প্রাচীন গ্রিসে ডায়োনিসাস নামের এক দেবতা ছিলেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, এই দেবতার জন্ম দেবলোকে নয়; মর্তে, মানে পৃথিবীতে। কারণ তাঁর মা কোনো দেবী ছিলেন না। তিনি ছিলেন মানবী। থিবসের রাজা ক্যাডমাসের মেয়ে সেমিলি ছিলেন তাঁর মা। আর বাবা ছিলেন দেবরাজ জিউস। তো একদিন জিউস খুশি হয়ে সেমিলির কাছে জানতে চাইলেন যে দেবরাজের কাছে তাঁর কোনো কিছু চাওয়ার আছে কি না।
সেমিলি জানালেন, তাঁর কিছুই চাওয়ার নেই, শুধু একটি জিনিস ছাড়া।
দেবরাজ জানতে চাইলেন, কী সেই জিনিস?
সেমিলি জানালেন, তিনি তো জিউসের মানবরূপটাই দেখেছেন। এবার তিনি দেখতে চান দেবতার আসল রূপ।
এ কথা শুনে দেবরাজ খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি তাঁকে বারবার বোঝাতে লাগলেন যে একজন মানুষের জন্য এটা খুবই বিপজ্জনক ইচ্ছা। এ ইচ্ছা ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু সেমিলি নাছোড়বান্দা। কোনো কথাই শুনতে তিনি রাজি হলেন না। জিউসের আসল রূপ তিনি দেখবেনই।
শেষমেশ খুব অনিচ্ছার সঙ্গে রাজি হলেন দেবরাজ। তারপর তিনি নিজ রূপ প্রকাশ করলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন আকাশ ও বজ্রবিদ্যুতের দেবতা, তাই তাঁর উত্তাপ ও ঝলকে সেমিলি প্রথমে অন্ধ হয়ে গেলেন, তারপর ভস্ম হয়ে গেলেন। অনমনীয় ইচ্ছা তাঁর জীবন নিয়ে নিল। তবে তখন তাঁর গর্ভে ছিলেন ডায়োনিসাস। যেহেতু তিনি দেবরাজের পুত্র, তাই দেবরাজ তাঁকে রক্ষা করলেন। জিউস তাঁকে দেবদূত মার্কারির মাধ্যমে গাছগাছালিতে ভরা একটা জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন।
সেখানে বনদেবীরা তাঁকে বড় করে তুললেন। জায়গাটা আঙুরলতায় ভরা ছিল।
প্রচুর আঙুর হতো সেকালের গ্রিস দেশে। মানুষ নানাভাবে আঙুর খেত এবং সংরক্ষণ করত। আঙুর এবং তা থেকে তৈরি পানীয় তারা দেশ–দেশান্তরে রপ্তানি করত। এসব রপ্তানি পণ্যে বোঝাই জাহাজ ভাসত ভূমধ্যসাগরের জলে। তাদের আয়ের বড় উৎসও ছিল আঙুর চাষ। তাই আঙুরের গুণকীর্তনও করত মানুষ। তো এই ডায়োনিসাস দেখতে অতি সুদর্শন হয়ে উঠলেন। আর হবেন নাই–বা কেন, তিনি যে দ্রাক্ষালতা (আঙুরলতা) ও আঙুর দেবতা। বনদেবীদের কাছে কেটে গেল তাঁর অনেক দিন। তারপর একদিন তিনি বেরিয়ে পড়লেন দেশ ভ্রমণে। লিডিয়া, ফ্রিজিয়া, পারস্য, আরব প্রভৃতি দেশে তিনি আনন্দ-উল্লাস, শিল্প, সংগীতের চর্চায় জোয়ার আনলেন। লোকজন তাঁর ভক্ত হয়ে গেল। ফলে তিনি দেবখ্যাতি পেয়ে গেলেন। কিন্তু গ্রিস দেশে তাঁর প্রতিষ্ঠা হতে তখনো বাকি।
দেবরাজ খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি তাঁকে বারবার বোঝাতে লাগলেন যে একজন মানুষের জন্য এটা খুবই বিপজ্জনক ইচ্ছা। এ ইচ্ছা ত্যাগ করা উচিত। কিন্তু সেমিলি নাছোড়বান্দা। কোনো কথাই শুনতে তিনি রাজি হলেন না। জিউসের আসল রূপ তিনি দেখবেনই।
এ অবস্থায় একদিন গ্রিসের এক নির্জন সমুদ্রসৈকতে এসে ডায়োনিসাস চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। এক জলদস্যুবাহী জাহাজ থেকে দেখা গেল তাঁকে। দস্যুদের প্রধান হুকুম দিল তাঁকে জাহাজে ওঠানোর। আদেশমতো তাঁকে তোলা হলো জাহাজে। এবারে তাঁকে বাঁধার চেষ্টা চলতে লাগল। কিন্তু যতবারই তাঁকে বাঁধার জন্য রশিতে গিঁট দেওয়া হয়, ততই সেই গিঁট খুলে যায় আপনাআপনি। জাহাজের এক বুড়ো নাবিক এটা দেখে বুঝে ফেলল, ইনি নিশ্চয়ই দেবতা। নইলে এমন তো কিছুতেই হওয়ার কথা নয়। সে চেঁচিয়ে তাঁকে ছেড়ে দিতে বলল। কিন্তু তার কথায় পাত্তাই দিল না কেউ। জাহাজের প্রধান বলল, এক্ষুনি ভাসাও জাহাজ। তুলে দাও পাল।
তোলা হলো পাল। ভাসানোর চেষ্টা করা হলো জাহাজটাকে। কিন্তু জাহাজ অনড়। ডায়োনিসাস তখনো মুচকি হাসছেন। এমন সময় হঠাৎ জাহাজের পাটাতন ভেদ করে উঠে এল আঙুরলতা। তারপর তা লকলক করে উঠে যেতে লাগল জাহাজের মাস্তুল বেয়ে। আঙুরলতা থেকে আঙুর আর তা থেকে দ্রাক্ষারসে ভরে গেল জাহাজ। তখন দেবতা রূপ ধারণ করলেন সিংহের। তিনি সব নাবিক-দস্যুদের খেয়ে ফেললেন। শুধু ওই বুড়ো নাবিকটাকে বাঁচিয়ে রাখলেন।
এবার দেবতা গেলেন থিবসে, তাঁর মায়ের দেশে। সেখানকার রাজা তখন আর ক্যাডমাস নেই। তার অন্য এক মেয়ে অ্যাগেভের ছেলে পেনথিউস তখন রাজা। কিন্তু ডায়োনিসাসকে মোটেই পছন্দ করলেন না তিনি। তিনি তাঁর দেবত্বকেও অস্বীকার করল। তাঁর সব ক্ষমতাকেও অস্বীকার করলেন। কিন্তু তাতে কী! দেবতার মাহাত্ম্যে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেছে তত দিনে। দেশ–দেশান্তরের অসংখ্য মানুষ আঙুরের রস পান করে মাতাল হয়ে গেছে। শেষমেশ রাজা বুড়ো নাবিকটাকে ধরে আনালেন। সেও ডায়োনিসাসের সঙ্গেই এসেছিল। তাকে বন্দী করার আদেশ দিলেন রাজা। সৈন্যরা তাকে বেঁধে নিয়ে গরাদের ভেতর ঢুকিয়ে বাইরে থেকে বন্ধ করে দিল ফটক। কিন্তু কী আশ্চর্য! বুড়োর বাঁধন খুলে গেল আপনাআপনি। ফটকও খুলে গেল৷ বুড়ো নাবিক মুক্ত হয়ে ফটক পেরিয়ে সবার সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেল। সবাই তাকে আটকানোর শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলল।
এ ঘটনায় রাজ্যের সবাই বুঝতে পারল যে ইনি একজন দেবতা। কিন্তু রাজা তবু বিরোধিতা করেই চললেন। সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে ডায়োনিসাসের জয়ধ্বনি দিতে লাগল। রাজপ্রাসাদের লোকজনও বেরিয়ে এল। এমনকি রাজার মা–ও জয়ধ্বনি দিতে লাগলেন ডায়োনিসাসের। তখন রাজা যুদ্ধ করতে মনস্থ করলেন। কিন্তু যখন তিনি ময়দানে উপস্থিত হলেন, তখন তাঁর সঙ্গী বলতে রইল না আর কেউ। তাঁর দিকে তাকাতেই তাঁর মা দেখলেন, একটা কুৎসিত শূকর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যরাও তা-ই দেখল। সবাই বলল, ‘মারো, মারো ওকে।’ রাজা তখন দৌড়ে তাঁর মায়ের কাছে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু উন্মত্ত জনতার বেধড়ক পিটুনিতে প্রাণ গেল তাঁর। সবাই তখন ডায়োনিসাসের জয়ধ্বনিতে মেতে উঠল। এবারে ডায়োনিসাস চললেন অলিম্পাস পর্বতের দেবপুরীতে। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানালেন দেবরাজ জিউস। তবে দেবপুরীতে জিউসের পাশে দেবরানি জুনোকে দেখে তাঁর মনে পড়ে গেল নিজের মায়ের কথা। যেখানে তাঁর মা নেই, সেখানে তিনি থাকবেন কেন? তখন দেবলোক ছেড়ে চলে গেলেন প্লুটোর প্রেতরাজ্যে। প্রেতরাজ্ঞী প্রসের্পিনের সাহায্যে তিনি তাঁর মাকে জীবিত করে তুললেন। এরপর মাকে নিয়ে তিনি গেলেন দেবলোকে। কিন্তু সেখান থেকে জানানো হলো, কোনো মানবীর দেবলোকে ঠাঁই নেই। তখন মায়ের জন্য রুখে দাঁড়ালেন তিনি। প্রতিবাদী কণ্ঠে বলে উঠলেন, কোনো মানবী কি জিউসের প্রকৃত রূপ কখনো দেখতে পেরেছে? কোনো মানবী কি মৃত্যুর দীর্ঘকাল পর প্রেতলোক থেকে জীবিত ফিরে আসতে পেরেছে?
এ কথা কেউ খণ্ডন করতে পারলেন না। দেবতারাও নন। তখন দেবরাজ জিউসের কাছ থেকে ডায়োনিসাস তাঁর মা সেমিলির দেবপুরীতে ঠাঁই পাওয়ার অধিকার আদায় করে নিলেন। এভাবে মায়ের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করে তবেই ডায়োনিসাস স্বর্গে বসবাস শুরু করলেন।