দূর পাহাড়ের বুকে

অনেক দিন আগে থেকেই ঠিক করছিলাম খাগড়াছড়ি বেড়াতে যাব। কিন্তু আব্বু-আম্মুর সময়ই হচ্ছিল না। এবার গরমের ছুটির আগে বায়না ধরলাম, ‘আমাকে খাগড়াছড়ি নিয়ে যেতেই হবে।’ নানা ঝামেলার পর ঠিক হলো ১ মে খাগড়াছড়ি যাব আমরা। বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই ব্যাগ গোছানো শুরু করলাম। অবশেষে এল সেই দিন। ১ মে সকাল আটটায় গাড়ি এল। আমি, আম্মু, ছোট বোন রাতিয়া আর আম্মুর মামাতো বোন নাবিলা রওনা হলাম খাগড়াছড়ির পথে। কী মজা! সত্যিই আমরা খাগড়াছড়ি যাচ্ছি। তখনো বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার।

ফেনী থেকে খাগড়াছড়ি যেতে প্রায় তিন ঘণ্টা লাগে। রাস্তার দুই ধারে ছোট ছোট পাহাড় দেখেই আমরা মুগ্ধ! ধীরে ধীরে দেখা পেলাম ইয়া বড় বড় পাহাড়ের। একবার তাকালে আর চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না। রামগড় দিয়ে যাওয়ার সময় দেখলাম বিশাল চা-বাগান। গাড়ি থামিয়ে চা-বাগানে নামলাম আমরা। রাতিয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল সেখানেই বসে চা বানিয়ে খাবে, কিন্তু সে ইচ্ছা পূরণ হলো না।

আমরা যখন খাগড়াছড়ি পৌঁছাই, ঘড়িতে তখন বেলা ১১টা। এখান থেকে আম্মুর ছোট খালার বাসায় যেতে আরও আধা ঘণ্টা লাগবে। সেখানেই থাকব আমরা। আম্মুর ছোট খালাকে আমি ডাকি ছোট আপু। আমাদের গাড়ি যখন তার বাসার সামনে থামে, তখন মনে হলো আমরা বেশ ক্লান্ত।

ভেবেছিলাম প্রথম দিন কোথাও যাব না আমরা, কিন্তু দুপুরে খাওয়ার পর বসে থাকতে ইচ্ছা করছিল না কারও। তাই আমরা চললাম ঝুলন্ত সেতুতে। খুব বড় নয় ঝুলন্ত সেতুটা। আমি আর রাতিয়া আগে আগে চললাম। মাঝ বরাবর এসে যখন সেতুটা প্রচণ্ডভাবে দুলতে লাগল, তখন ভয়ে চিত্কার করতে লাগল রাতিয়া। আমরা সাবধানে দড়ি ধরে পার হলাম সেতুটা। সেখান থেকে আমরা গেলাম খাগড়াছড়ি পর্যটন মোটেলে। পর্যটন মোটেলের ঢালু রাস্তাটা বেয়ে উঠতে অনেক মজা লাগল। আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে চললাম খাওয়ার জন্য। আমরা যে রেস্তোরাঁয় গিয়েছিলাম, তার নাম ছিল ‘গিরি পিজর’। ওখান থেকে আপুর বাসায় ফিরে এলাম আমরা।

আলুটিলা গুহা
আলুটিলা গুহা

পরদিন সকালে খাগড়াছড়ি শহরটা ঘুরে দুপুরে গেলাম আলুটিলা সুড়ঙ্গে। অনেক সিঁড়ি পেরোতে হয় আলুটিলায় যাওয়ার আগে। আর প্রবেশমুখটা দেখলেই কেমন ভয় করে। আমরা জুতা খুলে মশাল হাতে ঢুকে পড়লাম সেখানে। পা শিরশির করে উঠল গোড়ালি সমান ঠান্ডা পানিতে। অন্ধকার গুহায় মশালের আলো যেন একটা ভৌতিক পরিবেশ তৈরি করে।

ভয়ই পেয়েছিলাম সবাই। ১৫-২০ মিনিট পর সুড়ঙ্গ পার হয়ে আলোতে আসার পর মনে হলো বিশ্ব জয় করে ফেলেছি।

এখান থেকেও অনেক সিঁড়ি পার হয়ে ওপরে উঠতে হলো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চললাম রিছাং ঝরনায়। গাড়ি করে পাহাড়ি ঢালু পথ বেয়ে নামলাম। বাকি পথটুকু হেঁটেই পার হতে হবে। প্রায় ২০ মিনিট হাঁটার পর দেখি সিঁড়ি! ছোট আপু জানাল, এখানে প্রায় ২৪০টা সিঁড়ি আছে। একে একে সব সিঁড়ি পার হলাম। হঠাত্ কানে এল ঝরনার শব্দ। শুনেই যেন ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। আমি আগে কখনো ঝরনা দেখিনি। পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসছে ঝরনাটা। কী সুন্দর! আমরা ওপরে উঠে একদম সামনে থেকে ঝরনাটা দেখলাম। ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। এত ক্লান্ত ছিলাম, খেয়েই চলে গেলাম ঘুমের দেশে।

বেশ তাড়াতাড়িই ঘুম ভাঙল। সকাল আটটায় এল জিপ। আজকে আমরা যাব সাজেকে। পথে গাড়ি থামল একটা জায়গায়। ড্রাইভার জানালেন, একটা সুন্দর ঝরনা আছে এখানে, হাজাছড়া ঝরনা। ওই ঝরনা দেখতে চললাম সবাই। জায়গাটা বেশ দুর্গম, নিজেদের অভিযাত্রী মনে হলো। ঝরনাটাও ছিল খুব সুন্দর। আবার যাত্রা শুরু হলো। সাজেকের রাস্তাগুলো অনেক উঁচু। চারদিকে পাহাড়ের সারি দেখে আনন্দে নেচে উঠল মন। কিন্তু আমরা যখন সাজেক পৌঁছালাম, তখন তীব্র রোদ। গাড়ি থেকে নেমে চারদিক ঘুরে দেখতে লাগলাম। হরাইজন গার্ডেনে সূর্যঘড়ি দেখলাম। তুললাম ছবি।

দুপুরের খাবারের পর ফেরার পালা। তার আগে সাজেক হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টার নামতে দেখলাম আমরা।

খাগড়াছড়ি ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। এরপর আমরা গেলাম নিউজিল্যান্ডপাড়ায়। এটা মূলত একটা খোলা জায়গা, সবুজ ধানখেত চারপাশে। সেখানেই দেখলাম সূর্যাস্ত।

পরদিন বিকেলে গেলাম পানছড়ির ‘শান্তিপুর অরণ্য কুটিরে’। অনেক বুদ্ধমূর্তি ছিল সেখানে। ফেরার পথে রাবার ড্যামটাও দেখা হলো। সন্ধ্যা হতেই আবার ফিরে এলাম আমরা।

পরদিন ছিল শুক্রবার। আমরা সবাই দল বেঁধে ঘুরতে বের হলাম। আশপাশের জায়গাগুলোতে গিয়েছিলাম। সেদিনের মজাটাই সবচেয়ে বেশি হয়েছিল। সেদিন বাসায় ফিরে সবার মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ, এবার ফিরে যাওয়ার পালা। পরদিন সকাল নয়টায় আমরা রওনা দিলাম। ফেনী ফিরে আসার সময় আমার চোখ বারবার চলে যাচ্ছিল ওই দূর পাহাড়ের বুকে।

লেখক : শিক্ষার্থী, নবম শ্রেণি, ফেনী সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ফেনী