দেশে দেশে বইমেলা

ছবি: মনিরুল আলম
বই সভ্যতা-সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। মানুষের অর্জিত জ্ঞান আর ইতিহাস এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে স্থানান্তরের গুরুদায়িত্ব যুগ যুগ ধরে পালন করে আসছে বই। তাই সময়ের প্রয়োজনেই সারা বিশ্বে বইমেলা আলাদা এক স্থান দখল করেছে। এখন বইমেলা মানেই বিভিন্ন ভাষা, মত বা সংস্কৃতির মিলনমেলা। দেশে দেশে এ বইমেলার আছে নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্য। পরিচিত কিছু বইমেলা সম্পর্কে জানাচ্ছে আবুল বাসার

একুশে বইমেলা

বাংলাদেশে বইমেলা বলতে মূলত বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে গ্রন্থমেলাকেই বোঝায়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন রফিক, জব্বার, বরকত, সালামসহ আরও অনেক তরুণ। সে সংগ্রামে অর্জিত হয় বাংলা ভাষার রাষ্ট্রীয় সম্মান। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ পায় স্বাধীনতা। নবগঠিত বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক-সাহিত্যিক জাগরণের প্রথম প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা। আসলে মায়ের ভাষা বাংলার জন্য যাঁরা নিজের প্রাণ তুচ্ছ করেছিলেন, তাঁদের স্মৃতির উদ্দেশেই এই বইমেলার নাম অমর একুশে গ্রন্থমেলা।

১৯৭২ সালের কথা। চিত্তরঞ্জন সাহা নামের এক ব্যক্তি বাংলা একাডেমির উঠানে কিছু বই নিয়ে বসলেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। তিনি একজন প্রকাশক। একসময়ের খুবই নামকরা প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারার কর্ণধার তিনি। বাংলাদেশের প্রগতিশীল ও মুক্তমনা লেখকদের বই প্রকাশ করত মুক্তধারা। সে বছর বাংলা একাডেমিও একুশ উপলক্ষে হ্রাসকৃত মূল্যে বই বিক্রয় করেছিল। কিন্তু চিত্তরঞ্জন সাহার মুক্তধারা ছিল একমাত্র বেসরকারি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। সেই শুরু। এভাবে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি একাডেমি প্রাঙ্গণে একুশ উপলক্ষে একাই বইমেলা চালিয়ে যান। পরের বছর চিত্তরঞ্জন সাহার সাফল্য দেখে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাঁর সঙ্গে সেখানে বই বিক্রি শুরু করে। পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে সেখানে বই বিক্রেতাদের সংখ্যা বেড়ে যায়। এ কারণে সে বছরই বাংলা একাডেমি একুশ উপলক্ষে বই বিক্রেতাদের বই বিক্রির এ প্রচেষ্টাকে বইমেলা হিসেবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয়।

তারপর ১৯৮৪ সালে বাংলা একাডেমি এ বইমেলাকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা নামে নামকরণ করে। প্রতিবছর এই মেলার পরিধি বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রতিবছরই মেলায় স্টল, নতুন বই, দর্শক, পাঠক আর লেখকদের সংখ্যাও বাড়ছে। একাডেমি প্রাঙ্গণ ছাড়িয়ে মেলা বিস্তৃত হয়েছে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা

ফ্রাঙ্কর্ফুট বইমেলা প্রায় ৫০০ বছরেরও প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী। বর্তমানে এটিই বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা। জার্মানিতে একে বলে ফ্রাঙ্কফুর্টার বুচমেস। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে জোহানস গুটেনবার্গের নাম। প্রায় ৫০০ বছর আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরের একদম কাছে মেঞ্জ শহরে গুটেনবার্গ সহজে বহনযোগ্য মুদ্রণযন্ত্র বা ছাপাখানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার পরপরই মুদ্রণশিল্পে বিপ্লব ঘটে। রাতারাতি বইয়ের দাম কমে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে আসে। তার আগ পর্যন্ত বই লিখতে হতো হাতে। তাতে সময় আর শ্রমের পাশাপাশি দামও হতো প্রচুর। তাই সে সময় জার্মানির চার্চের লাইব্রেরির বই হারানোর ভয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হতো।

কিন্তু গুটেনবার্গের ছাপাখানা বিপ্লবের কিছু দিন পর ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে স্থানীয় কিছু বই বিক্রেতার আগ্রহে ছোট আকারে একটি বইমেলার আয়োজন করা হয়। ধীরে ধীরে এ মেলা দর্শক-ক্রেতা-পড়ুয়া সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ১৭ শতক পর্যন্ত এই বইমেলাই ইউরোপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইমেলায় পরিণত হয়। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কারণে লিপজিগ বইমেলায় এ মেলা স্থানান্তর করা হয়। অনেক বিরতির পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা সেইন্ট পলস গির্জায় আবার শুরু হয়। তাতে এ বইমেলা তার হারানো ঐতিহ্য আবার ফিরে পায়।

প্রতিবছর অক্টোবরের মাঝামাঝি জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে এ মেলা শুরু হয়। পাঁচ দিনের এই মেলার প্রথম তিনদিন শুধু বই ব্যবসার সঙ্গে জড়িতরা অংশ নিতে পারেন। বাকি দুদিন সাধারণ দর্শকরা মেলায় ঢোকার সুযোগ পান। প্রতিবছর সারা বিশ্ব থেকে এখানে হাজার হাজার প্রকাশক, বিক্রেতা, লেখক, পাঠক, দর্শক, ব্যবসায়ী, সাংবাদিকসহ আরও অনেকে অংশ নেন।

লন্ডন বইমেলা

লন্ডন বইমেলা মূলত বই প্রকাশনা-বাণিজ্যের দিক দিয়ে বড়। সাধারণত প্রতিবছরের মার্চে ইংল্যান্ডের লন্ডন শহরে এ মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এই বইমেলা ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার চেয়ে বড় না হলেও ইদানীং এ বইমেলার আয়তন ও গুরুত্ব বাড়ছে। সম্প্রতি ২৩ হাজার প্রকাশক, বই বিক্রেতা, সাহিত্য প্রতিনিধি, লাইব্রেরিয়ান, মিডিয়া ও এই পুস্তকশিল্পের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠান ১০০টির বেশি দেশ থেকে অংশ নিয়েছিল। বই প্রকাশকেরা তাদের প্রকাশিতব্য বইয়ের প্রচারের জন্য, বইয়ের স্বত্ব বা অন্য ভাষার অনুবাদ স্বত্ব ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য এ মেলায় আসে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা যেমন সাধারণ পাঠকদের অংশগ্রহণে মুখর থাকে, তার প্রায় বিপরীত অবস্থা দেখা যায় লন্ডন বইমেলায়। এখানে সাধারণ পাঠকদের উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম।

কলকাতা বইমেলা

ফ্রাঙ্কফুর্ট, লন্ডন বইমেলার পর কলকাতা বইমেলা বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম হিসেবে ধরা হয়। এই বইমেলায় পাইকারি বই বিক্রেতা বা পরিবেশকের চেয়ে সাধারণ পাঠকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সে হিসাবে কলকাতা বইমেলা বিশ্বের বৃহত্তম অব্যবসায়িক বইমেলা। তা ছাড়া এটি এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বইমেলা এবং সারা বিশ্বে উল্লেখযোগ্য আন্তর্জাতিক বইমেলার সারিতে নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করতে পেরেছে।

অধিকাংশ কলকাতাবাসীর ধারণা, এ বইমেলা তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা ছাড়া কলকাতা কল্পনা করা যায় না। তাই বইমেলা চলার সময় কলকাতাবাসীর ঢল নামে প্রতিদিন।

হংকং বইমেলা

হংকং ট্রেড ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলের উদ্যোগে প্রতিবছর আয়োজিত হয় হংকং বইমেলা। হংকং কনভেনশন অ্যান্ড একজিবিশন সেন্টারে প্রতিবছরের জুলাই মাসে এই মেলা শুরু হয়। এই মেলা বই ছাড়াও বিভিন্ন স্টেশনারি, কম্প্যাক্ট ডিস্ক অন্যান্য মাল্টিমিডিয়া পণ্য প্রকাশিত ও ক্রয় বিক্রয় হয়। এখানে হংকংয়ের জনগণের সুবিধার জন্য দেশি-বিদেশি বই কম দামে বিক্রি হয়। হংকংয়ে কমিকসের বই খুব জনপ্রিয় হওয়ার কারণে কমিকসের জন্য একটি আলাদা মেলা আয়োজিত হয় হংকং বইমেলায়।

অন্য রকম বইমেলা

কমিকস আসলে সাহিত্যের মধ্যে পড়ে কি না, সে বিতর্ক করবেন সাহিত্যিকেরা। সেসব বিতর্ককে ঊর্ধ্বে রেখেই হংকংয়ে কমিকস খুবই জনপ্রিয় একটি শাখা। প্রতিবছর তাই হংকংয়ে কমিকস উৎসব আর কমিকস বইমেলার আয়োজন করা হয়। হংকংবাসীরা একে বলে এনি-কম হংকং। প্রতিবছর হংকং কনভেনশন অ্যান্ড একজিবিশন সেন্টারে আগস্টে এ উৎসব শুরু হয়।

কমিকেট

কমিকস নিয়ে উৎসব মেলা হংকং ছাড়া জাপানে হয়। জাপানের এই কমিকস নিয়ে বইমেলাকে বলা হয় কমিকেট বা কমিক মার্কেট। ১৯৭৫ সাল থেকে শুরু হয়েছিল এই মেলা। তার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটিই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কমিকস মেলা। জাপানের টোকিও শহরের আয়িরাকে প্রতিবছরের ডিসেম্বরে এই মেলা শুরু হয়। শুরুতে কমিকেটে মাত্র ৩০টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। আর দর্শক ছিল মাত্র ৭০০ জন। কিন্তু ২০০৬ সালে কমিকেটে দর্শক-ক্রেতাদের উপস্থিতি ছিল প্রায় সাড়ে চার লাখ।