বালকের সাধ হাওয়ার মতো, কিন্তু ইচ্ছার তালিকা অনেক দীর্ঘ। ইংরেজ কবির কথাটা সত্যি করে দিল কিশোর বিজ্ঞানী নাজমুস সাকিব।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মিতুর দুঃখ, ‘কে আমার হয়ে দেখায়া দিবে? আমি স্বাভাবিক মানুষের মতো চলতে-ফিরতে চাই। কেন আমি চলাফেরার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করে থাকব?’ সাকিবের আশ্চর্য চশমাই এই হতাশার মধ্যে আশার বাতি জ্বালাল। ওর বানানো চশমা পরে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা চোখের দেখা দেখতে পাবে না বটে, কিন্তু একা একাই চলতে-ফিরতে পারবে। সাদাছড়ি লাগবে না, রাস্তা পার হতে গিয়ে, লাগবে না কারও সাহায্যের হাত। যখন কেউই নেই পাশে, তখন জরুরি চলাফেরার জন্য অসহায় হয়ে বসে থাকতে হবে না।
সাকিবের স্মার্ট কন্ট্রোলার গ্লাস দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের দেবে স্বাধীনতার কিছুটা স্বাদ। আর এর জন্যই ও জিতে নিয়েছে সৌদি আরব থেকে দেওয়া প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ। অর্থাত্ তরুণ উদ্যোক্তা হিসেবে সেরা পুরস্কার। মাত্র ১৪ বছর বয়সেই সাফল্যের এত বড় স্বীকৃতি আদায় করে নিয়েছে সে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তাসনিমা সুলতানা মিতু পড়েন ইনস্টিটিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চে (আইইআর)। সাকিবের বানানো চশমা পরে দিব্যি তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন কারওয়ান বাজারের ভিড়ের রাস্তায়। একা একা। মুখে হঠাত্ পাওয়া স্বাচ্ছন্দ্যের হাসি। সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মিতুর এই হাসিই যেন সাকিবের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী তুলতুল এখনই চাইছে সাকিবের চশমা পরার আনন্দ নিতে।
স্মার্ট কন্ট্রোলার গ্লাস নাম হলেও এই চশমায় কোনো কাচ নেই। তার বদলে আছে আল্ট্রাসনিক ও ইনফ্রারেড সেন্সর। এ দুটিকে অন্য ছোট ছোট ইলেকট্রনিক প্রযুক্তির সঙ্গে এমনভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে, যাতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা আশপাশের ১ থেকে ১০ মিটার এলাকার মধ্যে থাকা যেকোনো বাধা বুঝতে পারে। ঘরের মধ্যে ৩ মিটার আর রাস্তায় নামলে ১০ মিটারের মধ্যে বাধাহীন এলাকা দেখিয়ে দেবে এই চশমা। এর সঙ্গে থাকা সেন্সর ১৮০ ডিগ্রি, অর্থাত্ সামনের দিকের নাক বরাবর এবং ডানে ও বাঁয়ে থাকা যেকোনো বস্তু, গাড়ি বা কাঠামো সম্পর্কে চশমা ব্যবহারকারীকে সংকেত দেবে।
এই সংকেত মেনে চললে বাধা এড়িয়ে ধাক্কা না খেয়েই ঘরের ভেতর থেকে শুরু করে ভিড়ের রাস্তায়ও চলাচল করায় অসুবিধা হবে না।
সব অর্জনের পেছনেই গল্প থাকে। কখনো তা সুখের, কখনো তা দুঃখের। সাকিবের গল্পটা ছিল দুঃখের। সাকিবের ভাষায়, ‘আমার একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী প্রতিবেশী ছিলেন। তিনি বৃদ্ধ মানুষ। আমি স্কুলে যাওয়ার সময় তাঁকে একই লিফটে হাতড়ে হাতড়ে উঠতে ও নামতে দেখতাম। দেখে কষ্ট হতো। ভাবতাম, যদি ওনার জন্য কিছু করা যায়!’
বালকের মন হাওয়ার মতন, কিন্তু ইচ্ছা অনেক কঠিন। সেই কঠিন ইচ্ছা থেকেই কাজে নেমে পড়ল ও। দিন-রাত এক হয়ে গেল। দরকারি তথ্য পেতে ভরসা কেবল ইন্টারনেট। ছোট দুই বোনের সঙ্গে খেলা নেই, বন্ধুদের সঙ্গে বেড়ানো আর আড্ডা নেই। ওর বন্ধুরাও সবাই খুদে বিজ্ঞানী। এর আগে একক ও দলগতভাবে জাতীয় স্তরের বিভিন্ন বিজ্ঞান উদ্ভাবনা পুরস্কারও জুটেছিল তার ঝুলিতে। অবশেষে একদিন ওর স্বপ্ন সত্যি হয়। ছোটখাটো সরঞ্জাম দিয়ে তৈরি হয়ে যায় আলোহীনকে আলো দেওয়ার চশমা।
সাকিবের চশমার জাদু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীকে পথচলার সাহায্যেই শেষ হয় না। এর সঙ্গে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল জুড়ে দেওয়া যায় একটা অ্যাপস দিয়ে। আর যদি সেই মোবাইলে স্থান ও মানচিত্র চেনার জিপিএস ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কণ্ঠচালিত ভয়েস নেভিগেশন সিস্টেম দিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি যেকোনো জায়গায় একা একাই চলে যেতে পারবেন। জিপিএস সিস্টেমকে গন্তব্য বলে দিলে সেটাই তাকে সংকেত দিয়ে দিয়ে পথঘাটের হদিস বলে দেবে। বলে দেবে কোন দিকে কত দূর হাঁটতে হবে, কখন ঠিক কোন জায়গা দিয়ে ডানে বা বাঁয়ে যেতে হবে। এটা কাজ করবে তার মুখের কথার ‘হুকুম’ মেনে মেনে।
শুধু চশমাই নয়, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা যাতে একা একা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারেন, এর জন্য মোবাইল অ্যাপও বানিয়ে ফেলেছে সাকিব। আর এখন কাজ করছে বাসাবাড়ির নিরাপত্তার জন্য ‘স্মার্ট অল পারপাস সিকিউরিটি সিস্টেম’ নিয়ে। এটা দিয়ে চোর বা অচেনা কেউ বাড়িতে ঢুকলেই বাড়ির মানুষ কাছে বা দূরে যেখানেই থাকুন, সংকেত পেয়ে যাবেন। এমনকি, চোরকে আহত না করেও পাকড়াও করার খুদে রোবটও থাকছে এই পাহারার কাজে।
রাজধানীর বিসিএসআইয়ের (বাংলাদেশ কাউন্সিল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল) অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সাকিবের এখন একটাই দুশ্চিন্তা। গত নভেম্বরে পুরস্কার নিতে সৌদি আরবের রাজধানী রিয়াদে যেতে হয়েছিল তার। তাই জেএসসি পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শ্রেষ্ঠ শিশু উদ্যোক্তা পুরস্কার, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দের সঙ্গে মিশে আছে পরের ক্লাসে উঠতে না পারার আশঙ্কা।
সাকিবের এই আবিষ্কার সবার জন্য সহজলভ্য করতে চাই বাণিজ্যিক উত্পাদনের ব্যবস্থা। তবে তার জন্য এখনো কোনো প্রস্তাব আসেনি। এদিকে মিতুর অপেক্ষা, ‘এই চশমা কবে পাব? একদিন আমরাও স্বাধীনভাবে চলতে-ফিরতে পারব ভাবতেই কী যে খুশি লাগছে!’ আর সাকিবের অপেক্ষা নতুন ক্লাসে ওঠার সুযোগ। আর আরও আরও আবিষ্কারের জন্য বিশ্বমানের গবেষণাগারের বন্দোবস্ত।
মিতু এত দিন মেনে নিয়েছিলেন নিজের ‘অস্বাভাবিক’ অসুবিধার কথা। ছোটবেলায় বুঝতে পারতেন না যে চোখের দরকার আছে। কিন্তু এখন মনে হয় চলাফেরা করবেন, যে উপায়েই হোক। মিতু ও তুলতুলরা নতুন করে আশাবাদী। আর সাকিবের আশ্চর্য চশমাই দিচ্ছে সেই আশা পূরণের হাতছানি!
ছোট মনের প্রতিজ্ঞা থেকেও যে বড় কিছু হয়ে যেতে পারে, সাকিবই তা করে দেখাল! ছোটরা তাই ছোট নয়, তারা অনেক বড় সম্ভাবনার অঙ্কুর, যা থেকে একদিন গাছ হবে, ফুল ফুটবে আর সবাই ভাববে, বাহ্, এতটুকু ছেলের এত বড় কাজ!
ছবি: সাইফুল ইসলাম