নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা

ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ওই তো অপু দৌড়ে যাচ্ছে কাশবন দিয়ে। ওই তো দুর্গা মলিন শাড়িতে দেহ ঢেকে সঙ্গী হয়েছে ওর! দুলছে কাশবন, তার মাঝ দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দুই ভাইবোন! সত্যজিৎ রায়ের তৈরি পথের পাঁচালী ছায়াছবির এই দৃশ্যটি কি কেউ ভুলতে পারে? ছবিটি সাদা-কালো। কিন্তু কাশবনে ভাইবোনের ছুটে চলার এই ছবিকে এখনো আমার কাছে সবচেয়ে রঙিন ছবি বলে মনে হয়।

কেন মনে হয়, তা আজও ভেবে পাইনি। ওই ছোট্ট অপুর বয়সে ছবিটি দেখেছিলাম বলেই কি? নাকি এটি ছিল এমন এক দৃশ্য, যা এমনিতেই মনের মধ্যে আঁকা হয়ে যায় আর বছরের পর বছর মনকে রাঙিয়ে যায়?

সবাই জানে শরতে কাশবন হয়ে ওঠে মোহময়। বহুদূর থেকে সাদা কাশের সারি প্রফুল্ল করে মনকে।

পথের পাঁচালী উপন্যাসটি লিখেছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর লেখা পড়তে গেলে প্রথমেই অবাক হতে হয় উপন্যাসের সংলাপ দেখে। আরে! এ যে একেবারে মুখের কথা বসিয়ে দিয়েছেন চরিত্রগুলোর মুখে! কেউ যদি বিভূতিভূষণের উপন্যাস থেকে চলচ্চিত্র তৈরি করতে চান, তাহলে তাঁকে কষ্ট করে সংলাপ লিখতে হবে না। একেবারে উপন্যাসে লেখা সংলাপগুলো দিয়েই চালিয়ে দেওয়া যাবে।

তোমরা যদি এরই মধ্যে বিভূতিভূষণের উপন্যাসগুলো পড়ে থাকো, তাহলে তো তাঁর লেখনীশক্তির সঙ্গে পরিচিত হয়েই গেছ। তাঁর জীবনের পথটাও তো একটু জানা দরকার। সেটাই বরং একটু বলে নিই আগে। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার ঘোষপাড়া-মুরারিপুর গ্রামে পৃথিবীতে এসেছিলেন তিনি। এটি ছিল তাঁর নানাবাড়ি। ওই জেলারই ব্যারাকপুর গ্রামে ছিল তাঁর দাদাবাড়ি। তাঁর বাবা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সংস্কৃত পণ্ডিত। বাবা ছিলেন খুবই মেধাবী, তাই তাঁকে ‘শাস্ত্রী’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

বিভূতিভূষণ নিজেও খুব মেধাবী ছাত্র ছিলেন। বিএ পরীক্ষায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করেন। এমএতে ভর্তি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু পড়াশোনা আর না করে ১৯১৯ সালে হুগলির একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে ‘উপেক্ষিতা’ নামে তাঁর একটি গল্প ছাপা হয় প্রবাসীতে। এই গল্প দিয়েই সাহিত্যিক জীবনের শুরু। চাকরিসূত্রে ভাগলপুরে যখন থাকছেন, তখনই তিনি পথের পাঁচালী লেখা শুরু করেন। সেটা ছিল ১৯২৫ সাল। উপন্যাসটি শেষ করেন ১৯২৮ সালে। বাংলার পল্লিজীবনের এমন অসাধারণ বর্ণনা বাংলা সাহিত্যেই খুঁজে পাওয়া ভার!

ছবি: সাহাদাত পারভেজ

উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পরপরই বিপুল খ্যাতি অর্জন করে। এরপর অনেক গল্প-উপন্যাসই লিখেছেন তিনি, কিন্তু এটাই তাঁর শ্রেষ্ঠ রচনা—এ কথা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায়। তোমরা যারা সত্যজিৎ রায় গুলে খেয়েছ, তারা তো জানোই, পথের পাঁচালীর পর বিভূতিভূষণ অপরাজিত নামে আরেকটি উপন্যাস লিখেছিলেন, যা ছিল আগের উপন্যাসটিরই ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ ওই ছোট্ট অপু যখন বড় হলো, তা নিয়েই উপন্যাসের কাহিনি। সবচেয়ে মজার ব্যাপার, সত্যজিৎ রায় চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে প্রথম ছবিটি করার জন্য বেছে নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণের প্রথম উপন্যাসটিকে। আর একটা তথ্যও তোমাদের ভালো লাগতে পারে, ভারতের বিভিন্ন ভাষায় তো পথের পাঁচালী অনূদিত হয়েছেই, আরও হয়েছে ইংরেজি আর ফরাসি ভাষায়।

ইছামতী উপন্যাসের জন্য বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় মরণোত্তর ‘রবীন্দ্র পুরস্কার’ পেয়েছিলেন। সেটা ছিল ১৯৫১ সাল। তার এক বছর আগে ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর ব্যারাকপুরের ঘাটশিলায় তিনি মারা যান।

আমরা আমাদের কথা শুরু করেছিলাম অপু আর দুর্গার কাশবন বিহার দিয়ে। শরতের কাশবন যে দেখেনি, সে জানে না, জীবনে সে কী হারাল! বর্ষার ঝরঝর বৃষ্টি সারা দিন ঝরার পর শরৎ যখন আসে, তখন কী এক শান্ত-স্নিগ্ধ হয়ে ওঠে মন। প্রকৃতি থেকে দূর হয়ে যায় মলিনতা। এ সময় রঙের যে বিচিত্র আর অপূর্ব খেলা শুরু হয় প্রকৃতিজুড়ে, আর তুলনা মেলা ভার। সোনালি রোদ, কাশবন, নদীর কুল কুল বয়ে যাওয়া মনকে আনন্দ আর উচ্ছ্বাসে ভরে তোলে।

এই শরতে একটু আকাশের দিকে মুখ তোলো। কী দেখছ? সাদা মেঘগুলো নীল আকাশের নিচ দিয়ে মহা-আনন্দে কোথায় যেন ছুটেছে! মাঠের দিকে তাকাও, দেখতে পাচ্ছ ফসলের ফুল আসতে শুরু করেছে? পানিতে কী দেখতে পাচ্ছ? ঠিক, এই শাপলা, এই পদ্ম তো তোমাকে খুশি করার জন্যই ভেসে বেড়াচ্ছে। শিউলি আর জুঁই ফুল দেখেও কি তুমি আনন্দিত হয়ে উঠছ না? আরও একটা কথা বলে রাখি, শরতের রাতের আকাশটাকে একটু একান্তে পাওয়ার জন্য গ্রামের বাড়ির আশ্রয় নিতে হবে। এই ঋতুর নির্মল জ্যোৎস্না তোমার হৃদয়ে ছোঁবে।

আমি যখন শরতের কথা ভাবি, তখন আমার মনজুড়ে থাকে অপু-দুর্গা। আর তাদের হাত ধরে আমি চলে যাই বিভূতিভূষণ আর সত্যজিৎ রায়ের কাছে। তারপর পুরো প্রকৃতিকে দেখি আর ভাবি, আমাকে পূর্ণ করে তোলার জন্য কত আয়োজনই না সাজিয়ে রেখেছে শরৎ।

(কিশোর আলোর সেপ্টেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় প্রকাশিত)