কথা ছিল পাইলট হবে! উড়োজাহাজের ককপিটে বসে শাঁ করে উড়ে যাবে আমাদের মাথার ওপর দিয়ে। তান্হা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে না গেলেও ‘কীভাবে মজিলার প্রতিনিধি নির্বাচিত হলো’ জানতে চাওয়ায় যে লম্বা বয়ান শুরু হলো, কথাগুলো আমাদের মাথার ওপর দিয়েই যায় বইকি! বিভ্রান্ত দৃষ্টি দেখে তান্হা ইসলাম ধীরে-সুস্থে, সহজ করে আমাদের বুঝিয়ে বলে।
ঘটনার শুরু ‘টি-শার্ট’ থেকে। সাদমান নামের এক সহপাঠীকে জনপ্রিয় ‘ওয়েবসাইট দেখার সফটওয়্যার’ ফায়ারফক্সের কমলা-নীল লোগো বসানো টি-শার্ট পরতে দেখে কৌতূহল হয়েছিল তান্হার। জিজ্ঞেস করে জানতে পারে, ‘মজিলা বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন রয়েছে, যারা মূলত মজিলার প্রচারণার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সাদমানের কাছেই তথ্য পেল, ফেসবুকে এই সংগঠনের একটা গ্রুপও আছে। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী তান্হা। সফটওয়্যারের প্রতি তার একটা ‘সফট কর্নার’ থাকাই স্বাভাবিক! বাসায় ফিরেই তাই চটজলদি মজিলা বাংলাদেশের ফেসবুক পেজে যোগ দিয়ে ফেলল। শুরু হলো স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মজিলার সঙ্গে তার যাত্রা। ‘প্রদায়ক হিসেবেই মজিলার প্রচারণার কাজ করছিলাম। কাজের প্রতি আমার ইচ্ছা আর আগ্রহ দেখে সংগঠনের একজন বড় ভাই মজিলা রেপস হিসেবে কাজ করতে আবেদন করার পরামর্শ দিলেন।’ আলোচনার এই জায়গায় আমরা আবার ভ্রু কুঁচকে তাকাই। মজিলা রেপস জিনিসটা কী! জানা গেল, মজিলা রেপস হলো ‘মজিলা রিপ্রেজেন্টেটিভ’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। মজিলা আনুষ্ঠানিকভাবে বিভিন্ন দেশ ও এলাকায় তাদের কিছু প্রতিনিধি নির্বাচন করে থাকে। বাংলাদেশেও মজিলার আটজন প্রতিনিধি আছেন। তান্হা মজিলা রেপসে আবেদন করল। কদিন বাদেই এল সুখবর। বাংলাদেশে মজিলার নবম প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হলো তান্হা ইসলাম। প্রতিনিধির তালিকায় নবম হলেও বাংলাদেশে সে-ই প্রথম মজিলার নারী প্রতিনিধি।
তিন ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট আমাদের তান্হা। বড় বোন ট্রিসা আর ভাই তানজিমের কাছেও তাই আদরটা পায় একটু বেশি। বাবা মো. মোমিনুল ইসলাম আর মা শারমিন সুলতানাও মজিলায় তান্হার কর্মকাণ্ডকে বেশ উত্সাহিত করেন। তবে তোমাদের আব্বু আম্মুর মতো তাঁদেরও একই কথা, ‘পড়ালেখার যেন ক্ষতি না হয়।’ প্রথমে ভিকারুননিসা নূন স্কুল আর পরে সিটি কলেজের ছাত্রী তান্হাকে ছোটবেলা থেকেই বন্ধুরা ‘টমবয়’ হিসেবে চেনে। হাঁড়ি-পাতিল কিংবা পুতুল খেলা নয়, বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন খেলেই তার বেড়ে ওঠা। পাইলট হওয়ার স্বপ্নের কথা তো তোমাদের আগেই বলেছি।
বিমান চালাতে না পারলেও তান্হা গান গাইতে পারে, ছবি আঁকতে পারে। মজিলার কাজ, গান, ছবি, বন্ধুদের আড্ডা, এত কিছুর ভিড়ে পড়ালেখাটা কেমন লাগে? এমন প্রশ্নে তান্হার উত্তরটাও একদম তোমাদের মতোই। ‘পড়ালেখা ভালোই লাগে। শুধু পরীক্ষা জিনিসটা না থাকলে ভালো হতো। হা হা হা!’
পরীক্ষা ভালো লাগুক বা না লাগুক, তান্হা কিন্তু মজা করতে করতে তার পড়ালেখার বিষয়টার সঙ্গে বেশ একটা সখ্য গড়ে ফেলেছে। প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করতে করতে শিখে ফেলেছে অনেক কিছু। ‘আমি এখন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিলার জন্য কাজ করছি। আরও স্বেচ্ছাসেবক, বিশেষ করে নারী স্বেচ্ছাসেবক পাওয়ার চেষ্টা করছি।’ বলছিল তান্হা। এখন প্রতিনিধি ও আঞ্চলিক বিপণন দূত হিসেবে দায়িত্বটাও বেড়ে গেছে অনেক। শুধু স্কুল-কলেজগুলোতে ঘুরলেই চলে না, টেবিলে বসে গুরুগম্ভীর ‘মিটিং’ও করতে হয় তান্হাকে। জেনে আমরা তাকে আরও একবার ভালো করে দেখি। ছোটখাটো একটা মেয়ে, বড়দের সঙ্গে বসে গম্ভীর মুখে কঠিন কঠিন কথা বলছে, ব্যাপারটা ঠিক মানায় না! জানতে চাই, অন্যদের সঙ্গে কি সে-ও পুরোদমে কাজ করে, নাকি ‘পুঁচকে’ বলে কাজে ফাঁকি দেয়? ‘পুঁচকে’ শুনেই বোধ হয় একটু নড়েচড়ে বসল তান্হা। এবার সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘আমরা সবাই একই উদ্দেশ্যে মজিলায় কন্ট্রিবিউট করছি। এখানে কেউ ছোটও নয়, কেউ বড়ও নয়। আমরা সবাই মজিলিয়ান। আমাদের উদ্দেশ্য এক ও অভিন্ন।’
তান্হা জানাল, যেসব নারী মজিলার জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ে যাঁদের আগ্রহ আছে, তাঁদের বলা হয় ডব্লিউওএমওজেড (উইমেন অ্যান্ড মজিলা)। ছেলেদের পাশাপাশি যেসব মেয়ে মজিলার নানা কাজে যুক্ত হতে আগ্রহী কিংবা কাজ করছেন তাঁদের নিয়ে গঠিত এ ডব্লিউওএমওজেডদের দল ভারী করতে বেশ আগ্রহী তান্হা।
কঠিন সব কথা শুনতে শুনতে আমরা হাঁপিয়ে উঠি। এবার প্রসঙ্গ বদলাই। আচ্ছা, ‘তান্হা’ শব্দের অর্থ কী? জানা গেল, তান্হা মানে ‘একা’। মজিলার আটজন ছেলে প্রতিনিধির সঙ্গে নারী প্রতিনিধি হিসেবে তান্হা একাই বটে। তবে তার মতে, ‘একা’ থাকতে ভালো লাগে না। আরও অনেক মেয়ে মজিলার প্রদায়ক, প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করুক, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে এগিয়ে যাক, এমনটাই তার চাওয়া।
তো আর দেরি কেন? তান্হা ওয়েব, সফটওয়্যার, ইন্টারনেট সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে তোমাদের সামনে কঠিন কঠিন কথা বলবে, আর তোমরা মুখ বুজে শুনবে? মেয়েরা যারা আছো, ঝাঁপিয়ে পড়ে তান্হার একাকিত্ব গুঁড়িয়ে দাও! প্রমাণ করে দাও, তান্হা একা নয়, তোমরাও আছো! এ দেশে মজিলার প্রথম নারী প্রতিনিধি কিন্তু হাসিমুখেই তোমাদের গ্রহণ করবে বলে কথা দিয়েছে!