বৃষ্টি, কাদা আর ভয়ানক স্রোত ঠেলে যখন হামহাম জলপ্রপাতের কাছে আমরা পৌঁছালাম, তখন প্রায় শেষ বিকেল। প্রায় ১৬০ ফুট উঁচু থেকে যে গতিতে পানি আসছিল, আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম, ওর কাছাকাছি গেলে এবার বোধহয় আস্ত অবস্থায় আর বাড়িতে ফিরতে হবে না। এদিকে হামহাম পৌঁছে আমাদের শক্তি প্রায় শেষ। তোহা আর হাঁটতে পারছে না। আছাড় খেতে খেতে লোরকার অবস্থাও বেশ খারাপ। চারজন যাত্রা শুরু করেছিলাম, এখন রয়েছে তিনজন। আমার পছন্দের শার্টটা বিসর্জন দিয়ে এসেছি ঝিরিপথে নামার আগে বাঁশঝাড়ে ডিগবাজি খেয়ে। যে রাস্তায় এসেছি, রাতের অন্ধকারে সে পথে ফিরে যাওয়ার চিন্তা করলেও হাত–পা অবশ হয়ে আসছে। ফিরে না গেলে এখানের জোঁক, মশা আর ডাঁশমাছি ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। এদিকে আকাশের সূর্য প্রায় ডুবে যাচ্ছে।
প্ল্যান করার সময় সবাই আগ্রহ দেখালেও ট্যুরে যাওয়ার আগে শেষ মুহূর্তে তিন ভাগের দুই ভাগ মানুষ হাওয়া। আমি আর তোহা জেদ ধরে বসে আছি, দুনিয়া রসাতলে গেলেও আমাদের ট্যুরে যাওয়া থেকে কেউ আটকাতে পারবে না। লোরকাও প্রস্তুত আমাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। হুট করে হাজির আলিফও ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে হাজির। ভানুগাছ যাওয়ার জন্য দিনক্ষণ দেখে উঠে পড়লাম ট্রেনে। ঢাকায় ভ্যাপসা গরম, রোদ। আর শ্রীমঙ্গল পৌঁছেই পেলাম একেবারে মুষলধারে বৃষ্টি! মনে মনে অবশ্য আমি কিছুটা খুশিই হলাম হামহামের আসল রূপটা দেখতে পাব বলে। তোহা বেশ চালু। এখানে ওর বুক করে রাখা কটেজে গিয়ে পৌঁছালাম ভোর চারটা বাজে। ঘুমাব না ঘুমাব না করেও যখন ঘুম ভেঙে উঠলাম, তখন বেলা দশটা। দৌড়ে তড়িঘড়ি করে সিএনজি করে কলাবনপাড়া চলে এলাম। এখানে এসে বিপদ! গত রাতে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, এলাকার মানুষও আমাদের যেতে দিতে চাচ্ছে না। পানি নাকি নাকসমান ঝিরিতে, গেলে ভেসেটেসে চলে যেতে পারি আমরা। আমরা যখন দোটানায় ভুগছি, এ সময় লোরকা একটা বাচ্চার কাছ থেকে বাঁশ কিনে নিয়ে মাথার ওপর ঘোরানো শুরু করে দিয়েছে। ভাবটা এমন, ‘হোক নাকসমান পানি, হোক স্রোত, আমি থোড়াই কেয়ার করি। এসব আমার ঢের দেখা আছে।’ ওকে দেখে আমাদেরও সাহস ফিরল। গাইড হিসেবে সঙ্গ দিল সোহেল রানা নামের ১৫ বছরের এক কিশোর। আমরা নিজেরাই এখনো শিশু। এই শিশুকে গাইড হিসেবে নেওয়া যায় কি না, জিজ্ঞেস করতেই এলাকার একজন বলে উঠল, সোহেল কমসেকম ২০০ বার হামহাম জলপ্রপাত ঘুরে এসেছে। সোহেলের বাবা এগিয়ে এসে খাবার প্যাকেট করে দিতে চাইলেন। আমরা এসে শান্তিমতো খাওয়ার জন্য শুধু দুই লিটার পানি নিয়ে রওনা দিলাম। এদিকে জোঁকের প্রচণ্ড উৎপাত। বৃষ্টির দিনে আর জোঁকের কথা জিজ্ঞাসা না করাই ভালো। বনের ভেতর বৃষ্টির পানি যতটা না পড়ে, তার চেয়ে টুপটুপ করে জোঁক পড়ে বেশি। শুনলাম, গায়ে শ্যাম্পু মেখে রাখলে নাকি জোঁক কামড় দেবে না। নিলাম সবাই মিনিপ্যাক। এরপর সোহেলকে নিয়ে রওনা দিলাম হামহামের পথে। আগে ঘোরাঘুরির অভিজ্ঞতা থাকলেও ট্র্যাকিংয়ে প্রথমবার আমাদের। লাফালাফি করতে করতে চলে গেলাম বনের ভেতর। বনে ঢোকার পরপরই তোহার অবস্থা মোটামুটি টাইট। বেচারা জোঁককে যমের মতো ভয় পায়। জোঁকেরাও সেটা হয়তো জানে বলে বারবার ওর সামনে এসে পড়ছে। উঁচু–নিচু টিলা বেয়ে জান কয়লা করে একবার সোহেলকে জিজ্ঞেস করলাম, কীরে ভাই! কদ্দুর আর? সোহেল হেসে ফেলল কথা শুনে, আমরা নাকি যাত্রা মাত্র শুরু করেছি। কথা না বাড়িয়ে পা চালালাম।
পথ শুকনো হলে হয়তো সমস্যা ছিল না। কাদায় ভরা পথে এক পা আগাচ্ছি তো দুই পা পিছিয়ে যাচ্ছি। নিজেকে তখন গণিত বইয়ের সেই বাঁদরের মতো মনে হলো, যে কিনা তেল মাখানো বাঁশে আজীবন উঠেই চলেছে। একটু পরপর পেছন থেকে লোরকার ধুমধাম পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পাচ্ছি। বেচারা বারবার পড়ে গিয়ে নিজেই তুমুল উৎসাহে উঠে আসছে। প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর সামনে মোটামুটি ৫০ ফিটের মতো একটা ঢাল। পথ এখানের স্থানীয় লোকজন কেটে বানিয়ে রেখেছে, কিন্তু দিনের বৃষ্টিতে সেখানে পা ফেলে হাঁটার কোনো উপায় নেই। আমি আগে যাচ্ছি, পেছনে লোরকা, শেষে তোহা আর আলিফ। ভয়ে ভয়ে নামছি। একটু পা হড়কে গেলেই সর্বনাশ। হঠাৎ পেছনে লোরকার চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখি, লোরকা গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছে। তা যাক নাহয়, আমার ঘাড়েই পড়তে আসছে দেখে আমার দম বন্ধ হয়ে গেল। কোনোমতে হাতের বাঁশটা ওর গায়ের নিচে দিয়ে এ যাত্রায় রক্ষা! এদিকে কিছুক্ষণ আগানোর পরপর তোহাকে প্রথমবারের মতো জোঁকে ধরল। আমাদের শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক কাদাপানিতে ধুয়ে চলে গেছে। বুকের সব হাওয়া একেবারে বের করে চলে গেলাম আমরা সবচেয়ে বড় ঢালটার কাছে। এখানে সব সময় একটা দোকান বসে। এখানে বসে চা-কলা খেতে খেতে পাহাড় থেকে বেশ সুন্দর সময় কাটানো যায়। বৃষ্টির কারণে আজ দোকানটাও নেই। ভাবছিলাম এখান থেকে কিছুটা খেয়ে এনার্জি নিয়ে ঢাল বেয়ে নামা শুরু করব। সেটা আর সম্ভব নয়৷ এদিকে আলিফ গাঁইগুঁই করা শুরু করেছে। সে আর যাবে না আমাদের সঙ্গে। তার বেশ শিক্ষা হয়েছে নাকি। যে কটা আছাড় খেয়েছে ছোট ঢালগুলোতে, এর চেয়ে বড় কোথাও ধাক্কা খেয়ে মরে যাওয়ার ভয়ে ফিরতি একটা দলের সঙ্গে আগেই কেটে পড়ল আলিফ। এমনিতেই ছোট দল, তার ওপর একজনকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা আরও খারাপ। কিছু করার নেই। সোহেল আমাদের দেখে মিটিমিটি হাসে। এই ঢালটা কেউ বলে তিন শ ফুট, কেউ বলে দেড় শ ফুট। সোহেলের ভাষায় তিন শ মিটার! কত উঁচু সেটা, দেখতেই আমরা আবার শুরু করলাম যাত্রা। যতটা ভয়ানক ভেবেছিলাম, এটা তার চেয়ে অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ পথ! পাহাড়ি ছাগলের মতো তরতর করে সোহেল এগিয়ে গেলেও আমরা বারবার গড়িয়ে যাচ্ছি, বাঁশ ধরে উঠে বসছি, আবার পড়ছি। তা–ও যেন শেষ হয় না পথ। হঠাৎ শেষের দিকে পা হড়কে আসলেই পড়ে গেলাম আমি। সামনে পড়তে পড়তে দেখি একটা চোখা বাঁশ। এটার ওপর পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু। কোনোমতে হাতের বাঁশে ঠেস দিয়ে সরে গেলেও মোটামুটি পিঠকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়ে শার্টটা ছিঁড়ে ফেলে নিচে এসে পড়লাম। কাদায় পড়ার কারণে চোট তেমন লাগেনি। সামনে স্রোত আর পানির সেই হামহামের বয়ে যাওয়া পানির ঝিরি। কোনোমতে নেমে হাঁটা শুরু করলাম আমরা। পিচ্ছিল দেখে যে জায়গাগুলো এড়িয়ে যাচ্ছিলাম, সোহেল সে জায়গাগুলো দিয়েই দৌড়ে দৌড়ে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরেই হঠাৎ দেখি পানির পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাপারটা সুবিধার নয়। যে হারে বাড়ছে, এভাবে বাড়তে থাকলে ভেসে চলে যাব, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। হাঁচড়েপাঁচড়ে আরও মিনিট বিশেক যাওয়ার পর দেখি সামনে কুয়াশা। সোহেল আশ্বাস দিল সামনের মোড়টা পার হলেই কাঙ্ক্ষিত সেই হামহাম। এখান থেকেও জলে সজোরে আছড়ে পড়ার শব্দ বেশ শোনা যাচ্ছিল। অবশেষে পৌঁছালাম। এখানে এসে আমাদের চোখ ছানাবড়া! কে জানে কোত্থেকে এত পানি আসছে, এসে আছড়ে পড়ছে। চারদিকে পাথর আর মাঝখানে ওপরে আকাশ। ভীষণ সুন্দর বললেও হয়তো কম হয়ে যায়। এদিকে প্রায় সন্ধ্যা হতে চলল। আশপাশে আমরা বাদে অন্য কোনো অভিযাত্রী নেই।
পুরো বনে হয়তো আমরা এই চারজন। দম আমাদের ফুরিয়ে গেছে বহু আগেই। মনের জোরে যদি ফিরতে পারি, এই ভেবে সোয়া পাঁচটায় আবার ফেরার পথ ধরলাম। ফেরার পথে কোনোমতে দৌড়ে আছাড় খেয়ে ডুবে গিয়ে তিনবার ঝিরির পানি খেয়ে ঢালের ওপর ফিরলাম। এখানে এসে যা শক্তিও অবশিষ্ট ছিল, তা–ও শেষ। দুই লিটারের একটা পানির বোতল নিয়ে এসেছিলাম আমরা। বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। আর সর্বনাশের মাথায় বাড়ি হিসেবে আমার বাঁশের লাঠিটাও ঝিরির স্রোতে ভেসে গেছে। গায়েও প্যান্ট ছাড়া কিছুই নেই। সোহেল বলল, আমাদের নিয়ে এবার যে ঝামেলায় পড়েছে, এমন ঝামেলায় আগে কোনোবার সে পড়েনি। কিছুটা অপমানিত বোধ হওয়ার কারণেই আবার জোরে পা চালালাম। কিছুক্ষণ যাওয়ার পর আবিষ্কার করলাম সবাই আগে চলে যাচ্ছে। আমার হাতে লাঠি না থাকায় বারবার বেশি পিছলে যাচ্ছি। পড়তে পড়তে এখন এমন অবস্থা, হাঁটার সাহস পাচ্ছি না। হাঁটতে গেলেই ভয় হচ্ছে পড়ে যাব। ওদিকে লোরকা আর তোহা ডাকছে অনেক দূর থেকে। আওয়াজ করারও সাহস পাচ্ছি না। সূর্য তো কবেই ডুবে গেছে। আকাশে কেন জানি তাকিয়ে দেখলাম মাথার ওপর বেশ বড়সর একটা চাঁদ। বনের মধ্যে চাঁদের আলোয় অশরীরী একটা পরিবেশ তৈরি হয়ে আছে। আমি মশার কামড় খেতে খেতেই ভাবছি, এখানে থেকে গেলে কেমন হয়! কোত্থেকে সোহেল দৌড়ে এসে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে চলল। সোহেলকে যতই জিজ্ঞাসা করি কীরে ভাই কদ্দুর? ও বলে, আর মাত্র পাঁচ–ছয়টা টিলা। পাঁচ–ছয়টা টিলা পার হওয়ার পরে আবার জিজ্ঞাস করলেও বলে, পাঁচ–ছয়টা এখনো বাকি। সময় জিজ্ঞাস করলেও বেচারা বলে বিশ মিনিট। এই বিশ মিনিট শেষ হয় না দেখে শেষে জিজ্ঞেস করাই ছেড়ে দিলাম। তিন ঘণ্টা অন্ধকারে আছাড়, ডিগবাজি আর ডজনখানেক জোঁকের কামড় খেয়ে একসময় দেখি বন থেকে বের হয়ে গেছি। এত আশ্চর্যজনকভাবেই বের হয়ে গেছি যে নিজেরও বিশ্বাস করতে বেশ কষ্টই হচ্ছিল। আলিফ টেনশনে ঘেমে নেয়ে উঠেছে পুরো। সোহেল পথ দেখিয়ে ওর বাবার দোকানে নিয়ে বসিয়ে দিল। তিনি চমৎকার রান্না করেন। দেশি মোরগের মাংস, আলু আর চা–পাতার ভর্তা, সবজি আর ডাল। খাবার সময় টের পেলাম ভালো রকম ক্ষুধা পেয়েছিল। আর এত সুস্বাদু রান্না হলে কে আর অপেক্ষা করে৷ খাওয়াদাওয়া শেষ করে যখন কটেজে ফিরলাম, তখনো আমাদের শরীর উত্তেজনায় কাঁপছে। পরের দিন মাধবপুর লেেক গিয়ে পাহাড় দেখে যখন ঢাকায় ফিরলাম, তখনো আমরা ক্লান্ত। তবে প্রকৃতির লীলা যা এবার দেখে এসেছি, বেশ বোঝা হয়েছে, এখনো যে কত কিছু দেখা বাকি! সময় পেলেই আবার বের হয়ে যেতে হবে। অনেক কিছু দেখতে হবে।