দুঃসাহসী কয়েক অভিযাত্রী

অ্যাডভেঞ্চার করতে গিয়ে অনেকের রোমাঞ্চকর আর মজার মজার সব অভিজ্ঞতা হয়। সেগুলোই নাকি বাকি জীবন তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন অনেকে। তবে সবার ভাগ্যই তো আর একরকম নয়। কেউ কেউ অভিযানে গিয়ে হারিয়ে যান চিরতরে। অনেক বছর পর হয়তো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় কারও কারও। আবার অনেক অভিযাত্রী ফিরে আসেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে। কল্পকাহিনিকেও ছাড়িয়ে যায় বাস্তবের দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের গল্প। ইতিহাসে ঠাঁই পাওয়া এমন কিছু অভিযাত্রীর খবর জেনে নাও তাহলে।

এরিক দ্য রেড

৯৫০ সালের দিকে নরওয়েতে জন্ম নেওয়া এরিক থরভ্যালডসন কিংবা এরিক রাউডে যা-ই বলো না কেন, থাকতেন পশ্চিম আইল্যান্ডে। তাঁর বাবাকে খুনের দায়ে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেন শাসকেরা। বাবা যখন ছিলেন না, এরিক তখন দুজন মানুষকে খুন করে বসেন। তাঁকেও নির্বাসন দেওয়া হয়। এই সময় কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ‘স্নেফেলেসনেস পেনিনসুলা’ আইল্যান্ডের দিকে যাত্রা করেন এরিক। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেন ‘গ্রিনল্যান্ড’। সম্পূর্ণ বরফঘেরা জায়গাটিকে তিনি কেন ‘গ্রিনল্যান্ড’ নামকরণ করেছিলেন, তা অবশ্য আজও রহস্য। এ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বে বেশ কিছু দ্বীপ আবিষ্কার করে নামকরণ করেন তিনি। খুনি থেকে অ্যাডভেঞ্চারার বনে যাওয়া নিয়ে অনেক ইতিহাসবেত্তাই সমালোচনা করেছেন। তবে যা-ই হোক, অচেনা-অজানা বরফের রাজ্যে প্রবেশের জন্য অনেক সাহসের প্রয়োজন। তাই তিনি বিশ্বের সেরা দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের তালিকায় একদম ওপরের দিকে জায়গা করে নিয়েছেন।

রোয়াল্ড আমুনসান

দক্ষিণ মেরুতে পা রাখা প্রথম মানুষ রোয়াল্ড আমুনসান। ছোটবেলা থেকে এই নরওয়েজিয়ানের আগ্রহ ছিল সমুদ্রে ঘুরে বেড়ানো। ১৮৯৭ সালে বেলজিয়ান অ্যান্টার্কটিক অভিযানে তিনি সঙ্গী হয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, তাঁর অন্যান্য অভিযানের প্রেরণা নাকি এখান থেকেই পেয়েছিলেন। এ অভিযানে তাঁদের জাহাজটি মাঝসমুদ্রে আটকে যায় বরফঝড়ে। সে যাত্রায় অতি কষ্টে বেঁচে ছিলেন। এরপর অভিযানের নেশা পেয়ে বসে তাঁকে। ১৯১০ সালে তিনি ‘ফ্যার্ম’ নামে এক জাহাজে রওনা হন দক্ষিণ মেরুর দিকে। যাত্রার কয়েক দিনের মধ্যেই খাবার আর তাপমাত্রার সমস্যা দেখা দেয়। একসময় স্লেজ গাড়ির কুকুরকেই খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। তাপমাত্রা অস্বাভাবিক কমতে থাকলে তাঁর দলের সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। একপর্যায়ে অল্প কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে এগিয়ে যান তিনি। ১৯১১ সালের ১৪ ডিসেম্বর পৌঁছান দক্ষিণ মেরুতে।

হাইরাম বিংহ্যাম থ্রি

ইতিহাস বইয়ের পাতা ওল্টাতে গিয়ে পেরুর মাচুপিচু শহরের নামটি চোখে পড়ে হাইরাম বিংহ্যামের। তখনই তাঁর মাথায় গেঁথে যায় শহরটির নাম। এর অনেক বছর পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চিলিতে এক সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সৌভাগ্য হয় তাঁর। ফেরার পথে খেয়াল চাপে পেরু দেশটি ঘুরে যাবেন। শুধু তা-ই নয়, ইনকাদের শহর মাচুপিচুতেই যাবেন। কিন্তু হাজার বছরের পুরোনো ওই জায়গায় কেউ যেতে চায় না। স্থানীয় এক লোক রাজি হলেন সঙ্গে যেতে। তাঁকে নিয়ে চললেন মাচুপিচুর পথে। দুই হাজার ফুটের পাহাড় বাইতে গিয়ে কয়েকবার পা-ও ফসকে যায় তাঁর। তিনি তো আর অভিজ্ঞ নৃবিজ্ঞানী নন। ঠিক করেছিলেন, ইনকাদের সর্বশেষ রাজধানী ভিটকসে যাবেন। ১৯১১ সালে তিনি যখন উরুবাম্বা দিয়ে ভেতরে পৌঁছান, তখনো জানতেন না কী অপেক্ষা করছিল তার জন্য। পাহাড়ের ওপর থেকে অবাক বিস্ময়ে নতুনভাবে আবিষ্কার করেন ইনকাদের শহর মাচুপিচুকে।

ডেভিড লিভিংস্টোন

আফ্রিকায় পা রাখা প্রথম মানুষ হলেন ডেভিড লিভিংস্টোন। তিনিই প্রথম ইউরোপিয়ান, যিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহত্ জলপ্রপাত ‘ভিক্টোরিয়া ফলস’ দেখেছিলেন। তিনি ধর্মপ্রচারক, বিজ্ঞানী হিসেবেও পরিচিত। তাঁর মধ্যে একটা স্বভাব ছিল, কথা নেই, বার্তা নেই, হুট করে লাপাত্তা হয়ে যাওয়া। একবার তো ছয় বছর কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। কোথায় ছিলেন কেউ বলতে পারছিল না। ছয় বছর পর তাঁকে খুঁজে পান আরেক অভিযাত্রী হেনরি মরটন স্ট্যানলি। তাঁকে দেখে সবাই প্রথম যে কথাটি বলেন হেনরি, ‘ডক্টর লিভিংস্টোন, আই প্রিজিউম?’ যা পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত হয়ে যায়, এ নিয়ে একটি গানও আছে। তাঁকে নিয়ে হাউ আই ফাউন্ড লিভিংস্টোন নামের একটি বই লেখেন হেনরি।

ইবনে বতুতা

ইবনে বতুতাকে নতুন করে পরিচয় করে দেওয়ার কিছু নেই। তাঁকে বলা হয় মুসলিম মার্কো পোলো। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ২০ বছর বয়স থেকে তাঁর ভ্রমণ শুরু হয় মক্কায় হজ করা দিয়ে। উত্তর ও পশ্চিম আফ্রিকা, চীন, পূর্ব ইউরোপ, দক্ষিণ, মধ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর নানা দেশে ভ্রমণ করেছেন তিনি। হিসাবে দেখা গেছে, ৩০ বছর ধরে তিনি ৭৫ হাজার মাইলের বেশি পথ ভ্রমণ করেছেন।

শেষ কথা

দুঃসাহসী অভিযাত্রীদের কাহিনি পড়তে পড়তে তোমার হয়তো এখনই ব্যাগ কাঁধে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সে চিন্তা মাথায় থাকলে একটু বুঝেশুনে কাজ করো। পড়ালেখায় ফাঁকি দেওয়ার জন্য যদি তুমি দুঃসাহসী অভিযাত্রী হতে চাও, তাতেও উপায় নেই। সব অভিযাত্রীই অভিযানে যাওয়ার আগে সে সম্পর্কে ভালোমতো পড়াশোনা করেন। তবে হ্যাঁ, ওই গানটা জানো তো, ‘কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা, মনে মনে।’ কী আর করা, এখনই কোনো অভিযানে যেতে না পারলে কল্পনাতেই হারিয়ে যাও!

তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া, ডিসকভারি, টাইম ম্যাগাজিন ও ন্যাশনাল জিওগ্রাফি।