যতম আকর্ষণীয় অংশ ছিল স্থানীয় কয়েকটি স্কুলের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হইচই আর বেশ মজার একটি আঁকিবুঁকির কর্মশালা, যেখানে তারা একেবারে অপরিচিত একটি শহরের দৃশ্যপটে নিজেদের মতো করে মিশে গিয়েছিল। আনন্দে আর হাসিতে মেতে ছিল তারা পুরোটা সময়।