বৃষ্টি শিকদার কাজ করেছেন গুগলের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ডিপ মাইন্ড টেকনোলজিসে। পড়েছেন এমআইটিতে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিক্স অলিম্পিয়াডে পেয়েছেন বিশ্বসেরা নারী প্রোগ্রামারের স্বীকৃতি। বর্তমানে উপাত্ত ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রুব্রিকে কর্মরত আছেন সফটওয়্যার প্রকৌশলী হিসেবে। কিশোর আলোর পাঠকদের জন্য বৃষ্টি জানাচ্ছেন তাঁর স্বপ্নের কথা।
আমার গোটা শৈশব কেটেছে পাহাড়ঘেরা চট্টগ্রাম শহরে। চট্টগ্রামের গ্রামার স্কুল থেকেই শেষ করেছি ও লেভেল, এ লেভেল। পড়াশোনায় যে খুব ভালো ছিলাম তা নয়, তবে নিজের অবস্থান থেকে সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করতাম। সৌভাগ্য যে সে সময়ে এ লেভেলে চারটি বিষয়ে সারা দেশের ভেতর সবচেয়ে বেশি নম্বর পাই আমি। আর ও লেভেলে সে সময় কম্পিউটার সায়েন্সে সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি নম্বর এসেছিল আমার। সব মিলিয়ে ভালোই কাটছিল দিন।
স্কুলে থাকতেই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের অলিম্পিয়াডে নিয়মিত অংশ নিতাম। ২০১০ সালে জাতীয় বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হই। ২০১৩ সালে জাতীয় গণিত অলিম্পিয়াডে জাতীয় পর্যায়ে রানার্সআপ হওয়ার সৌভাগ্য হয় আমার।
একদিন স্কুলে স্যারের টেবিলে দেখি, চিঠি এসেছে কোনো একটা অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য। জাতীয় ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডের চিঠি ছিল ওটা। বিস্তারিত জেনে বন্ধুদের সঙ্গে ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে যাই আমি। প্রথম বছরেই বেশ ভালো ফল। পরের বছর অবশ্য এত ভালো হলো না। তাই ২০১২ সালের আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য বেশ ভালোভাবে প্রস্তুতি নিই আমি। সে বছর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্রোঞ্জ মেডেল পাই। এমনকি ওরা আমাকে ‘বিশ্বসেরা নারী প্রোগ্রামার’ অ্যাওয়ার্ড দেয়। আমি তখন আসলেই এত কিছু পাওয়ার যোগ্য ছিলাম বলে মনে হয় না।
এরপর কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংই হয়ে ওঠে আমার স্বপ্ন। আমার সবচেয়ে প্রিয় কাজ হয়ে দাঁড়ায় প্রোগ্রামিং। এখন মনে হয়, গোটা জীবনটাই হয়তো শুধু কম্পিউটার প্রোগ্রামিং করে কাটিয়ে দিতে পারব আমি।
আন্তর্জাতিক ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে পদক জেতার কারণে ম্যাসাচুসেটস ইন্সটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) -তে ভর্তি হতে বেগ পেতে হয়নি আমাকে। এ ছাড়া ভর্তির আবেদনের সময় দেওয়া রচনাটাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বিশ্বের সব বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু তোমার একাডেমিক ফলাফলের প্রতি তেমন কোনো গুরুত্বই দেবে না। বরং তুমি যদি নিজে কোনো গবেষণা করো কিংবা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যেকোনো প্রতিযোগিতায় খুব ভালো ফল করো, সেটা তোমার জন্য অনেক বড় সুযোগ হিসেবে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অলিম্পিয়াডগুলো কিন্তু তোমাদের জন্য বড় সুযোগ।
পড়াশোনার বাইরে এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিসে অনেক বেশি ভালো করাটাও বিশ্বের নামীদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করে। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের ভর্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজকে খুব বেশি মূল্যায়ন করে। তাই ভালো কোথাও পড়াশোনা করার জন্য কিন্তু সব সময় বিজ্ঞান বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো বড় বড় বিষয়ে পড়াশোনা করতে হবে, তা কিন্তু নয়; বরং তুমি তোমার প্রিয় বিষয় নিয়ে নিজের অবস্থান থেকে সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করো। সেই বিষয়ে নিজেকে আরও বেশি দক্ষ করে তোলো। তুমি তোমার পছন্দের বিষয়ে সেরা হতে পারলে বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোই তোমাকে খুঁজে নেবে।
একদিন দেখি, এমআইটির ক্যাম্পাসে একদল মানুষ এসেছে গুগল থেকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গুগলের জন্য নিয়োগ করছিল। আমি একটু সাহস করে সেখানে ইন্টারভিউ দিই। এরপর ক্রমান্বয়ে গ্রুপ ভাইভা পার করে ভাগ্যক্রমে আমি গুগলে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পেয়ে যাই। এরপর আমি আমার গ্র্যাজুয়েশন শেষে ডিপ মাইন্ডে কাজ করার সুযোগ পাই।
গুগলে কাজ করার জন্য কম্পিউটার প্রোগ্রামিংয়ে দক্ষতা অর্জন করতে হবে। এ জন্য তোমাকে কোডিং শিখতে হবে। কোডিং শুরু করে কিন্তু শুধু প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাগুলোতেই অংশগ্রহণ করা যায় না, বরং আমরা আরও নানা রকম প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করতে পারি। কারও ব্লক চেইন ভালো লাগতে পারে। আবার কেউবা ম্যাশিন লার্নিং নিয়েও কাজ করতে পারে। এ ছাড়া কম্পিউটার পরিচালনার জন্য বহুল প্রচলিত একটি বিষয় হলো সিস্টেম ডিজাইন। কম্পিউটারের ব্যাক ইনডেড সিস্টেম ডিজাইনের ক্ষেত্রে এ বিষয় বেশ কাজের। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের মূল কাজ থাকে কম্পিউটার সিস্টেমের পেছনের এই কাজগুলো পরিচালনা করা। এ ধরনের কম্পিউটার প্রজেক্ট নিয়েও কিন্তু তোমরা কাজ করতে পারো। তোমরা যদি অনেকে এ ধরনের প্রোগ্রামিং প্রজেক্টে একসঙ্গে কাজ করো, তাহলে আগামী দিনে দেশেই গুগলের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা সম্ভব।
আমি স্বপ্ন দেখতে প্রচণ্ড ভালোবাসি। আমি আগামী দিনে আমাদের দেশের মাটিতেই বিশ্বসেরা সব প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠার স্বপ্ন দেখি। আমার সব স্বপ্ন যে সব সময় পূরণ হয়, তা কিন্তু নয়। তবে আমি আমার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য অনবরত চেষ্টা করতে থাকি। তাই তোমরা যখন স্বপ্ন দেখবে, তখন সামান্য বাধা পেয়েই হাল ছেড়ে দেবে না। তোমাদেরও সব সময় নিজের স্বপ্নের পেছনে লেগে থাকতে হবে। আমরা সব সময় সফল মানুষদের সফলতার অংশ থেকে দেখি। কিন্তু কেউ তার পেছনের অগণিত ব্যর্থতাকে দেখি না। বিশ্বের প্রত্যেক সফল মানুষ কিন্তু ব্যর্থতাকে বারবার মেনে নিয়েই সফল হয়েছে। এ জন্য তোমাকে পরিশ্রমী ও অধ্যবসায়ী হতে হবে। আর সব সময় নিজের কাজের প্রতি সৎ থাকতে হবে। সৎ থাকা বলতে তোমার কাজকে কখনো অবহেলা করা চলবে না। সব সময় সঠিক সময়ের মধ্যে তোমার কাজ শেষ করতে হবে। কেননা, দিন শেষে তোমার এই কাজই তোমাকে সফলতার শীর্ষে পৌঁছে দেবে।
অনুলিখন: আলিমুজ্জামান