ডাকটিকিটে রূপকথা

১৯৭৮ সালে পূর্ব জার্মানি থেকে প্রকাশিত শিটলেট

রূপকথার অনন্য জগৎ ডাকটিকিটের একটি জনপ্রিয় বিষয়। সিন্ডারেলা, স্লিপিং বিউটি, রাপানজেল, লিটল মারমেইড, হ্যান্সেল এণ্ড গ্রেথেল ল, গিজ গার্ল, অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড, ইত্যাদি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অসংখ্য ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে। ছোট বড় সবার রূপকথার প্রতি ভালবাসা আর ডাকটিকিটের প্রতি আকর্ষন মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছে এই রূপকথার ডাকটিকিটে। গ্রিম ব্রাদার্স সংকলিত ইউরোপের প্রচলিত রূপকথার মাঝে একটি অনন্য গল্প রাপানজেল, যার চুল ছিল চল্লিশ হাত লম্বা। ১৯৭৮ সালে পূর্ব জার্মানী ছয়টি ডাকটিকিটের একটি সেটের মাধ্যমে সম্পূর্ণ গল্পটি তুলে ধরে। এছাড়া, লাইবেরিয়া, রাশিয়া, ভুটান, চাঁদ, জাপান, টোঙ্গা, ইত্যাদি দেশও বিভিন্ন সময়ে রাপানজেলকে নিয়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে।

অনেক দিন আগের কথা। এক দেশে ছিল এক কাঠুরে আর তার বউ। সেই কাঠুরে দম্পতির কোনো ছেলেমেয়ে ছিল না বলে তাদের মনে খুব দুঃখ ছিল। অবশেষে কাঠুরে গিন্নি বুঝতে পারল যে তাদের একটা সন্তান আসবে।

তাদের কুটিরের পেছনে ছোট্ট একটা জানালা দিয়ে একটা ফুলে-ফলে ভরা বাগান দেখা যেত, যদিও বাগানটা ছিল উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘেরা আর এই বাগান ছিল এক ডাইনি বুড়ির। একদিন কাঠুরে গিন্নি সেই ডাইনির বাগানের সতেজ-সবুজ টসটসে রাপানজেল (একধরনের লেটুসপাতা) দেখে আর লোভ সামলাতে পারল না। তার রাপানজেলের সালাদ খাওয়ার ইচ্ছা বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হলো যে সে বিছানায় পড়ে গেল।

গিন্নির অবস্থা দেখে কাঠুরে চিন্তিত হয়ে পড়ল, ‘তোমার কী হয়েছে?’

‘আহ্! পাশের বাগানের কিছু রাপানজেল না পেলে মনে হয় আমি আর বাঁচব না।’

কী আর করা! সন্ধ্যা ঘনানোর পর সেই কাঠুরে উঁচু প্রাচীর ডিঙিয়ে ডাইনির বাগানে ঢুকে কিছু রাপানজেল চুরি করে আনল। কাঠুরে গিন্নি সঙ্গে সঙ্গে সেটা কুচি কুচি করে কেটে সালাদ বানিয়ে খেয়ে নিল। সেই সালাদ খেতে এতই ভালো হয়েছিল যে পরদিন সে আবার তার স্বামীকে আরও কিছু রাপানজেল নিয়ে আসতে বলল।

সে রাতে কাঠুরে যখন প্রাচীরের ঠিক ওপরে, হঠাৎ সে দেখে যে তার পাশে সেই ডাইনি বুড়ি, ‘তোর এত বড় সাহস! তুই আমার বাগান থেকে রাপানজেল চুরি করেছিস! আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’

কাঠুরের তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়, ‘দয়া করে আমাকে মেরো না। আমার বউ তোমার বাগানের রাপানজেল দেখে এতটাই মোহিত হয়েছে যে এটা না খেতে পেলে সে মরেই যাবে। সে জন্যই বাধ্য হয়ে আমি এসেছি।’

কাঠুরের কথা শুনে ডাইনির মনটা একটু নরম হলো, ‘ঠিক আছে, তুমি তোমার ইচ্ছেমতো রাপানজেল নিতে পারো, তবে একটা শর্ত আছে। তোমার বউয়ের যে বাচ্চা হবে, তা আমাকে দিয়ে দিতে হবে।’

নিজের জান বাঁচাতে কাঠুরে ডাইনি বুড়ির কথায় রাজি হয়ে গেল।

দিন যায়, মাস যায়, অবশেষে কাঠুরে গিন্নি একটা কন্যাসন্তানের জন্ম দিল। আর সঙ্গে সঙ্গে সেই ডাইনি তাদের কুটিরের দরজায় এসে হাজির। সে সেই বাচ্চাকে নিয়ে গিয়ে তার নাম রাখল রাপানজেল; কারণ, তার বাগানের রাপানজেলের পরিবর্তে সে এই বাচ্চা পেয়েছে।

রাপানজেল যত বেড়ে উঠতে লাগল, ততই তার রূপ খুলতে লাগল। একসময় সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর বাচ্চায় পরিণত হলো। রাপানজেলের বয়স যখন বারো হলো, তখন ডাইনিটা তাকে গভীর বনের মধ্যে অবস্থিত একটা দুর্গে বন্দী করে রাখল। সে দুর্গে না আছে দরজা, না আছে সিঁড়ি; শুধু একদম ওপরে আছে একটা ঘর আর তার ছোট্ট একটা জানালা।

ডাইনি যখন রাপানজেলের সঙ্গে দেখা করতে আসে, সে বাইরে থেকে হাঁক দেয়,

‘রাপানজেল, রাপানজেল,
তোমার চুল ঝুলিয়ে দাও,
আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’

রাপানজেলের চুল ছিল স্বর্ণের সুতার মতো দেখতে আর লম্বায় পুরো চল্লিশ হাত। ডাইনির হাঁক শুনলে সে তার জড়িয়ে রাখা চুল খুলে নিচে ঝুলিয়ে দেয় আর ডাইনিটা সেই চুল বেয়ে ওপরে আসে।

কয়েক বছর পর এক রাজার কুমার বনের মাঝ দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ খুব মিষ্টি আর সুরেলা কণ্ঠের গান শুনে সে থমকে দাঁড়াল। এটা আর কেউ নয়, রাপানজেল সময় কাটানোর জন্য তার সুমিষ্ট স্বরে গান গাইছিল। শব্দ অনুসরণ করে রাজকুমার দুর্গ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল বটে, কিন্তু দুর্গে ঢোকার কোনো পথই খুঁজে পেল না। ব্যর্থ মনোরথে সে ফিরে গেল, কিন্তু তার মন পড়ে থাকল সেই দুর্গের কাছে।

তারপর থেকে প্রতিদিনই সেই রাজকুমার দুর্গের কাছে আসে দুর্গে ঢোকার পথ খুঁজতে আর প্রতীক্ষা করে গান শোনার। একদিন যখন সে একটা গাছের আড়াল থেকে দুর্গের দিকে তাকিয়ে ছিল, হঠাৎ দেখল যে একটা ডাইনি বুড়ি দুর্গের নিচে এসে হাঁক ছাড়ল,

‘রাপানজেল, রাপানজেল,
তোমার চুল ঝুলিয়ে দাও,
আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’

তখন রাপানজেল তার চুলের গোছা নিচে ঝুলিয়ে দিল আর ডাইনি বুড়ি সেই চুল বেয়ে দুর্গে ঢুকে গেল।

পরদিন যখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে এসেছে, রাজকুমার দুর্গের নিচে এসে হাঁক দিল,

‘রাপানজেল, রাপানজেল,
তোমার চুল ঝুলিয়ে দাও,
আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’

রাপানজেলও তার চুল ঝুলিয়ে দিল আর রাজকুমার সেই চুল বেয়ে দুর্গে ঢুকে গেল।

রাপানজেল তো রাজকুমারকে দেখে ভয়ই পেয়ে গেল। কারণ, সে ডাইনি বুড়ি ছাড়া কোনো মানুষকে কখনো দেখেনি। তারপর রাজকুমারের নরম গলায় বন্ধুর মতো কথাবার্তায় তার ভয় কেটে গেল। রাজকুমার তাকে বলল যে রাপানজেলের গান তার মনকে ছুঁয়ে গেছে, কীভাবে সে দিনের পর দিন এই দুর্গের বাইরে অপেক্ষা করেছে আর কীভাবে সে জানতে পেরেছে দুর্গে ঢোকার উপায়।

তারপর রাজকুমার যখন বলল যে সে রাপানজেলকে বিয়ে করতে চায়, তখন রাপানজেল ভাবল, এই ডাইনি বুড়ির সঙ্গে সারা জীবন থাকার চেয়ে রাজকুমারকে বিয়ে করা অনেক ভালো। তাই সে রাজি হয়ে গেল। সে বলল, ‘আমি খুশিমনেই তোমার সঙ্গে যেতে রাজি আছি, কিন্তু আমি এখান থেকে নামব কী করে? তার চেয়ে তুমি একটা কাজ করো, তুমি যখন এখানে আসবে, তখন প্রতিবার একটা করে রেশমের সুতা আমার জন্য নিয়ে এসো। আমি সেই সুতা দিয়ে একটা দড়ির মই বানাব। যখন মইটা বানানো হয়ে যাবে, সেই মই বেয়ে নিচে নেমে তোমার সঙ্গে যেতে পারব।’

রাজকুমারের আসা–যাওয়ার বিষয়টা কিন্তু ডাইনি বুড়ি মোটেই খেয়াল করেনি। কিন্তু একদিন রাপানজেল একটা ভুল করে বসল। সে ডাইনি বুড়িকে প্রশ্ন করল, ‘আচ্ছা, তোমাকে তুলতে যত কষ্ট হয়, একটু পরে যে রাজকুমার আসবে, তাকে তুলতে তো অত কষ্ট হয় না!’

রাপানজেলের কথা শুনে তো ডাইনিটা রেগেই আগুন, ‘এ আমি কী শুনছি, অকৃতজ্ঞ মেয়ে কোথাকার! ভেবেছিলাম যে আমি তোমাকে পুরো পৃথিবী থেকে আলাদা করতে পেরেছি, কিন্তু তুমি আমাকে ঠকিয়েছ।’

ডাইনি বুড়িটা এতটাই রেগে গেল যে সে তার বাঁ হাত দিয়ে রাপানজেলের চুলের গোছা খপ করে ধরে ডান হাতে একটা কাঁচি নিয়ে কচ-কচ-কচ করে সব চুল কেটে দিল। তাতেও ডাইনির মন শান্ত হলো না, সে রাপানজেলকে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিল।

সেই দিন সন্ধ্যাবেলায় ডাইনি বুড়িটা রাপানজেলের কেটে রাখা চুলের গোছা একটা হুকের সঙ্গে বেঁধে রাখল। যথারীতি সন্ধ্যাবেলায় রাজকুমার দুর্গের নিচ থেকে হাঁক দিল,

‘রাপানজেল, রাপানজেল,
তোমার চুল ঝুলিয়ে দাও,
আমাকে ভেতরে আসতে দাও।’

তখন ডাইনি বুড়িটা রাপানজেলের কেটে রাখা চুলটা নিচে ঝুলিয়ে দিল আর রাজকুমারও কিছু না বুঝেই সেই চুল বেয়ে ওপরে উঠে এল। ওপরে উঠে রাজকুমার দেখল যে তার প্রিয়তমা রাপানজেলের পরিবর্তে এক ডাইনি কুটিল আর বিষমাখা দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

‘ও…তুমি তাহলে সেই হতচ্ছাড়া, পাজি, নচ্ছার, আমার পাখিটাকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলে! হুহ্! আমিই তোমার পাখিটাকে উড়িয়ে দিয়েছি। সে আর তার ছোট্ট বাসায় বসে তোমাকে গান শোনাবে না। তাকে আমি বিড়ালের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। সেই বিড়াল তোমারও চোখ উপড়ে নেবে। তুমি তোমার রাপানজেলকে হারিয়ে ফেলেছ, তুমি আর কখনোই তাকে দেখতে পাবে না।’

মনের দুঃখে রাজকুমার দুর্গের জানালা দিয়ে নিচে লাফ দিল। নিচের কাঁটাঝোপে পড়ে তার প্রাণটা রক্ষা পেল বটে, কিন্তু তার দুই চোখ কাঁটার আঘাতে নষ্ট হয়ে গেল। অন্ধ হয়ে রাজকুমার বনের মধ্যে ঘুরে বেড়ায় আর রাপানজেলের কথা মনে করে কাঁদে। ক্ষুধা লাগলে গাছের শিকড়-বাকড়, ফলমূল যা পায়, খেয়ে নেয়। আবার বিভ্রান্তের মতো ঘুরে বেড়ায়।

১৯৯৭ সালে লাইবেরিয়া থেকে প্রকাশিত একটি স্যুভেনির শিট

এভাবে অনেক দিন ঘুরতে ঘুরতে রাজকুমার বনের গভীরে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছাল, যেখানে আমাদের রাপানজেল বাস করে। ডাইনি বুড়ি তাড়িয়ে দেওয়ার পর সে–ও বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এখানে এসে একটা কুটির বানিয়েছে। এখানে তার এক জোড়া যমজ সন্তান জন্ম নিয়েছে। তাদের নিয়েই তার সময় কেটে যায়।

কুটিরের সামনে বসে রাপানজেল যখন গান করছিল, তখন সেই শব্দ রাজকুমারের কানে যায়। ‘এ তো আমার খুবই পরিচিত কণ্ঠস্বর!’ রাজকুমার মনে মনে ভাবে আর শব্দ শুনে শুনে শব্দের উৎসের দিকে এগিয়ে যায়। ছিন্নভিন্ন মলিন পোশাক পরা অন্ধ রাজকুমারকে চিনতে রাপানজেলের একমুহূর্তও লাগে না। ছুটে গিয়ে রাজকুমারকে জড়িয়ে ধরে রাপানজেল কেঁদে ফেলে আর তার অশ্রুফোঁটা রাজকুমারের চোখে পড়তেই তার চোখ পরিষ্কার হয়ে যায়, সে আবার সব দেখতে পায়।

তারপর রাজকুমার রাপানজেল ও তাদের দুই সন্তানকে নিয়ে তার রাজ্যে ফিরে যায়, আর তারা সুখে–শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।