দিনদুপুরে ঝিঁঝি পোকা ও বোতলবন্দী ভূত

দোকানটায় ঢোকার মুখেই থমকে দাঁড়ালাম। শব্দটা খুব চেনা চেনা লাগছে। একসঙ্গে হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকা ডাকলে যেমন আওয়াজ হওয়ার কথা, তেমন হাই ফ্রিকোয়েন্সির আওয়াজ। কিন্তু বাইরের আকাশে ঝকঝকে রোদ। ভেতরটাও আলো-ঝলমলে। ভাবছি, এই দিনদুপুরে এখানে এত ঝিঁঝি পোকার ডাক আসবে কোথা থেকে! নাকি বিদেশি ঝিঁঝি পোকারা দিনের বেলাতেই ডাকে! আমাদেরগুলো একটু লাজুক বলে রাত ছাড়া মুখ খোলে না। ব্যাপারটা নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবতে পারলাম না। কখন জানি ছায়ার মতো দুটো বিশাল আকারের কুকুর সামনে উদয় হলো। লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। ভেতর থেকে কেউ একজন পিটার-জ্যাক বলে ডাকতেই কুকুর দুটো সরে গিয়ে আমাকে দোকানের মধ্যে ঢোকার জায়গা করে দিল। আমার আত্মায় একটু পানি এল।

দোকানের মধ্যে পা রাখলাম। আর রেখেই আমি হতভম্ব। একি কাণ্ড! বিশাল বড় একটা গুদামের মতো দোকান। চারদিকে সারি সারি নানা আকারের কাচের বাক্স। সেসব বাক্সে কী নেই—একদিকে বিশাল বড় অজগরসহ হলুদ-সবুজ নানা রঙের সাপ। আর অন্যদিকে ব্যাঙ, গিরগিটি, কচ্ছপ, মাকড়সা, গুইসাপ, গুবরে পোকাসহ নানা ধরনের উভচর আর সরীসৃপ-জাতীয় প্রাণী। কোনোটায় সাপগুলো কিলবিল করছে, কোনোটায় গিরগিটিগুলো ঘাড়ের পেশিগুলো ছোট-বড় করছে।

ঢোকার মুখে হাতের বাঁয়ে বিক্রয়কেন্দ্র। সেখানে বেজায় ভিড়। কেউবা মাত্রই বাসায় পালার জন্য কাচের বাক্সসহ একটা সাপ কিনে টাকা বুঝিয়ে দিচ্ছে। কেউবা নিজের  পোষা সাপ, ব্যাঙের জন্য ইঁদুর, মুরগির বাচ্চা, ছোট খরগোশ, ঝিঁঝি পোকা ইত্যাদি কিনছে। ইঁদুর পাওয়া যাচ্ছে সেখানে নানা রকমের। বড়, ছোট, জ্যান্ত আর ফ্রোজেন। মানুষ সেসব প্যাকেটে করে কিনে বাড়ি যাচ্ছে। সাপের ক্রেতা সবাই দেখলাম মধ্যবয়স্ক বা তরুণ। আর মাকড়সা ও ব্যাঙের ক্রেতা সবাই সাত-আট বছরের শিশু। দোকানের নাম ইস্ট বে ভিভারিয়াম। এটি  নাকি ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলি শহরের সবচেয়ে বড় দোকান, যারা উভচর, সরীসৃপ ও অন্যান্য প্রাণী বিক্রি করে।

মিথ্যা না। সত্যিই দোকানটা অনেক বড়। আমি ঘুরে দেখতে বের হলাম একধার থেকে। বাক্সের ভেতর প্রতিটা প্রাণীর বসবাস উপযোগী প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে। মাকড়সাগুলো নট নড়নচড়ন হয়ে বাক্সের মধ্যে রাখা শুকনো ডালে ঝুলছে। সাপগুলো কিলবিল করছে, নয়তো মড়ার মতো পড়ে আছে। ব্যাঙের জন্য গাছপালা দিয়ে ঝোপঝাড় আর একটু কাদা কাদা করে রাখা। সেখানে মাথা বের করে তাকিয়ে আছে ক্রেতাদের দিকে। আর সেখানেই উন্মোচিত হলো আমার ঝিঁঝি পোকার রহস্য। খাদ্য হিসেবে শত শত ব্যাঙের বাক্সে ছেড়ে রাখা হয়েছে হাজার হাজার ঝিঁঝি পোকা। সেসব ঝিঁঝি পোকা ব্যাঙের ভয়ে জীবন দিয়ে এই দিনদুপুরে ডেকে যাচ্ছে। আহারে! ঝিঁঝি পোকাগুলোর জন্য খুব মায়া হলো। কিন্তু খাদ্যশৃঙ্খল বলে একটা কথা আছে। একজনকে খেয়েই আরেকজন বেঁচে থাকে। না হয় পৃথিবীই টিকবে না।

হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম নানা রঙের গিরগিটির বাক্সগুলোর কাছে। সেখানে দেখি সাত-আট বছরের বাচ্চা একটা ছেলে একটা বয়াম বুকে চেপে ধরে গিরিগিটির দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। আমিও অপূর্ব রঙিন সেই গিরগিটিকেই দেখছিলাম। হঠাত্ নজর পড়ল ছেলেটার বয়ামের ওপর। সেখানে  লেখা—আমার পোষা ভূত। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসতে থাকলাম। সে আমাকে দেখে বলল, হাসছ কেন? আমি দাঁত কেলিয়ে বললাম, তোমার ভূতের বয়াম দেখে। এটার ভেতর কি সত্যি ভূত আছে?

পিটারের পোষা ভূতের বোতল
পিটারের পোষা ভূতের বোতল

ছেলেটা বলল, হ্যাঁ, অবশ্যই আছে। আমি অক্টোবরের হ্যালোইন উপলক্ষে এটা কিনেছি দুই দিন আগে। ৫০ ডলার নিয়েছে। সারা দিন আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। রোমানিয়ান ভূত। নাম মোরোই। আমি বললাম, বাহ্, খুব সুন্দর নাম তো! ছেলেটা বলল, মোরোই হলো রোমানিয়ার খুবই প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ভূত। আমি বললাম, ভালো জিনিসই কিনেছ তাহলে। ভূত যত পুরোনো হয়, ততই ভালো। পুরোনো ভূত ভাতে বাড়ে। মনে মনে ভাবলাম, আহা, কী চমত্কার শৈশব এই ছেলেটার। সুন্দর একটা ভূতের বাচ্চা কিনেছে দোকান থেকে। আবার বিশ্বাসও করে যে এর মধ্যে ভূতের বাচ্চা আছে।  জীবনের এই সময়টুকু কতই না সরল।

আমি আরেকটু কাছে এসে ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করলাম, কী নাম তোমার? সে বলল, পিটার। বলেই সে আবার বোতলটা বুকের কাছে আকড়ে ধরে গভীর মনোযোগে গিরগিটির শরীরের রং বদলায় কি না, দেখা শুরু করল। মনে মনে ভাবলাম, এই যুগের একটা ছেলের নাম কেন পিটার হবে। এটা তো বেশ প্রাচীন আমলের একটা নাম। পিটার গিরগিটির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল, তুমি আসলে বিশ্বাস করোনি যে এই বয়ামের মধ্যে সত্যি সত্যি একটা ভূতের বাচ্চা আছে। আমি বললাম, সত্যি কথা যদি বলতে বলো তাহলে বলি, আমি আসলেই বিশ্বাস করিনি। তবে ভূতের গল্প বিশ্বাস করি আমি। তুমি চাইলে তোমার ভূতের বাচ্চা মোরোইয়ের গল্প বলতে পারো।

এই গিরগিটিরই সামনে ছিল পিটার
এই গিরগিটিরই সামনে ছিল পিটার

আচ্ছা ঠিক আছে বলে পিটার বলল, এইমাত্র মোরোই আমাকে জানাল তুমি কী ভাবছ। তুমি ভাবছ, পিটার এটা আবার কেমন নাম? কী, ঠিক বলেছি না? আমি একটু চমকালাম। তবে কিছু বললাম না। এমন কাকতালীয় ব্যাপার হতেই পারে। ছেলেটি আবার বলল, আর আমরা দুজনে কেন গিরগিটির সামনে সকাল থেকে বসে আছি জানো?

কেন?

গিরগিটি কীভাবে রং বদলায়, এটা দেখে মোরোই শিখছে। পুরোপুরি শিখে উঠতে পারলেই আমাকেও সে নানা প্রাণীতে পরিবর্তন করতে পারবে। মোরোই খুবই শক্তিশালী ভূতের বাচ্চা। দ্রুতই সব শিখে ফেলে। সে এরই মধ্যে একটু একটু পারছে। এই আধা ঘন্টা আগে আমাকে একবার দুই মিনিটের জন্য একটা কুকুর বানিয়ে দিয়েছিল। তুমি যখন দরজা দিয়ে ঢুকছিলে, তখন দুইটা কুকুরের একটা ছিলাম আমি। আমার নাম পিটার ছিল তখনো। খেয়াল আছে?

গভীর মনোযোগে গিরগিটির রঙ বদলানো দেখছে পিটার ও মোরোই
গভীর মনোযোগে গিরগিটির রঙ বদলানো দেখছে পিটার ও মোরোই

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পিটার উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে দেখো আমার আর মোরোইয়ের বোতলের কোনো ছায়াও পড়ছে না। সত্যিই দেখলাম তাদের কোনো ছায়া পড়ছে না। তবে আমি ওপরে তাকিয়ে দেখলাম, মাথার ওপর একটা বাল্ব। তাই ওপর থেকে আলো পড়ায় হয়তো ছায়া দেখা যাচ্ছে না। পিটার আমার মনের কথাটা ধরে ফেলে বলল, মাথার ওপরের বাল্বের জন্য না, বাইরে গেলেও সূর্যের আলোয় ছায়া পড়বে না। বলেই সে বোতলটা বুকে চেপে ধরে দোকান থেকে বাইরে বেরিয়ে গেল। এমন আজগুবি কথা প্রমাণের জন্য আমি আর বের হলাম না। আবার গিরগিটি দেখায় মনোযোগ দিলাম।

দোকানের একমাত্র কুকুর জ্যাক
দোকানের একমাত্র কুকুর জ্যাক

একটু পরেই মনটা কেমন জানি খুঁতখুঁত করতে লাগল। খুঁজতে থাকলাম কুকুর দুটোকে। কাউন্টারের পাশেই চোখে পড়ল একটাকে। কিন্তু আরেকটা কই। আধা ঘণ্টা ধরে খুঁজলাম ভেতরে। নেই। কাউন্টারের মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা তোমাদের পিটার নামের কুকুরটা কোথায়, অনেকক্ষণ হয় দেখছি না যে? মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলল, পিটার? আমাদের কুকুর?  এই নামে তো কোনো কুকুর নেই আমাদের।