বিকেলবেলা দোলটু মামার সঙ্গে বাইরে বেরিয়েছে তাহজিব। ওদের বাসা থেকে সুধীজন পাঠাগার বেশি দূরে নয়। তবু দোলটু মামা রিকশা ছাড়া যাবেন না। কিন্তু বাসার সামনে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকেও একটা খালি রিকশা পাওয়া গেল না। অগত্যা গজগজ করতে করতে দোলটু মামা তাহজিবকে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
‘আচ্ছা মামা, তুমি সকালে বলছিলে যে একটা বিষয় নিয়ে খুব চিন্তা করছ। সে জন্য পাঠাগারে গিয়ে বই দেখবে। তা বিষয়টা কী?’
‘আগে চল, তারপর বলব।’
বড় রাস্তার পাশেই সুধীজন পাঠাগার। তিনতলা ভবনের প্রথম দোতলা ব্যাংক। তৃতীয় তলায় পাঠাগার। সিঁড়ি ভেঙে তিনতলায় উঠে বড় দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেই চোখে পড়ে বিশাল পাঠকক্ষ আর দেয়ালজুড়ে বইয়ের শেল্ফ। তাহজিব কাউন্টারে ওর দুটো বই জমা দিল। পাঠাগার সহকারী বই ফেরত নিয়ে কার্ডটা দিয়ে জানতে চাইল, কী বই নেবে।
‘আমাকে মূল্যস্ফীতির একটা বই দিন,’ দোলটু মামা ভারিক্কি চালে বললেন। কাউন্টারে দাঁড়ানো লোকটা একটু অবাক হয়ে বলল, ‘ঠিক বুঝলাম না। এটা কিসের বই? বা কোন লেখকের?’
‘বাব্বা,’ দোলটু মামা ব্যঙ্গের স্বরে বললেন, ‘এত বড় পাঠাগারে কাজ করেন আর মূল্যস্ফীতির বই চেনেন না?’
এবার আরেকজন লোক এগিয়ে এল। বলল, ‘আপনি যদি দয়া করে ক্যাটালগ দেখে নাম বা নম্বর বলেন, তাহলে আমরা বের করে দেব।’
‘বেশ বলেছেন,’ দোলটু মামা রেগে উঠলেন। ‘ক্যাটালগ দেখেই যদি আমি বইয়ের নাম বলে দেব, তাহলে আপনারা আছেন কেন?’
‘মামা,’ তাহজিব এবার বলল। ‘পাঠাগারে এসে ক্যাটালগ দেখেই বইয়ের নাম দিতে হয়।’
‘তুই চুপ থাক,’ দোলটু মামা ধমকে উঠলেন। ‘আমার অত সময় নেই।’
‘পাঠাগারে সময় নিয়েই আসতে হয়,’ পাশ থেকে একটা পরিচিত কণ্ঠ শুনে চমকে উঠলেন দোলটু মামা। তাকিয়ে অবাক হয়ে বললেন, ‘কিরে, তুই আবার কখন এলি?’
‘আমি ভার্সিটি থেকে সোজা চলে এসেছি,’ মায়শা বলল। ‘বই বদলাতে হবে।’
‘এই যে মায়শা আপু,’ তাহজিব অভিযোগের সুরে বলল। ‘দোলটু মামা ঠিকমতো বইয়ের নাম বলতে পারছে না। ক্যাটালগও দেখবে না। আবার কাউন্টারের চাচ্চুদের সঙ্গে রাগারাগি করছে।’
‘মানে? কী হয়েছে মামা? কী বই নেবে তুমি?’
‘আরে, আমি এদের বললাম যে মূল্যস্ফীতির একটা বই দিতে। এরা সব আকাশ থেকে পড়ল।’
মায়শা কোনোমতে হাসি চেপে বলল, ‘মামা, তুমি ওই টেবিলে গিয়ে বসো। আমরা বই নিয়ে আসছি।’ দোলটু মামা একটা পড়ার টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসলেন। তাহজিব ও মায়শা নতুন বই নিল। বইয়ের পেছনে একটা কাগজে ফেরত দেওয়ার শেষ তারিখের সিল দেওয়া হয়। আর বইয়ের নাম ও নম্বরসহ একটা কার্ডেও একই সিল দেওয়ার পর তাতে স্বাক্ষর করতে হয়। এরপর সেই কার্ড আবার যে নিচ্ছে, তার নাম-ছবিসহ সদস্য কার্ডে ভরে রেখে বই দেওয়া হয়।
‘তা তোমার মূল্যস্ফীতির বই দরকার হলো কেন?’ মায়শা এসে আরেকটা চেয়ার টেনে দোলটু মামার পাশে বসতে বসতে বলল।
‘আগে বল, ওরা এই বই দিতে পারল না কেন?’
‘শোনো, তোমাকে চাইতে হবে অর্থনীতির বই। আর শুধু মূল্যস্ফীতির কিছু বইও আছে। সেগুলো প্রায় সবই ইংরেজিতে। সুনির্দিষ্ট করে বলতে হবে। তা মূল্যস্ফীতি নিয়ে আবার তোমার চিন্তা শুরু হলো কেন?’
‘সেদিন তো দামের বাড়া-কমা আর মূল্যস্ফীতি নিয়ে কী সব বুঝিয়ে দিলি...’
‘মামা, মায়শা আপু কিন্তু সহজ করে বুঝিয়ে দিয়েছে,’ তাহজিব প্রতিবাদ করে উঠল। ‘তুমি এখন কী সব বলছ কেন? সেদিন তো খুব প্রশংসা করলে।’
‘বড়দের কথার মাঝখানে কথা বলা ভীষণ বেয়াদবি,’ দোলটু মামা চটে গেলেন। ‘তুই কিন্তু বেয়াদবি করছিস।’
‘আহ্ তাহজিব, চুপ থাক,’ মায়শা মৃদু ধমক দিল। ‘বলো মামা, সমস্যাটা কী?’
‘আরে, তুই তো ভালোই বুঝিয়েছিলি যে অনেক টাকা যখন অল্প জিনিসের পেছনে ছোটে, মানে খরচ করতে চাওয়া হয়, তখনই মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়,’ দোলটু মামা বললেন। ‘এও বললি যে চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু আজকে সকালে প্রথম আলোতে একটা খবর পড়লাম। ওখানে বলছে যে বাংলাদেশ ব্যাংক নাকি মূল্যস্ফীতি ৬ না ৭ শতাংশে নামিয়ে আনতে চায়। আমি তো খবরটা পড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। এখন কি ব্যাংকের লোকজন নিজের কাজ ফেলে বাজারে বাজারে যাবে দাম কমাতে?’
‘আসলেই বাংলাদেশ ব্যাংকের লোকজন কখনোই বাজারে বাজারে যাবে না দাম কমাতে,’ মায়শা বলল। ‘তবে মূল্যস্ফীতি যেন কমে আসে, সে জন্য ওরা বাজার থেকে টাকা কমিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।’
‘সেটা কীভাবে?’
‘আমাদের টাকা সব আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে,’ মায়শা বলল। ‘সরকারের পক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপে ও বাজারে ছাড়ে। মানুষজন এই টাকা পায় বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে। যেমন সোনালী ব্যাংক বা ঢাকা ব্যাংক। বাজারে যখন টাকার পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়, মানে মানুষের হাতে যখন অনেক টাকা চলে আসে, তখন কী হয় তা তো আমরা জানি।’
‘তখন অনেক টাকা অল্প জিনিসের পেছনে ছুটতে থাকে,’ তাহজিব বলল। ‘তাই মূল্যস্ফীতি হয়।’
মায়শা বলল। ‘মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে কী করতে হবে?’
‘মানুষের হাতে যেন বেশি টাকা না থাকে, সে ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘ভেরি গুড, তোকে একটা চিকেন কাটলেট খাওয়াব,’ মায়শা বলল। ‘এখন এই টাকা মানুষের হাত থেকে মানে বলা যায়, বাজার থেকে তুলে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার বাড়ালে অন্য ব্যাংকগুলোও বাড়ায়। তখন দুটো ঘটনা ঘটে।’
‘কী সেই দুটো ঘটনা?’
‘একদিকে যাদের হাতে অনেক টাকা, তারা চিন্তা করে যে এত টাকা খরচ করার চেয়ে ব্যাংকে জমা রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যাবে। আগে ১০০ টাকায় ১০ টাকা পাওয়া গেলে এখন পাওয়া যাবে ১২ টাকা। এভাবে অনেক টাকা ব্যাংকে এসে জমা হয়। ব্যস। নগদ খরচ করার টাকা কমে যায়। আরেক দিকে যাদের টাকা কম ছিল কিন্তু সুদ কম দিতে হতো বলে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে খরচ করছিল, তারাও ঋণ নেওয়া কমিয়ে দেবে। কারণ, ঋণ নিলে আগের চেয়ে বেশি সুদ দিতে হবে। এভাবে ব্যাংক থেকে মানুষের হাতে টাকা যাওয়া কমে যায়।’
‘তাতে করে মূল্যস্ফীতি কমবে কীভাবে?’ দোলটু মামার প্রশ্ন।
‘তখন তো আর অনেক টাকা অল্প জিনিসের পেছনে ছুটবে না,’ মায়শা বলল। ‘টাকা কমে যাওয়ায় খরচ করার লোকও কমে যাবে। আগের চেয়ে চাহিদা অনেক কমে যাবে। বিক্রি করার জন্য বিক্রেতারা দাম আগের চেয়ে কমিয়ে দেবে। এভাবে বিভিন্ন জিনিসের দাম কমে মূল্যস্ফীতিও কমে আসবে।’
দোলটু মামা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন। ‘কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক না বললে কি ব্যাংকগুলো সুদের হার বাড়াবে না?’
‘আসলে বাংলাদেশ ব্যাংক এখন সরাসরি সুদের হার বাড়াতে-কমাতে বলে না,’ মায়শা বলল। ‘বাংলাদেশ ব্যাংকের মতো কেন্দ্রীয় ব্যাংক পৃথিবীর সব দেশেই আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে অন্য ব্যাংকগুলো বিভিন্ন সময় টাকা ধার নেয়। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ধার দেওয়ার জন্য যে সুদ নেয়, সেটা বাড়িয়ে দেয়, তাহলেই হলো। অন্য ব্যাংকও নিজেদের সুদের হার বাড়িয়ে দেয়। আবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে টাকা জমা রাখলে যে সুদ পাওয়া যায়, সেটাও বাড়িয়ে দিতে পারে। কোনটা করবে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক ওই সময়ের অবস্থা বুঝে ঠিক করে।’
‘বেশ সোজাই তো মনে হচ্ছে,’ দোলটু মামা বললেন।
‘আমি সোজা করে বলার চেষ্টা করলাম.’ মায়শা বলল। ‘বাস্তবে তো আর অত সোজা না, বরং বেশ জটিল। জটিলতা নাহয় পরে বোঝা যাবে।’