বনবিড়ালটার অত্যাচারে গ্রামের দক্ষিণপাড়ার গেরস্তরা অতিষ্ঠ। হাঁস-মুরগির ছানা তুলে নিচ্ছে দিনদুপুরে। সন্ধ্যার আগের ক্ষণে প্রাণীটা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। গেরস্তবাড়ির কুকুরেরা ওটার কচুও করতে পারছে না। বক্স ফাঁদে ঢোকে না। ঘড়েল বনবিড়াল তো!
তো একদিন সকালে পাড়ার কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে কুকুর নিয়ে অভিযানে বেরোল। চার-পাঁচটি বাগান তল্লাশি করার পর একটি ঘন বুনটের বেতঝাড়ের তলায় ওটাকে দেখতে পেল কুকুর বাহিনী। দে ধাওয়া! প্রাণীটি লম্বা লম্বা লাফে অনেকটা দূর গিয়ে একটা মরা নারকেলগাছ বেয়ে চড়তে শুরু করল। কুকুরগুলো নারকেলগাছের গোড়ায় গিয়ে ওপরের দিকে তাকিয়ে প্রচণ্ড হাঁকডাক যখন করছে, তখনই ‘ট্যা ট্যা’ স্বরে ডাকতে ডাকতে এসে পড়ল একঝাঁক টিয়া পাখি। কুকুর ও বনবিড়ালটিকে দেখে ওদের মাথা যেন খারাপ হয়ে গেল! ৭–৮টি টিয়া প্রচণ্ড রেগে তিরের ফলার মতো আক্রমণ করল বনবিড়ালটিকে, বাকি ৯–১০টি টিয়া আক্রমণে গেল কুকুরগুলোর দিকে। কামড়ে-আঁচড়ে ও প্রচণ্ড সাহসে কুকুরগুলোকে দিল তাড়িয়ে, ভ্যাবাচেকা খেয়ে পর্যুদস্ত বনবিড়ালটি প্রায় ৩০ ফুট উঁচু থেকে লাফিয়ে পড়ল নিচে (বিড়ালদের শরীরের হাড়-মাংস ও কোমর ফ্লেক্সিবল, তাই উঁচু থেকে পড়লেও ওদের হয় না কিছু), তারপর দৌড়ে পগার পার। দু–তিনটি টিয়া ওটাকে বহুদূর পর্যন্ত তাড়িয়ে নিয়ে গেল। চমত্কার এই দৃশ্য দেখে ছেলেমেয়েরা আনন্দে উল্লাসধ্বনি দিল।
টিয়াগুলোর এই আক্রমণের কারণ—ওই গাছেরই সারি সারি (ওপর থেকে নিচে) ৯টি আলাদা কোটরে ওদের বাসা, সে বাসায় ডিম অথবা ছানা রয়েছে। ওপর থেকে নিচের দিকে পরপর সাজানো যেন ৯টি কুঠুরি, যেগুলো একদিন তৈরি করেছিল মিস্ত্রি পাখি কাঠঠোকরারা। টিয়ারা ঝাঁকে চলে, ঝাঁকে চরে। দুঃসাহসী টিয়ারা খেতের আগার পাকা গম ও ধানের শিষ ধারালো ঠোঁটে কেটে, পা ও ঠোঁটে শিষ ধরে উড়ে যেতে খুবই পারদর্শী। সুযোগ পেলে ওরা আধা বিঘা জমির পাকা গম ও ধানের শিষ সাত দিনের মধ্যে নেই করে দিতে পারে। খেত পাহারায় যদি থাকে কম বয়সী মানুষ, তাকে থোড়াই কেয়ার করে, প্রয়োজনে আক্রমণ করে, রক্তাক্ত জখমও করে। ছেলেপুলেরা যদি পোষার জন্য মরা তাল-নারকেল বা অন্য কোনো গাছে চড়ে টিয়ার ছানা পাড়তে যায়, তাহলে টিয়াদের সম্মিলিত আক্রমণে নিচে না পড়লেও (ওরা হয়তো দূরে গেছে ছানাদের জন্য খাবার আনতে) বাসার ভেতরে হাত ঢুকিয়েই পড়ে যায় ছানাদের শক্ত-বক্র ঠোঁটের কবলে, ওপরের বক্র ঠোঁটে ফুটো করে ফেলে হাতের আঙুল। তখন অবস্থা হয় ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’। হাত বের করে আনলেও ছানা কামড় ছাড়ে না, হাত কামড়ে ধরে ঝুলে থাকে। অনেকটাই কাঁকড়ার সাঁড়াশির মতো, মানুষ কাঁকড়াকে ধরলে কাঁকড়া পায়ের সাঁড়াশি দিয়ে চেপে ধরে প্রচণ্ডভাবে। কাঁকড়াকে ছেড়ে দিলেও কাঁকড়া তার সাঁড়াশি আলগা করে না। টিয়ার ছানারাও তা–ই করে। যাকে বলে মরণকামড়। এমন কামড় খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমার ভালোভাবেই আছে। টিয়া পোষার প্রবণতা মানুষের মধ্যে প্রবল এ জন্য যে ট্রেনিং দিলে এরা অনেকটাই মানুষের মতো কথা বলতে পারে (সীমিত কিছু কথা), এদিক দিয়ে বেশি ওস্তাদ ময়না পাখি। দেশি পাখির মধ্যে ময়নার পরই পোষা পাখি হিসেবে আমাদের দেশে টিয়ার স্থান।
আমাদের এই রাজধানী ঢাকা শহরে প্রচুর টিয়া আছে, মৌসুমে বাসাও করে। দরদালানের ফাঁকফোকরসহ বিভিন্ন বড় গাছের কোটরে। খাবারের সন্ধানে এরা রাজধানী ছেড়ে আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যায়, ফিরে আসে আবার সন্ধ্যার আগে। ওড়ার সময় এরা থেমে থেমে ডাকবেই। দ্রুতবেগে ওড়ে। ঝাঁকে এরা পাঁচ–ছয়টি থেকে কয়েক শ পর্যন্ত থাকতে পারে। ফসলের খেতে আক্রমণ চালাতে এরা খুবই পারদর্শী। গাছের ডালে ঝুলতে-দুলতে এরা অ্যাক্রোব্যাটদের মতো পারদর্শী।
বাংলাদেশের সর্বত্র দেখতে পাওয়া এই টিয়াদের ইংরেজি নাম Rose-Ringed parakeet. বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula krameri. তোতা টিয়া, সবুজ টিয়া ও কণ্ঠি টিয়া নামেও পরিচিত এরা। দৈর্ঘ্য ৪২ সেন্টিমিটার। ওজন ১৩০ গ্রাম। এরা যখন গাছের ডালে বসবে—বসবে সূর্যমুখী ফুলের ওপর, তখন বসার ঠিক আগমুহূর্তে এদের লম্বা খাঁজকাটা লেজটি সুদৃশ্য ফুলের মতো মেলে যায়। দুই ডানার ভঙ্গি হয় নান্দনিক সৌন্দর্যে ভরপুর।
একনজরে নীল-সবুজ পাখি। বডির দৈর্ঘ্যের চেয়ে লেজটি বেশি লম্বা, লেজ নীলচে সবুজ। পুরুষের গলা-ঘাড়জুড়ে চমত্কার গোলাপি-নীল সরু মালা পরানো। মেয়েটির গলায় মালা নেই। দুটিরই চেখের বৃত্ত সাদা। পুরুষের থুতনিতে কালো ডোরা আঁকা। পান খাওয়া টকটকে লাল ঠোঁট। পা দুখানা ধূসর।
মূল খাদ্য নানা রকম ফল, ফুলের মধুরেণু, নানা রকম বীজ ও শস্যদানা। আমি যে বাসায় থাকি, সে বাড়ির একটা বাড়ি পর আছে একটি বারোমাসি মিষ্টি কামরাঙাগাছ। ব্যস্ত রাজপথের পাশে না হলে হয়তো সব সময় টিয়ার যাতায়াত থাকত। টকটকে লাল পাকা মরিচ এরা টুপুস করে গিলে ফেলে। টিয়া পা-কে ঠিক হাতের মতো ব্যবহার করতে পারে। এদের বাসা করার ভরা মৌসুম নভেম্বর-জানুয়ারি মাস। গাছের কোটরে ও দালানের ফাঁকফোকরে বাসা করে তাতে ডিম পাড়ে চার-ছয়টি। ডিম ফুটে ছানা হয় ২০-২৭ দিনে।