মজাদার পিঠা আর খেজুরের রসের কারণে শীত এলে অনেকেই খুশি হয়। আবার শীতের মিষ্টি রোদও কম মজাদার নয়! এতসব ভালো ভালো আর মিষ্টি-মজার ব্যাপার থাকা সত্ত্বেও শীত থেকে বাঁচতে মানুষ লেপ-কম্বল, সোয়েটার, জ্যাকেট বা অন্যান্য গরম পোশাক ব্যবহার শুরু করে। আবার ভ্যাসলিন, লোশন ও নানা রকম তেল মুখে-হাতে-পায়ে-গায়ে মেখে নেয়, যাতে শরীরের আর্দ্রতা ঠিক থাকে। এসবই মানুষের শীতকালীন প্রস্তুতির ফিরিস্তি। এদিকে কোনো রকম সোয়েটার-জ্যাকেট বা লেপ-কম্বল গায়ে না দিয়েও নিম্ন শ্রেণির প্রাণীরা দিব্যি বেঁচে থাকে। কিন্তু কীভাবে?
অনেক প্রাণীই অতিরিক্ত শীতে বাঁচতে পারে না। এ ছাড়া অনেক এলাকায় শীতকালে প্রাণীদের খাদ্য সংগ্রহেও বেশ অসুবিধা দেখা দেয়। কিন্তু শীত থেকে বাঁচার জন্য তাদের রয়েছে প্রকৃতি প্রদত্ত নিজস্ব কিছু পদ্ধতি। আর এসব পদ্ধতির কারণেই তারা বরফের দেশের তীব্র শীতেও বেঁচে থাকে। একেক প্রাণী শীত থেকে বাঁচতে একেক পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। তাদের এসব পদ্ধতিকে মোটামুটি তিন ভাগে ভাগ করা যায়: পরিযান বা মাইগ্রেশন, শীতনিদ্রা বা হাইবারনেশন এবং অভিযোজন বা অ্যাডাপটেশন।
নিজের দেশ ছেড়ে দূরদেশে যাওয়ার নাম পরিযান
প্রতিবছর শীতকালে অনেক নাম না-জানা পাখিতে ভরে যায় আমাদের আশপাশের খাল-বিল বা জলাশয়। সুদূর উত্তর মেরু, সাইবেরিয়া থেকে এসব যাযাবর পাখি হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে আমাদের দেশে আসে। শীতপ্রধান অঞ্চলের এসব পাখি এ সময়কার প্রচণ্ড শীত সহ্য করতে পারে না। আবার তাদের এলাকায় এ সময় খাদ্যাভাব দেখা দেয়। তাই এসব পাখি দলবল নিয়ে অন্য দেশে চলে আসে, যেখানে ঠান্ডা একটু কম। এসব পাখিকে বলে মাইগ্রেটরি বার্ড বা পরিযায়ী পাখি। আমাদের দেশের মানুষ বেশি অতিথিপরায়ণ বলেই হয়তো এদের নাম দেওয়া হয়েছে অতিথি পাখি। অতিথি পাখিরা বসন্তের দিকে আবার নিজের দেশে ফিরে যায়। সেখানে নতুন করে নিজেদের বসতি গড়ে তোলে। এসব পাখির মধ্যে রয়েছে: বালিহাঁস, চখাচখি, কাদাখোঁচা, গডউইত ইত্যাদি।
তবে কিছু নিষ্ঠুর লোক এসব পাখি শিকার করছে কোনো কিছু না বুঝেশুনেই। এদের আবার ‘শৌখিন শিকারি’ গালভরা নামে ডাকা হয়। তবে শুধুু শৌখিন শিকারিরাই নয়, অনেক পেশাদার শিকারি অতিথি পাখিদের যত্রতত্র শিকার করে টাকার লোভে। অতিথিদের সঙ্গে কি কেউ এ রকম অমানবিক আচরণ করে?
অতিথি পাখি ছাড়াও আরও কিছু প্রাণী ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পাড়ি দেয় হাজার হাজার মাইল পথ। তার মধ্যে তিমি, ব্লু ফিশ, লেমিংস, লবস্টার, কচ্ছপ, ইল, মোনার্ক প্রজাপতি, প্লোভারসহ আরও অনেকেই আছে।
লুকিয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকার নাম শীতনিদ্রা
শীত থেকে বাঁচতে পাখিরা হাজার হাজার মাইল পথ পাড়ি দেয়। কিন্তু যারা উড়তে পারে না, অথবা যারা শীত একদমই সহ্য করতে পারে না, তাদের কী উপায়? ভয় নেই, ওদের জন্যও রয়েছে শীতকালীন এক সুরক্ষাব্যবস্থা, যার নাম হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রা। অনেক প্রাণীই শীত থেকে বাঁচতে হাইবারনেশন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। হাইবারনেশন হচ্ছে শীতকালে প্রাণীদের লম্বা, গভীর এক ঘুমের নাম। প্রাণীরা সুবিধামতো কোনো গর্তে, পাহাড়ের গুহায়, গাছের গুঁড়িতে বা খড়ের গাদায় একটানা অনেক দিন মরার মতো ঘুমিয়ে থাকে। এদের কাছে কুম্ভকর্ণও ফেল বলতে পারো। অবশ্য তার আগে, মানে গ্রীষ্মকালে তারা বেশি বেশি খেয়ে শরীরে বেশ করে চর্বি জমিয়ে নেয়। এ চর্বিই শীতনিদ্রার সময় তার শরীরের খাবারের অভাব পূরণ করে। আবার অনেকে হাইবারনেশনে যাওয়ার আগে কিছু খাবার নিজের কাছে জমিয়ে রাখে। ঘুমের মাঝখানে খুবই অল্প সময়ের জন্য জেগে উঠে কোনোমতে খাবারটা খেয়েই আবার ঘুমিয়ে পড়ে তারা।
শীতনিদ্রার সময় এসব প্রাণীর দেহের তাপমাত্রা কমে যায়। তা ছাড়া শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ও রক্ত চলাচল এতই কমে যায় যে দেখে মনে হয়, প্রাণীটি বোধ হয় মারা গেছে। যেমন আমেরিকার মারমট নামের একধরনের কাঠবিড়ালির কথা বলা যাক। স্বাভাবিক অবস্থায় এদের দেহের তাপমাত্রা থাকে ৯৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস) এবং হার্টবিট থাকে প্রতি মিনিটে ৮০ বার। কিন্তু অবাক ব্যাপার হচ্ছে, শীতনিদ্রার সময় এদের দেহের তাপমাত্রা ৩৮ ডিগ্রি ফারেনহাইটে (৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস) নেমে আসে। এ ছাড়া হার্টবিট নেমে আসে প্রতি মিনিটে মাত্র চারবার। আবার গ্রিজলি ভালুক বা কালো ভালুকের হার্টবিট বা হৃদকম্পন প্রতি মিনিটে ৪০-৫০ বার থেকে নেমে ৪-১২ বারে নেমে আসে। সাধারণত শীতল রক্তের প্রাণীরা (যেমন ব্যাঙ, সাপ) শীতকালে এ পদ্ধতির আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাই এ সময় ব্যাঙ বা সাপ তেমন একটা দেখা যায় না। তাদের শরীরের জমানো চর্বি পুড়িয়ে তারা কোনোরকমে বেঁচে থাকে। এ দলে সরীসৃপ প্রাণী যেমন: গিরগিটি, কচ্ছপ এবং বেশ কিছু পোকামাকড় আছে। তবে উষ্ণ রক্তের প্রাণীদের অনেকেই শীতকালে হাইবারনেশনের আশ্রয় নেয়। শীত থেকে বাঁচতে ভালুক, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, ধেড়ে ইঁদুর, চিপমুঙ্ক ও মারমট, ছোট ইঁদুর, সাদা গলার পোরউইল পাখি হাইবারনেশন বা শীতনিদ্রার আশ্রয় নেয়।
যুদ্ধ করে বাঁচার নাম অভিযোজন
গরম পোশাক কেনার পয়সা না থাকলেও অনেক প্রাণী শীতের সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকে। প্রাকৃতিকভাবেই যুদ্ধ করার মতো দৈহিক কিছু বৈশিষ্ট্য এদের আছে। এদের দেহে চামড়ার নিচে চর্বির অনেক মোটা স্তর থাকায় এরা শীতে কাবু হয় না। চর্বির এই স্তরকে বলে ব্লাবার। এই ব্লাবার তাদের দেহকে শীতেও গরম রাখে। এসব প্রাণীর মধ্যে আছে মেরু ভালুক, সিল ও তিমি। তা ছাড়া দেহে অনেক ঘন লোমও এদের শীতের হাত থেকে বাঁচায়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এসব প্রাণীর কারও কারও দেহের এক ইঞ্চি জায়গায় গড়ে এক মিলিয়ন লোম থাকে। ভালো কথা, তোমার মাথায় গড়ে এক মিলিয়ন করে চুল বা লোম থাকে। এবার তুলনা করে তুমিও বলো, ওদের কি আর সোয়েটার বা জ্যাকেট পরার দরকার আছে? যেমন মেরু ভালুক ও মেরু শিয়ালের দেহে এ রকম ঘন লোম দেখা যায়।
তা ছাড়া শীতপ্রধান অঞ্চলের প্রাণীদের অন্য এলাকার প্রাণীদের চেয়ে দেহের গঠনেও অনেক পার্থক্য আছে। যেমন, মেরু শিয়ালের দেহ অন্য এলাকার শিয়ালের চেয়ে একটু গোলগাল ও স্থূলাকার। এ ধরনের দেহ তাপমাত্রা সঞ্চয় করে রাখতে সাহায্য করে। তা ছাড়া এদের নাক-মুখ একটু ছোটখাটো এবং কোনোটা ছোট ও গোলাকৃতির। এসব বৈশিষ্ট্য দেহ থেকে তাপ বের হতে বাধা দেয়। আগেই জেনেছ, এদের সারা দেহ ঘন লোমে ঢাকা। একইভাবে এদের পায়ের পাতাও লোমে ঢাকা। এদিকে মেরু শিয়াল যখন ঘুমায়, তখন এদের লম্বা লোমশ লেজ দিয়ে দেহকে জড়িয়ে নেয়। অনেকটা মাফলারের মতো করে। তাই শূন্যের নিচের তীব্র শীতেও ওরা দিব্যি আরামেই থাকতে পারে।
যে কথা না বললেই নয়
প্রাণীরা শীতের হাত থেকে বাঁচার জন্য প্রকৃতিপ্রদত্ত কিছু বৈশিষ্ট্য পেলেও মানুষের কিন্তু এসব সুবিধা নেই। মানুষকে তাই শীতে গরম পোশাক পরতেই হয়। তোমার আশপাশে অনেকেই শীতে গরম পোশাক পরতে পারে না। কারণ কি জানো? ওদের আসলে শীতের পোশাক কেনার সামর্থ্য নেই। এ কারণে অনেকেই নিদারুণ কষ্ট ভোগ করে। আবার অনেকে শীত সহ্য করতে না পেরে মারাও যায়। তোমার কাছে হয়তো অনেকগুলো শীতের পোশাক। বাড়তি দু-একটা পোশাক ওদের বিলিয়ে দিলে তোমার কোনো ক্ষতি হবে না; অথচ ওদের বেশ উপকার হবে। একটু ভেবেই দেখো না, ওদের জন্য কিছু করা যায় কি না।