আমাদের বাংলা পঞ্জিকার প্রথম মাসের নাম বৈশাখ। বিশাখা নক্ষত্রের নাম থেকে বৈশাখ কথাটি এসেছে। বৈশাখ মাসের প্রথম দিনটিই আমাদের নববর্ষ। এ দিনটি আমরা এখন খুব ধুমধামের সঙ্গে উদ্যাপন করি। আমরা নানা রঙের পাঞ্জাবি পরি। আর পরি সাদা পাজামা। মায়েরা পরেন নানা রঙের চমত্কার সব শাড়ি। বাবা-চাচারা পরেন আমাদের মতোই পাজামা-পাঞ্জাবি। আমরা দল বেঁধে নববর্ষ উদ্যাপনের অনুষ্ঠানে যাই। কেউ গান করে, কেউ নাচ করে, কেউ করে আবৃত্তি। আমরা আনন্দ মিছিল করি। হাস্য-কৌতুকে মেতে উঠি। ঢাকা শহরে রমনার বটমূলে লাখ লাখ মানুষ আসে ছায়ানটের নববর্ষের অনুষ্ঠানে খুব সকালবেলায়। সে অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রনাথের গান হয়, নজরুলের গান আর লোকগানও হয়। সে অনুষ্ঠানটি বড়রা খুব পছন্দ করেন। কোনো কোনো বছরে না আসতে পারলে তাঁদের মন খারাপ হয়ে যায়। ছোটরাও আসে এ অনুষ্ঠানে মা-বাবার সঙ্গে। কত মানুষ। সবার মুখেই আনন্দের ছোঁয়া। ভালো লাগার পরশ।
সকাল নয়টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে বের হয় আনন্দ শোভাযাত্রা। নেচে-গেয়ে আনন্দে মেতে ওঠে সবাই। এই শোভাযাত্রায় হাতি, ঘোড়া, বাঘ, ভালুক আরও কত মজার সব প্রতিকৃতি বানিয়ে মিছিলকে আরও জমজমাট করা হয়। এগুলো দেখতে আমাদের খুব ভালো লাগে। চারুকলা ইনস্টিটিউটের দেয়ালে ওখানকার ছাত্রছাত্রীরা কী সুন্দর সব ছবি যে এঁকে রাখে, দেখলেই মনটা ভরে যায়। সারা বছর এ নববর্ষের উৎসবই আমাদের সবচেয়ে বড় আনন্দ উৎসব। এ উৎসবে বাংলাদেশের সব সম্প্রদায়ের মানুষই অংশগ্রহণ করে। সে জন্য একে বলা হয় বাঙালির সর্বজনীন উৎসব। জাতীয় উৎসব। এখন শহর-বন্দর, নগর-প্রান্তর ও গ্রামগঞ্জেও এই উৎসব জমে উঠেছে। আগে নববর্ষ উপলক্ষে গ্রামে হতো হা-ডু-ডু খেলা, গরুদৌড়, মোরগের লড়াই আরও নানা গ্রামীণ খেলা। অবশ্য এখন তা বদলে গেছে। কিছু গ্রামীণ খেলাধুলার পাশাপাশি শহরের মতোই হয় বিচিত্রা অনুষ্ঠান, রবীন্দ্র ও নজরুল সংগীত আর লোকগানের আসর।
নববর্ষের দিনে শহরে-বন্দরে প্রতি বাড়িতেই ভালো খাবারদাবারের ব্যবস্থা করা হয়। টেলিভিশনে দেখানো হয় বিশেষ কিছু অনুষ্ঠান। গ্রামগঞ্জেও এখন এর ছোঁয়া লেগেছে। ভারি আনন্দের দিন এই নববর্ষ। তবে এই উৎসব উদ্যাপন নিয়ে এখন একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশে এই উৎসব আমরা সরকারিভাবে উদ্যাপন করি রোমান পঞ্জিকার ১৪ এপ্রিলে। কিন্তু ভারতের পশ্চিম বাংলায় অধিকাংশ সময় উদ্যাপন করা হয় ১৫ এপ্রিলে। বাঙালিদের এই নববর্ষের দিনটি পশ্চিম বাংলা ও বাংলাদেশে দুই দিনে উদ্যাপন করায় একটা বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। এই সমস্যার তো একটা বৈজ্ঞানিক সমাধানই হওয়া দরকার। কারণ, বিষয়টি বিজ্ঞানের। বিশেষ করে জ্যোতির্বিজ্ঞানের। তাই এর সমাধান শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও পদার্থবিজ্ঞানীরাই করতে পারেন। জ্যোতিষীরা যেভাবে পঞ্জিকা তৈরি করতেন, তার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। বর্ষের দিনক্ষণ নির্ভর করে গ্রহ-নক্ষত্রের যাত্রপথের ওপর। সে জন্যই জ্যোতিষীদের অবৈজ্ঞানিক সংস্কার দিয়ে বাংলা সন-তারিখের দিনক্ষণ নির্ধারণ করা যায় না। বহু দিন সেভাবেই চলেছে। পরে ভারত সরকার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ড. মেঘনাথ সাহাকে ভারতীয় পঞ্জিকার সংস্কারের দায়িত্ব প্রদান করে। তিনি অনেক গবেষণা করে ভারতীয় মূল পঞ্জিকাসহ বাংলা পঞ্জিকারও সংস্কার করেন। তাতে ১৪ এপ্রিলেই পয়লা বৈশাখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। পরে আরও সংস্কারের জন্য ভারত সরকার পাণ্ডে কমিটি নিয়োগ করে। সে কমিটিও ১৪ই এপ্রিলেই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন নির্ধারণ করে। ভারতীয় বিজ্ঞান পত্রিকায় এ বিষয়টি বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে ব্যাখা-বিশ্লেষণ করে প্রকাশ করা হয়। মেঘনাথ সাহার সংস্কারকে গ্রহণ করেই ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ১৪ এপ্রিলকেই বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন হিসেবে ঠিক করে দিয়েছেন। অতএব আমরা মেঘনাথ সাহা ও মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নির্ধারণ করা ১৪ এপ্রিলকেই বাংলা নববর্ষ হিসেবে মেনে নিয়ে নব আনন্দে নববর্ষ উদ্যাপন করছি। পশ্চিম বাংলা এ বৈজ্ঞানিক তারিখ না মেনে ১৫ এপ্রিল নববর্ষ উদ্যাপন করছে জ্যোতিষীদের দিনগণনা অনুযায়ী। এর ফলে পশ্চিম বাংলায় আড়াই-তিন হাজার বছর পরে নববর্ষ উদ্যাপন করতে হবে জ্যৈষ্ঠ মাসে। আমরা তাই জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পদার্থবিজ্ঞানের সিদ্ধান্তকে মেনে নিয়েছি। লোকসংস্কারের ভ্রান্ত জ্যোতিষবিদ্যাকে আমরা মেনে নিইনি।