নতুন বছর উদ্‌যাপনের অদ্ভুত সব রীতি!

সময় বড় অদ্ভুত, কারও জন্য থেমে থাকে না। এই না সেদিনই এল ২০২১! চোখের পলকে একে একে বারোটি মাস পেরিয়ে এখন আবার আমরা পা দিয়ে ফেলেছি ২০২২-এ।

তবে এই ২০২২ সাল নিয়েও খুব একটা উচ্ছ্বসিত হওয়া বোধ হয় ঠিক হবে না। কারণ, শিবরাম চক্রবর্তী তো জানিয়েই গেছেন তাঁর গবেষণালব্ধ সিদ্ধান্ত—কোনো নতুন বছরই এক বছরের বেশি টেকে না!

কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, এত ক্ষণস্থায়ী নতুন বছরের আগমন নিয়েও বিশ্বব্যাপী উৎসাহ-উদ্দীপনা-উন্মাদনার কোনো কমতি নেই। এমনকি অনেক দেশ তো বিচিত্র ধরনের উদ্‌যাপনের মাধ্যমেও নতুন বছরকে বরণ করে নেয়।

গোলের মোহ

গোলের প্রতি আসক্তি কেবল মেসি-রোনালদোরই নয়! ফিলিপাইনের মানুষও গোল জিনিসের প্রতি খুব বেশি মোহগ্রস্ত। নতুন বছরের শুরুতে তাদের প্রথা হলো, বছরের বারো মাসের কথা মাথায় রেখে আঙুর, কমলা, আপেল, তরমুজ, খরমুজের মতো গোল গোল বারো ধরনের ফল একত্র করা। তারা ভাবে, গোল আকৃতি হলো সম্পদ ও সমৃদ্ধির প্রতীক। অনেকে আবার পলকা ডটওয়ালা কাপড় পরেও ঘুরে বেড়ায় আর পকেট ভর্তি করে রাখে গোলাকার কয়েন দিয়ে।

জানালা দিয়ে কাগজ ছোড়া

৩১ ডিসেম্বর দুপুরের খাবারের সময় আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। দেখা যায়, রাস্তার ওপর ছড়িয়ে রয়েছে অজস্র কনফেত্তি বা রঙিন কাগজের টুকরা। কেন জানো? কারণ, একটি বছরের পর্দা নামার আগেই আর্জেন্টাইনরা তাদের পুরোনো সব কাগজপত্র, দলিল-দস্তাবেজ জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দেয়। এর প্রতীকী অর্থ হলো, তারা অতীতকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে যেতে চায়। পুরোনো বছরের দুঃখ-ক্লেদকে নতুন বছরে বয়ে নিতে চায় না। আর্জেন্টাইনদের এমন রীতিকে যতই অদ্ভুত লাগুক, অন্য কিছু দেশের জানালা দিয়ে ছোড়াছুড়ির বৃত্তান্ত শোনার পর সেটিকে বরং স্বাভাবিকই মনে হবে। লাতিন আমেরিকার কিছু দেশের বাসিন্দারা ভালোবাসে জানালা দিয়ে পানির বালতি ছুড়ে ফেলতে। আর দক্ষিণ আফ্রিকানরা বিশাল উচ্চতা থেকে নির্মমভাবে ছেড়ে দেয় তাদের পুরোনো আসবাব।

প্লেট ভাঙা

কাউকে ফেসবুকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠানোর মাধ্যমে বন্ধুত্বের আহ্বান জানাতে কি তোমার ভালো লাগে না? ডেনমার্কে গিয়ে আরও সহজ উপায়ে তুমি পেতে পারো নতুন বন্ধু। এ জন্য স্রেফ নতুন বছরের প্রাক্কালে তার দরজার সঙ্গে বাড়ি মেরে একটি প্লেট ভাঙতে হবে। বিশ্বাস করা হয়, যার দরজায় এই কীর্তি করা হবে, আসন্ন নতুন বছর তার জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনবে। তা ছাড়া, যার দরজার সামনে প্লেটের ভাঙা টুকরার জঞ্জাল যত বেশি হবে, তার ভাগ্য হবে ততটাই সুপ্রসন্ন। ফলে কারও ভালো যদি চাও, তাহলে নিজের সংগ্রহের সবচেয়ে বড় প্লেটটাই ভাঙা উচিত হবে তোমার।

আঙুর ফল মিষ্টি

শত বছর আগেকার কথা। আমাদের দেশে যেমন মাঝেসাঝেই বাতাবিলেবুর বাম্পার ফলন হয়, সে রকমই স্পেনে সেবার বাম্পার ফলন হয়েছিল আঙুরের। কিন্তু এত আঙুর খাবে কে? তাই আঙুরচাষিরা এক মজার খেলার আয়োজন করেছিলেন, যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্প্যানিয়ার্ডদের অতিপ্রিয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। কী সেই ঐতিহ্য? ঘড়ির কাঁটা যখন ১২ ছুঁয়ে দিয়ে নতুন বছরকে সাদর আমন্ত্রণ জানাবে, তখন পরপর ১২ সেকেন্ড তোমাকে গলাধঃকরণ করতে হবে ১২টি ভাগ্যবান আঙুর। একেকটি আঙুর নিশ্চিত করবে তোমার নতুন বছরের একেকটি মাসের সৌভাগ্য। কিন্তু সাবধান! যদি তুমি দুই-একটি আঙুরও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে খেতে ব্যর্থ হও, তাহলে বছরের শেষ দিকটা তোমার একটু কষ্টে কাটবে। আর ভুলে যেয়ো না, ফাইনাল পরীক্ষাগুলো কিন্তু নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকেই হয়! আর পরীক্ষা শেষের লম্বা ছুটিটাও এ সময়ই আসে!

জ্বলন্ত কাকতাড়ুয়া

ইকুয়েডরের মানুষ গত হতে যাওয়া বছরকে ‘আদিওস’ জানায় প্রকাণ্ড সব কাকতাড়ুয়া পোড়ানোর মাধ্যমে। কারণ, তারা বিশ্বাস করে, ওসব কাকতাড়ুয়াই হলো পুরোনো বছরের প্রতীকী রূপ। প্রতিটি পরিবার কাকতাড়ুয়া বানায় তাদের ঘরের বাতিল কাগজ আর কাপড় দিয়ে। এরপর সেটির মাথায় বসিয়ে দেয় একটি হাতে আঁকা মাস্ক (যেখানে আঁকা থাকতে পারে প্রিয় কার্টুন চরিত্র থেকে শুরু করে ঘৃণিত রাজনীতিবিদের মুখ, যেকোনো কিছুই)। আর সেই কাকতাড়ুয়াকে ছারখার করে দেওয়া হয়, ঠিক যখন ঘড়ির কাঁটা ১২ স্পর্শ করে।

এ ছাড়া প্রতিবেশী দেশ কলম্বিয়ার মতো ইকুয়েডরিয়ানরা আরেকটি প্রথাও মেনে চলে। সেটি হলো নতুন বছরের প্রথম প্রহরে হাতে একটি স্যুটকেস নিয়ে নিজ এলাকার অলিগলি ধরে হেঁটে বেড়ানো। এর মাধ্যমে তারা আশা করে, নতুন বছরে যেন তারা অনেক ভ্রমণ করতে পারে।

ধাতু গলানো

ফিনল্যান্ডের মানুষ ভবিষ্যৎ দেখতে পারে—অন্তত তেমনটিই তাদের দাবি। সে জন্য তারা ধাতু গলায়। নর্ডিক ঐতিহ্য হলো, একটি ছোট হর্স শু বা ঘোড়ার খুরের নাল গলিয়ে, সেই গলিত ধাতু এক বালতি ঠান্ডা পানিতে ঢেলে দেওয়া। এরপর যখন সেটি পুনরায় শক্ত হয়ে কোনো নির্দিষ্ট আকৃতি ধারণ করে, সেই আকৃতি থেকেই নির্ধারণ করা যায় আসছে বছরের ভাগ্য। আকৃতিটা বুদবুদের মতো? তাহলে অনেক পয়সা আসবে ঘরে! কিন্তু যদি ধাতুটা পানিতে ভেঙে ছত্রখান হয়ে যায়? বড্ড দুশ্চিন্তার বিষয়!

পশুর সঙ্গে আলাপ

নতুন বছরের সব আনন্দ বুঝি শুধু মানুষেরাই লুটবে? অবলা জীবজন্তুদের কি নতুন বছর উদ্‌যাপনের কোনো অধিকার নেই? অন্তত রোমানিয়ায় গেলে এমনটি মনে হবে না। কারণ, সে দেশের মানুষ নতুন বছরের শুরুতে চেষ্টা চালায় তাদের গৃহপালিত পশুর সঙ্গে কথা বলার, যোগাযোগ স্থাপনের। অবশ্য এতে রোমানিয়ানদের নিজস্ব স্বার্থও জড়িত। তারা বিশ্বাস করে, পশুদের সঙ্গে ভাব বা মতবিনিময়ে সফল হলে তারা সৌভাগ্য লাভ করবে। আরও কিছু অদ্ভুত রীতিও মানে তারা। যেমন সৌভাগ্যের আশায় নদীতে কয়েন ছোড়া, ভাল্লুকের চামড়ার পোশাক পরে এক বাড়ির দরজা থেকে আরেক বাড়ির দরজায় গিয়ে নাচানাচি করা ও বাদ্যযন্ত্র বাজানো। তাদের বিশ্বাস, এর মাধ্যমে তারা দুষ্ট আত্মাদের ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে পারবে।

হগমেনে

স্কটল্যান্ডে নতুন বছরের উদ্‌যাপনকে বলা হয় হগমেনে, যাকে কেন্দ্র করে হরেক রকমের কিংবদন্তি বা উপকথা চালু রয়েছে। একটি হলো এমন—নতুন বছরের শুরুতে মধ্যরাতে কোনো এক বিশালদেহী, শক্তপোক্ত লোক পানীয়, কয়লা, রুটি আর ব্ল্যাক বান (ফ্রুট কেক) নিয়ে হাজির হবে তোমার বাড়ির দোরগোড়ায়। শতাব্দী–প্রাচীন এ ঐতিহ্য আজও অমলিন রয়েছে। নতুন বছরে কোনো বাড়ির পাশ দিয়ে প্রথম যে ব্যক্তি যান, তাঁকে ওই বাড়িতে বিতরণ করতে হয় বিভিন্ন উপহার। এ ছাড়া স্কটল্যান্ডে নতুন বছর উদ্‌যাপনে প্রচুর আগুনের ছড়াছড়িও দেখা যায়। ৩০ ডিসেম্বর রাজধানী এডিনবরায় হয় মশালমিছিল, যখন রাস্তাঘাট পরিণত হয় আলোর সমুদ্রে। স্টোনহ্যাভেন শহরের স্থানীয় বাসিন্দারা রাস্তায় হগমেনে প্যারেড করে প্রকাণ্ড সব ফায়ারবল নিয়ে।