ফিলিয়াস ফগকে মনে আছে? সেই যে রিফর্ম ক্লাবের আন্দ্রে স্টুয়ার্টের সঙ্গে বাজি ধরে বসলেন, ৮০ দিনে পুরো পৃথিবীটা এক পাক ঘুরে ফেলবেন? সবাই তো ধরেই নিল ফিলিয়াসের সাময়িক খেয়াল কেটে গেলেই তিনি বুঝবেন, ‘এ বাপু সম্ভব নয়।’ কিন্তু যেমন কথা তেমন কাজ ভেবে বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছিলেন ফিলিয়াস। বুঝতেই পারছ জুল ভার্নের অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ বইটির কাহিনি বলছিলাম। বইটি পড়ে অনেকেই হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেবেছ, গল্প-উপন্যাসেই পুরো বিশ্ব ঘুরে ফেলা সম্ভব। বাস্তবে কি আর হয়? হয়, হয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? বাস্তবে ফিলিয়াসের মতোই দেখা মিলেছে এক অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীর। মাত্র ২৭ বছর বয়সে পুরো পৃথিবী চক্কর দিয়ে গিনেস বুকে নাম ওঠাতে চলেছেন তিনি!
তাঁর নাম ক্যাসেন্ড্রা ডি পেকল, ডাকনাম ক্যাসি। বাড়ি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ছোটবেলায় স্কুলে দেখতেন একই ক্লাসে কত রকম মানুষ। কেউ এশিয়ান, তো কেউ আফ্রিকান। আবার কেউ খ্রিষ্টান, তো কেউ মুসলিম। তাঁর আগ্রহ হতে থাকে বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি, জীববৈচিত্র্য, জীবনযাপন সম্পর্কে জানার। অনেকের হয়তো জীববিজ্ঞান বিষয়টা দুই চোখের বিষ। তবে ক্যাসেন্ড্রার এ বিষয়েও ছিল অপরিসীম আগ্রহ। তাই স্কুলে বেশি বেশি মন দিয়ে পড়তেন জীববিজ্ঞান। পড়তে পড়তে টের পান পরিবেশ নিয়ে তাঁর কাজ করার আগ্রহ রয়েছে। সেই সঙ্গে উত্সুক হন পরিবেশকে জানার। দেশ-জাতি বা পরিবেশ নিয়ে জানতে হলে এখন গুগল করলেই চলে। কিন্তু ক্যাসেন্ড্রার মনে উঁকি দিয়েছিল অন্য এক ইচ্ছা—পৃথিবীর সব কটা দেশে একবার পা ফেলবার। ক্যাসেন্ড্রা ইচ্ছা আঁকড়ে ধরে রইলেন।
পুরো পৃথিবী ঘুরতে বেশ পয়সাকড়ি দরকার। এ রকম কথা একেবারে ভুল না। তবে ইচ্ছাশক্তিই যে সবচেয়ে বড় বিষয়, সেটাই প্রমাণ করলেন ক্যাসি। ১৯ থেকে ২৪ বছরের মধ্যে নিজ অর্থে ঘুরে ফেললেন ২৪টির বেশি দেশ। এই অর্থ তিনি সংগ্রহ করেছেন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে।
বিভিন্ন দেশের হোটেলে খণ্ডকালীন চাকরি জুটিয়ে, খাবার পরিবেশন করে, ফ্লোর ঝাঁট দিয়ে, বিভিন্ন স্থানে গাছ লাগিয়ে। মোটকথা কষ্ট করে উপার্জন করেছেন এই অর্থ।
তাঁর ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিয়ে যুক্ত হন ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পিস থ্র ট্রাভেলিং বা আইআইপিটির সঙ্গে। ভ্রমণের মাধ্যমে যে বিশ্বশান্তির কথা প্রচার করা যায়, সেই বার্তাটি বিশ্বে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে দিতে আইআইপিটির শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ শুরু করেন। নিজের ঘরের দেয়ালে বিশ্বমানচিত্র টানিয়ে হিসাব কষে ফেলেন, জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত সার্বভৌম ১৯৩টি দেশ ছাড়াও ফিলিস্তিন, কসোভো ও তাইওয়ানে ঘুরবেন। এই মিশনের নাম দেন ‘এক্সপেডিশন১৯৬’। সঙ্গে আরেকটি লক্ষ্য, গিনেস বুকের আগের রেকর্ড ভাঙা! এর আগে ইলি লিউ বিশ্বের সার্বভৌম ১৯৪টি দেশে তিন বছর তিন মাস ছয় দিন সময় নিয়ে ঘুরে গিনেস বুকে নাম উঠিয়েছিলেন দ্রুততম পর্যটক হিসেবে। তাই এর কম সময়ে ঘুরতে পারলে ক্যাসেন্ড্রা পৃথিবীর প্রথম নারী ও কনিষ্ঠ আমেরিকান এবং দ্রুততম পর্যটক হিসেবে সার্বভৌম সব দেশ ঘোরার গৌরব নিয়ে গিনেস বুকে নাম ওঠাবেন আগের রেকর্ড ভেঙে। বলে রাখা ভালো, আগে ব্যক্তিগতভাবে ভ্রমণ করা ২৪টি দেশও আবার ঘুরতে হবে তাঁকে।
জুলাই ২০১৫ সালে পালাউ দিয়ে যাত্রা শুরু করেন ক্যাসি। ইতিমধ্যে তিনি ১৮১টি দেশ ঘুরে ফেলেছেন। আর ৪০ দিনের মধ্যে তিনি ঘুরবেন বাকি ১৫টি দেশ। এবার স্পন্সর হিসেবে পেয়েছেন নামীদামি অনেক প্রতিষ্ঠান আর পত্রপত্রিকাকে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন পাঁচ তারকা হোটেলের প্রমোশন করছেন ক্যাসি তাঁর টুইটার ও ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে। ফলে থাকার খরচটাও আর বইতে হচ্ছে না তাঁকে। ‘এক্সপেডিশন১৯৬’-এর মোট খরচ পড়ছে প্রায় দুই লাখ মার্কিন ডলার।
অপরিসীম ভালোবাসা আর মহান কোনো অর্জনের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি নিতে হয়। দালাই লামার এমন কথা ধরেই এগোচ্ছেন ক্যাসি। একা একা এত জায়গায় ঘুরছেন, তাই খানিকটা প্রতিকূলতার সম্মুখীনও হচ্ছেন তিনি। নিজেই জানিয়েছেন সেই কথা, ‘অনেকেই ভেবেছে আমি নারী বলে আমার থেকে আলাদা সুবিধা নিতে পারবে কিংবা ঠকিয়ে বেশি অর্থ আদায় করবে। আমি তাদের উদ্দেশ্য বোঝামাত্র সেটার সোজাসাপ্টা প্রতিবাদ করেছি। ঝামেলা বাড়তে দিইনি।’
শান্তির বার্তা পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ক্যাসি দেখা করছেন বিভিন্ন দেশের মেয়র, মন্ত্রী ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তাঁর অভিজ্ঞতা, পরিবেশ ও লক্ষ্য নিয়েও কথা বলছেন। এ ছাড়া গবেষণা করছেন মাইক্রোপ্লাস্টিক নিয়ে। খালি চোখে দেখা যায় না, অথচ পানিতে মিশে আছে এমন দূষিত মাইক্রোপ্লাস্টিক ছড়িয়ে আছে পানিতে। ক্যাসি পুরো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হ্রদ বা নদীর পানি তাই বোতলে সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছেন নিজ দেশে গবেষণার জন্য। দেখো, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়ায়!
ক্যাসির বাংলাদেশ সফরও শেষ। কাজের সুবিধা অনুযায়ী, একেকটি দেশে দুই থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ দিন থাকছেন তিনি। আর তাঁর পুরো ভ্রমণ অভিজ্ঞতা দেখতে পাবে ইউটিউব চ্যানেল এক্সপেডিশন১৯৬-তে।