ক্রিকেট তারকাদের ‘জুনিয়র’দের গল্প
পাঁচ বছর বয়সী পুত্রকে প্রথমে কাঁধে তুললেন। তুলেই ধপাস করে আছড়ে ফেললেন পুকুরের পানিতে! ছেলে বাবার কাঁধ থেকে ঝাঁপিয়ে দিব্যি সাঁতরে চলল। পাঁচ বছর বয়সী পুত্রের এই সাঁতার-প্রতিভা দেখে ভীষণ মুগ্ধ মাশরাফি বিন মুর্তজা ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে লিখেছেন, ‘খুবই ভালো করেছ পুত্র। আমরা এখন ভালো সাঁতারু। বয়স শুধুই একটি সংখ্যা (৫)।’
ছেলের সাঁতার-সাফল্যে মাশরাফি তো খুশি হবেনই, প্রায় দুই বছরের চেষ্টা যে সফল হলো। আড্ডায় ছেলের প্রসঙ্গ এলেই হাসতে হাসতে বলেন, ডানপিটে-দুরন্তপনায় তাঁর ছেলে যেন তাঁকেও হার মানাচ্ছে! মিরপুরের বাসায় ছেলেকে ঘরবন্দী রাখাটা তাঁদের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ। হুটহাট করে এদিক-ওদিক দৌড় দেয়, লিফটে ঢুকে পড়ে! মাশরাফির মুখে পুত্র সাহেলের ডানপিটে চরিত্রের মজার সব ঘটনা শুনে তোমাদের হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যাবে নিশ্চিত! গত এপ্রিলে বিটিভিতে প্রচারিত মাশরাফির একটি ‘লাইভ’ নিশ্চয়ই মনে আছে। সরাসরি সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানে বাবা করোনাভাইরাস নিয়ে খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছেন। তখনই নিঃশব্দে পেছন থেকে লাইভে ঢুকে পড়ে সাহেল! এই দৃশ্য দেখে লাইভে থাকা অন্য অতিথিদের গোমড়া মুখগুলো ফিক করে হেসে উঠল! শুধু ডানপিটেই নয়, সাহেল মানসিকভাবেও নাকি ভীষণ শক্ত। হাত-পা কেটে রক্ত বের হলে বা ছোটাছুটি করতে গিয়ে শরীরে আঘাত পেলেও কান্না দূরে থাক, ব্যথার অনুভূতি পর্যন্ত সহজে প্রকাশ করতে চায় না।
সাকিব আল হাসানের পাঁচ বছর বয়সী মেয়ে আলাইনা যেন সাহেলের বিপরীত, ভীষণ লক্ষ্মীমন্ত। মাঝেমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভিডিও কিংবা লেখায় কন্যার বুদ্ধি, মেধা বা সৃজনশীলতার নানা গল্প সাকিব-শিশির দম্পতি ভাগাভাগি করেন ভক্তদের সঙ্গে। গত মাসে শিশির যেমন আলাইনার একটা গল্প বলছিলেন। বাবা যখন দূরে থাকে, আইপ্যাডে মেয়ে আলাইনা তখন সাকিবকে খোঁজে এভাবে:
সিরি (কণ্ঠ শুনে প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার অ্যাপ): আমি তোমাকে কীভাবে সহায়তা করতে পারি? আলাইনা: আমার জন্য বাবা সাকিব আল হাসানকে খুঁজে দাও।
সিরি: বাবা সাকিব আল হাসানকে খোঁজা হচ্ছে! সাকিব আল হাসান একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশি ক্রিকেটার, তিনি একজন অলরাউন্ডার!
আলাইনা: না! আমি বলেছি, আমার জন্য বাবা সাকিবকে খুঁজে দাও!
গত মে মাসে অবরুদ্ধ সময়ে করোনাভাইরাস থেকে দূরে থাকতে আলাইনা একটি ভিডিওতে কিছু পরামর্শও দিয়েছে সবাইকে, ‘হাত ধুতে হবে। মাস্ক পরতে হবে। সুরক্ষার কাপড় পরতে হবে। সব সময়ই হাত, শরীর, পা ধুতে হবে...।’ পাশ থেকে যখন কেউ (সম্ভবত সাকিবের স্ত্রী শিশির) একজন যোগ করলেন, ‘পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।’ এতে অবশ্য বেশ আপত্তি আছে আলাইনার, ‘আমি এটা বলিনি।’ পুষ্টিকর খাবারের প্রতি শিশুদের চিরায়ত বিরক্তিটাই ঝরেছে সাকিবকন্যার কণ্ঠে!
এবার মুশফিকুর রহিমের আড়াই বছরের ছেলে শাহরুজ রহিম মায়ানের গল্প শুনি। মহামারিতে যখন ঘরবন্দী সময় কেটেছে, তখন শাহরুজকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকতেন মুশফিক। রমজান মাসে ছেলের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটত, সেটি নিয়ে বাংলাদেশ দলের এই তারকা ব্যাটসম্যান বলছিলেন, ‘ভোররাতে সাহ্রি খেয়ে নামাজ পড়ে ঘুমাই। ঘুম থেকে দেরিতে উঠতে মন চায়। কিন্তু ছেলে মায়ান ঘুম থেকে উঠে গেলেই আমাদের ঘুমও শেষ। বাবা ওঠো, মাম্মা ওঠো বলে আমাদের সে উঠিয়ে দেবেই!’
মুশফিকের ছেলে কতটা ডাইনোসর-ভক্ত, সেটি জানা গেছে গত ফেব্রুয়ারিতে। মিরপুরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরির পর ডাইনোসরের মতো ভঙ্গি করে উদ্যাপন করেছিলেন মুশফিক। নিজেই পরে বলেছিলেন, উদ্যাপনটা ছিল ছেলের জন্য। প্রাণহীন জীবজন্তু শাহরুজের খেলার সঙ্গী। সে বেশি পছন্দ করে ডাইনোসর। ছোট-বড় অসংখ্য ডাইনোসর তার সংগ্রহে। কীভাবে ডাইনোসরের ভক্ত হলো সেই গল্পও শুনিয়েছেন মুশফিক। একবার ব্যাটারিচালিত একটি ডাইনোসর এনে দিয়েছিলেন। সেটার আবার মুখ দিয়ে আগুন বের হতো (সত্যিকারের আগুন নয়)। কিন্তু ছেলে শাহরুজ সেটাকে ভয় না পেয়ে নিল আপন করে। সেই থেকে তার ডাইনোসরপ্রীতি।
বাংলাদেশের কোনো এক ম্যাচ শেষে শাহরুজকে ড্রেসিংরুমে এনেছিলেন মুশফিক। সতীর্থের ছোট্ট গুলগুলি বাচ্চাটাকে মাশরাফি অনেক আদর করে বলেন, ‘বাপের মতো বাইড়ে (বেঁটেখাটো) যদি হইস...!’ এটা শুনে মুশফিক তো হেসেই বাঁচেন না!
তামিম ইকবালের ছেলে আরহাম হয়েছে বাবার মতোই চটপটে, ভীষণ স্মার্ট! বাংলাদেশ দলের ড্রেসিংরুমে তার বাবার পরিচিতি ‘সবজান্তা’ হিসেবে। আরহামও যেন বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করছে! মা আয়েশা ইকবাল প্রায়ই আরহামের ভিডিও পোস্ট করেন ইনস্টাগ্রামে। সেসব ভিডিওতে চার বছর বয়সী তামিম-পুত্রের স্মার্টনেস দেখে শুধুই মুগ্ধ হতে হয়। ২০১৮ সালে একবার আরহামের কিছু ছবি পোস্ট করেছিলেন তার মা। ছবিতে দুই বছর বয়সী আরহাম কালো পাঞ্জাবি-পায়জামা আর গলায় বড় সোনার চেইন পরে পায়ের ওপর পা তুলে নবাবি ঢঙে বসে আছে। সেই ছবি তামিম দেখেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গায়ানা থেকে সেন্ট কিটসে যাওয়ার ফ্লাইটে বসে। ছবি দেখে বাঁহাতি ওপেনারের হাসি দেখে কে!
আফগানিস্তানের বিপক্ষে এখন বাংলাদেশের খেলা হলেই আলোচনায় চলে আসেন রশিদ খান। রশিদকে কীভাবে সামলাবেন, এ নিয়ে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের অসংখ্য উত্তর দিতে হয়। রশিদ খান যে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের পরিবারেও ঢুকে পড়েছেন, সেটি জানা গেছে গত মে মাসে ইনস্টাগ্রাম লাইভে আসা মাহমুদউল্লাহ-তামিমের কথোপকথনে। তামিম লাইভে মাহমুদউল্লাহকে প্রশ্ন করেন, ‘রায়িদ (মাহমুদউল্লাহর বড় ছেলে) আর রশিদ খানের কী খবর?’ বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টি অধিনায়কের হাসিমাখা উত্তর, ‘রায়িদ আর রশিদ খান আছে। যখন রুম ক্রিকেট খেলি...ওই যে সে একবার বলেছিল, “রশিদ খান, আমি তোমাকে দেখে নেব!” সম্ভবত এশিয়া কাপে (২০১৮) ওর বলে আউট হওয়ার পর। আমি তখন তাকে (ছেলেকে) বলেছিলাম, এটা খেলার অংশ হতেই পারে।’
তিন সংস্করণে আফগানিস্তানের বিপক্ষে খেলা ১৩ ইনিংসে রশিদ খানের বলে চারবার আউট হয়েছেন মাহমুদউল্লাহ। পরিসংখ্যান দেখে এখনো বলার উপায় নেই যে মাহমুদউল্লাহ রশিদের ‘বানি’ হয়েছেন! তামিম তাই জানতে চান, ‘এখনো কি সে রশিদ খানের ওপর ক্ষিপ্ত?’ মাহমুদউল্লাহ বলেন, ‘না না, এখন আর না (ক্ষিপ্ত)। এখন সে (রায়িদ) পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।’
ক্রিকেটীয় ব্যস্ততার ফাঁকে মাহমুদউল্লাহ নিয়মিত ছেলেকে পড়াতে বসান। শিক্ষকদের দেওয়া বাড়ির কাজগুলো (হোমওয়ার্ক) করিয়ে দেন, ক্রিকেটারদের মধ্যে যা একটু ব্যতিক্রম। তারকা ‘জুনিয়র’দের অনেক গল্পই তো হলো। একটা সুখবর দিয়ে লেখাটা শেষ হোক। গত সেপ্টেম্বরে মেহেদী হাসান মিরাজ ফোন দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি তো বাবা হতে যাচ্ছি! সব ঠিক থাকলে অক্টোবরেই আসবে নতুন অতিথি!’
মিরাজের সন্তান চলে এসেছে পৃথিবীতে। আগমনটা তাহলে মিলে গেল কিশোর আলোর জন্মমাসের সঙ্গে! মিরাজ ও তাঁর সন্তানের জন্য হয়ে যাক জোরে একটি তালি!
(কিশোর আলোর নভেম্বর ২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত)