কনকনে শীতের রাত। ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে আছেন লোকটি। একা। রাতের আলো-আঁধারির মতো হতাশায় জবুথবু ভাব তাঁর চোখে-মুখে। হাতের মুঠোয় ধরা একতাড়া কাগজ। নিজের লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। আগুনে ছুড়ে ফেলার আগে শেষবারের মতো উল্টে-পাল্টে দেখছেন। উপন্যাসটি লেখার পর অনেক প্রকাশকের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন। কিন্তু এমন উদ্ভট কাহিনি কেউ ছাপতে রাজি নন। হাজারো পাঠকের হাতে তাঁর বই শোভা পাওয়ার সুখস্বপ্ন মুকুলেই ঝরে গেছে। রাগে-দুঃখে অনেকটা বাধ্য হয়ে সর্বগ্রাসী আগুনই পাণ্ডুলিপিটির শেষ গন্তব্য হিসেবে বেছে নিয়েছেন তিনি।
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে একটু দ্বিধা নিয়ে অবশেষে আগুনেই ছুড়ে দিলেন পাণ্ডুলিপিটি। এখন অপেক্ষা শুধু কয়েক সেকেন্ডের। দাউ দাউ আগুনে এক লহমায় পুড়ে ছাই হবে তাঁর সাধের প্রথম উপন্যাসটি। সেই সঙ্গে হয়তো অপমৃত্যু ঘটবে তাঁর লেখকসত্তারও। করুণ চোখে সেই ঐতিহাসিক দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তুত হলেন লেখক।
কিন্তু মানুষের পরিকল্পনামাফিক কি আর সব হয়! ঘটনা টের পেয়ে কোথা থেকে যেন ছুটে এলেন এক নারী। লেখকের স্ত্রী তিনি। লেলিহান শিখা থেকে পাণ্ডুলিপিটি তুলে আগুন নিভিয়ে দিলেন ঝটপট। একটুর জন্য সেদিন বেঁচে গেল বিখ্যাত একটি লেখা।
এরপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত। লেখকের স্ত্রী নিজেই এক প্রকাশকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ছাপার ব্যবস্থা করলেন পাণ্ডুলিপিটি। ১৮৬৩ সালে ফ্রান্সের প্যারিসে বইটি প্রকাশিত হলো কিংক সিমেইনস এন বেলুন শিরোনামে। দুঃসাহসী অভিযানের সেই উপন্যাস পরে ইংরেজিতে অনুবাদ হয় ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন (বাংলায় বেলুনে পাঁচ সপ্তাহ) শিরোনামে। বইটির মাধ্যমেই লেখক হিসেবে আত্মপ্রকাশ হয় ফরাসি লেখক জুল ভার্নের। সে–ই ছিল শুরু। এরপর একে একে লিখতে থাকেন টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি, আ জার্নি টু দ্য সেন্টার টু দ্য আর্থ, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটটি ডেজ, মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ডসহ অসংখ্য অ্যাডভেঞ্চার আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনি। তাতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে থাকে তাঁর নাম। উভচর মানুষ (অ্যাম্ফিবিয়ান ম্যান)–খ্যাত রুশ লেখক অ্যালেকজান্ডার বেলায়েভও জুল ভার্নের কাহিনি পড়েই বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লিখতে শুরু করেছিলেন। শুধু তা–ই নয়, বেলায়েভকে বলা হয় রাশিয়ার জুল ভার্ন। নামকরা বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক রে ব্র্যাডবেরি একবার বলেছিলেন, ‘আমরা সবাই কোনো না কোনোভাবে জুল ভার্নের সন্তান।’ এভাবেই লাখো পাঠককে মন্ত্রমুগ্ধ করার পাশাপাশি আরও অনেক লেখকের অনুপ্রেরণার উৎস তিনি। কাজেই জুল ভার্নকে যে বিজ্ঞান কল্পকাহিনির অন্যতম জনক বলা হবে, তাতে আর বেশি কী!
ভার্নের লেখায় কল্পবিজ্ঞানের সঙ্গে থাকে টানটান অ্যাডভেঞ্চার আর রহস্যের মিশেল। কাহিনির পাত্র–পাত্রীরা দূরদূরান্তের দুর্গম গিরি, কান্তার মরু পেরিয়ে চলে যায় দেশ-দেশান্তরে, কখনোবা ছুটে বেড়ায় সাগরতলে, কিংবা নির্জন দ্বীপে, তুষারে ঢাকা সুদূর মেরুতে, কেউবা ছোটে পৃথিবী ছাড়িয়ে চাঁদের পানে। কিন্তু ভার্ন এসব অঞ্চলের এমন বিশদ আর বিশ্বস্ত বিবরণ দিতেন যে তা পড়ে মনে হয়, নিজের চোখে দেখে লেখা। মজার ব্যাপার হলো, অধিকাংশ জায়গাতেই কখনো পা মাড়াননি তিনি। জীবনের শুরুতে অনেক জায়গায় ঘুরেছেন। কিন্তু বয়সকালে দৈহিক অসুস্থতা ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। তাই আক্ষরিক অর্থেই তিনি ছিলেন চিলেকোঠার সেপাই। তাঁর সেই চিলেকোঠায় থরে থরে সাজানো থাকত দেশ-বিদেশের মানচিত্র আর পত্রপত্রিকা। সেসব ঘেঁটেঘুঁটে, কল্পনার পাখা মেলে লিখতেন একেকটি উপন্যাস। তাই কোনো জায়গার নাম বা বিবরণে ভুল হতো না। অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে তাঁর সঙ্গে তুলনা চলে বাংলা ভাষায় লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিভূতিও আফ্রিকার পটভূমিতে তাঁর চাঁদের পাহাড় উপন্যাসটি লিখেছিলেন স্রেফ কল্পনায় ভর করে। অথচ ভার্নের মতো তিনিও কখনোই আফ্রিকায় যাননি। সেখানকার মানচিত্র আর পত্রপত্রিকায় লেখা বিভিন্ন এলাকার বিবরণ পড়ে লিখেছিলেন ওরকম আস্ত একটা অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস।
এই জুল ভার্নই ১৮৬৫ সালে লিখলেন আরেক অভিনব উপন্যাস। নাম ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন (ফরাসি ভাষায় দে লা টেরে আ লা লুনা)। সে যুগে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ব্যবহার করে সবে জলপথে জাহাজ আর স্থলে মোটরগাড়ি চলা শুরু হয়েছে। অনেক জায়গাতে রেলপথও বসেনি। অধিকাংশ জায়গায় তখনো ঘোড়া আর ঘোড়ার গাড়ি বা পালতোলা নৌকা-জাহাজই একমাত্র সম্বল। বর্তমানের কোনো প্রযুক্তির কথা ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি মানুষ। অথচ সেই যুগে বসে, মানে আজ থেকে ১৫৪ বছর আগে, তাঁর উপন্যাসে রকেটে করে তিন নভোচারীকে সোজা চাঁদে অভিযানে পাঠালেন জুল ভার্ন। কতটা দূরদৃষ্টি থাকলে সেই যুগে রকেটের কথা ভাবা যায়? কিংবা চাঁদে অভিযানের কথা ভাবা যায়?
তাঁর ভাবনার ১০৪ বছর পর সত্যি সত্যিই চাঁদে মানুষ পাঠাতে পেরেছিল পৃথিবীবাসী। সেটা ছিল ১৯৬৯ সালের ১৯ জুলাই। এরপরের ঘটনা তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানি না, জুল ভার্নের উপন্যাসের সেই চাঁদে অভিযানের সঙ্গে বাস্তবের অভিযানের রয়েছে অনেক মিল। সেটাই একটু খুলে বলা যাক।
উপন্যাসটির পটভূমি আমেরিকান গৃহযুদ্ধের কিছুদিন পরের। বাল্টিমোর গান ক্লাবের সদস্যদের হাতে তখন কোনো কাজ নেই। ভীষণ আলস্য ও বিরক্তিতে হাত-পায়ে খিল ধরে যাওয়ার জোগার একেকজনের। এ সময় ক্লাবের প্রেসিডেন্ট ইম্মে বারবিকানের উর্বর মস্তিষ্কে নতুন এক আইডিয়া গজিয়ে উঠল। ভাবনাটি রীতিমতো ডালপালাও মেলে দিল। সে এমন এক কামান বানানোর কথা ভাবল, যা থেকে বিশাল আকৃতির কোনো গোলা ছুড়লে তা পৃথিবীতে না ফিরে সরাসরি চাঁদে পৌঁছে যাবে। অভিনব এই পরিকল্পনার কথা শুনে উত্তেজনার চোটে ক্লাবের সদস্যরা বেশ খানিকটা নড়েচড়ে বসল। অনেক দিন পর মনের মতো একটা কাজ পেল তারা। তাই সেটি বাস্তবায়নে তারা কাজও শুরু করল শিগগিরই।
বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিল, গোলা নিক্ষেপের স্থানটি হতে হবে বিষুব রেখার কাছাকাছি। অনেক খুঁজে খুঁজে তেমন একটি জায়গা খুঁজে পাওয়া গেল, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায়। সেখান থেকেই তিন নভোচারীকে নিয়ে মহাশূন্যে উঠে গেল গোলাটি, মানে কলাম্বিয়াড নামের নভোযানটি। এদের দুজন ইম্মে বারবিকান ও ক্যাপ্টেন নিকোল মার্কিন নাগরিক আর আদ্রান (আঁদা) ফরাসি। তারপর পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে সেটি পৌঁছে গেল চাঁদের কক্ষপথে। বাস্তবে নিল আর্মস্ট্রংরা চাঁদের মাটিতে পা রাখলেও জুল ভার্নের উপন্যাসের নায়কেরা চাঁদের মাটিতে পৌঁছাতে পারল না। আসলে গোলা ছোড়ার হিসাব-নিকাশে একটু ভুলের কারণেই সেটি সম্ভব হলো না। একসময় চাঁদের মহাকর্ষ কাটিয়ে তারা আবার পৃথিবীর দিকে ফিরে আসতে পারে। সব শেষে প্রশান্ত মহাসাগরে সজোরে আছড়ে পড়ে নভোচারীদের ক্যাপসুল। মার্কিন নৌবাহিনী তাদের উদ্ধার করে আনে। এসব ঘটনা লেখা আছে ভার্নের ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন এবং উপন্যাসটির সিক্যুয়াল অ্যারাউন্ড দ্য মুন উপন্যাসে।
এবার দেখা যাক, নাসার অ্যাপোলো-১১ মিশনের সঙ্গে কেমন মিল রয়েছে জুল ভার্নের উপন্যাসের চন্দ্র অভিযানের। সবাই জানি, অ্যাপোলো-১১ মিশনে নভোচারী ছিলেন তিনজন—নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অলড্রিন আর মাইকেল কলিন্স। ভার্নের উপন্যাসের নভোচারীর সংখ্যাও একই। ভার্নের কামানের গোলা বা নভোযানটির নাম ছিল কলাম্বিয়াড। আর নিল আর্মস্ট্রংদের কমান্ড মডিউলের নাম রাখা ছিল কলাম্বিয়া। এ কী শুধু কাকতাল! এটুকুই নয়, উপন্যাসে জুল ভার্ন বর্ণিত সিলিন্ডার আকৃতির অ্যালুমিনিয়াম গোলার (ক্যাপসুল) উচ্চতা ছিল ৪ দশমিক ৫ মিটার এবং ব্যাস ২ দশমিক ৭ মিটার—তিনজন নভোচারীর আশ্রয়ের জন্য যথেষ্ট। অ্যাপোলো-১১-এর কমান্ড মডিউলটির উচ্চতা ছিল ৩ দশমিক ২ মিটার এবং ব্যাস ৩ দশমিক ৯ মিটার। আবার দুই ক্ষেত্রেই রকেট উৎক্ষেপণের জায়গাটির মধ্যেও মিল আছে বেশ। ভার্ন তাঁর নায়কদের উৎক্ষেপণের জায়গা বেছে নেন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার ২৭ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশ। এখান থেকে মাত্র ২২৫ কিলোমিটার দূরে কেপ কেনেডি এলাকাটিকে বেছে নেওয়া হয় অ্যাপোলো-১১-এর উৎক্ষেপণের জন্য। কাজেই দেখা যাচ্ছে, শুধু দেশই নয়, খোদ উৎক্ষেপণের জায়গার সঙ্গেও মিল আছে দুই দলের।
ভার্ন তাঁর নভোযানের দিক ঠিক করেছিলেন অ্যাপোলো-১১-এর মতো করেই। মানে চাঁদে পৌঁছানোর সময় চাঁদটির ভবিষ্যৎ অবস্থানের দিকে তাক করা হয় কলাম্বিয়াডকে। নভোযানটি মহাশূন্যে উৎক্ষেপণের গতিবেগ তিনি নির্ধারণ করেন সেকেন্ডে ৩৬ হাজার ফুট বা ১০ হাজার ৯৭২ মিটার। অন্যদিকে ভূমি থেকে উৎক্ষেপণের পর অ্যাপোলো-১১-এর তৃতীয় পর্যায়ের ইঞ্চিনের গতিবেগ ছিল সেকেন্ডে ৩৫ হাজার ৫৩৩ ফুট। ভার্নের ক্যাপসুল চাঁদে পৌঁছাতে লাগে ৯৭ ঘণ্টা ১৩ মিনিট ২০ সেকেন্ড। আর অ্যাপোলো-১১-এর লেগেছিল ১০৩ ঘণ্টা, ৩০ মিনিট।
জুল ভার্নের ক্যাপসুল তিন নভোচারীকে নিয়ে চাঁদের কক্ষপথে বেশ কয়েকবার পাক খেয়েছিল। চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় একই দূরত্বে থাকা ওই কক্ষপথে অ্যাপোলো-১১-এর কমান্ডশিপটি নিয়ে ঘুরেছিলেন মাইকেল কলিন্স। দুই দলই মহাশূন্যে ওজনহীনতার মুখোমুখি হয়েছিল। তুলেছিল চন্দ্রপৃষ্ঠের প্রচুর ছবি। এমনকি ভার্নের নভোচারী নায়কেরা চন্দ্রপৃষ্ঠের মানচিত্রও এঁকেছিল। বলতে গেলে, সেই জায়গাতেই ১০৪ বছর পর মানুষের প্রথম পদচিহ্ন এঁকে দেন নিল আর্মস্ট্রং। আবার দুই দলেরই পৃথিবীতে ফিরে আসার ঘটনায় বেশ মিল আছে। চন্দ্রজয়ের পর পৃথিবীতে ফেরার পথে সে কারণেই নিল আর্মস্ট্রং বলেন, ‘এক শ বছর আগে, চাঁদে অভিযান নিয়ে একটি বই লিখেছিলেন জুল ভার্ন। তাঁর নভোযান কলাম্বিয়াড ফ্লোরিডা থেকে উৎক্ষেপিত হয়। এরপর চন্দ্র অভিযান শেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরে নেমেছিল। এই অভিযাত্রীদের কিছু বিষয় আপনাদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া উচিত বলে মনে করছি। কারণ, বর্তমানের কলাম্বিয়াও আগের মতোই আগামীকাল আবার পৃথিবীর সঙ্গে এবং সেই প্রশান্ত মহাসাগরে মিলিত হবে।’ বলাই বাহুল্য, অ্যাপোলো মিশনের অভিযাত্রীরা প্রশান্ত মহাসাগরের বুকেই নেমেছিলেন।
জুল ভার্নেরও আরও আগে থেকে চাঁদে অভিযান নিয়ে গল্প-উপন্যাস লেখা শুরু হয়েছিল। যেমন খ্রিষ্টপূর্ব ৭৯ সালে গ্রিক লেখক লুসিয়ান লিখেছিলেন ট্রু হিস্ট্রি। তবে তাতে বৈজ্ঞানিক সত্যের আশা করা বাতুলতা। এরপর জার্মান জ্যোতির্বিদ জোহানেস কেপলার লেখেন সোমনিয়াম নামের এক উপন্যাস। কেপলারের এ লেখায় চাঁদের জীবজন্তুর দেখা মেলে। চাঁদ নিয়ে প্রথম কিছুটা বিজ্ঞানসম্মত লেখার শুরু হয় অ্যাডগার অ্যালান পোর হাতে, ১৮৩৫ সালে। চন্দ্র অভিযান নিয়ে তিনি লেখেন ‘দ্য আনপ্যারালালড অ্যাডভেঞ্চার অব ওয়ান হ্যান্স পিফল’ নামের একটি ছোটগল্প। তবে ওই গল্পের পাত্র–পাত্রীরা চাঁদে পৌঁছায় বেলুনে চেপে। এর তিন বছর পর মঞ্চে এলেন রূপকথার রাজপুত্র হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন। কোনো নভোযানের ধার ধারলেন না তিনি। রূপকথার মতো স্রেফ জাদুর জুতো পরিয়ে চাঁদের দেশে পাঠিয়ে দিলেন গল্পের নায়ককে।
এর ২৫ বছর পর চন্দ্র অভিযান নিয়ে কলম ধরেন জুল ভার্ন। তারপরও এইচ জি ওয়েলস লেখেন দ্য ফার্স্ট ম্যান ইন দ্য মুন। কিন্তু সমসাময়িকদের তুলনায় ভার্নের কল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞান ও বাস্তবের অনেক বেশি মিল পাওয়া যায়। কিন্তু কেন? সত্যিকার চন্দ্র অভিযানের ১০৪ বছর আগে জুল ভার্ন এতটা সঠিক ভবিষ্যদ্বাণী কীভাবে করলেন? তিনি কি জ্যোতিষী ছিলেন? নাকি তাঁর কোনো অলৌকিক ক্ষমতা ছিল? নাকি কোনো টাইম ট্রাভেলার ছিলেন তিনি? আসলে এর কোনোটাই নয়। কল্পনাশক্তি আর বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখায় তাঁর দক্ষতা ছিল অসাধারণ। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে বাষ্পীয় ইঞ্জিন ও অন্যান্য যন্ত্রপাতির ব্যবহারের কারণে ভবিষ্যতের বিশ্ব যে বদলে যাবে, সেটা বুঝতে পেরেছিলেন গুটি কয়েকজন। এই বুঝদার দলেরই একজন ছিলেন জুল ভার্ন। সে যুগের সব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার বা উদ্ভাবন সম্পর্কে তিনি বেশ ভালোই খোঁজখবর রাখতেন। সে জন্যই সাবমেরিন উদ্ভাবনের অনেক আগে টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি উপন্যাসে তিনি সাবমেরিনের কথা লিখতে পেরেছিলেন। আবার রকেট মিসাইল বা স্যাটেলাইটসহ ভবিষ্যতের আরও যন্ত্রপাতির কথাও দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেরেছিলেন তিনি।
চাঁদ নিয়ে তাঁর উপন্যাসের সঙ্গে বাস্তবের এত মিলের কারণ হলো, তিনি পদার্থবিদ্যার সূত্র ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর নির্ভর করেছিলেন। ধরেই নেওয়া যায়, চাঁদে অভিযানের গতিপথ, রকেটের প্রয়োজনীয় বেগ হিসাব করতে নিউটনের মহাকর্ষ ও গতির সূত্রগুলো ব্যবহার করেছেন তিনি। তাই অ্যাপোলো নভোযানের বেগের সঙ্গে তাঁর কল্পনার নভোযানের বেগসহ অন্যান্য বিষয়ে এত মিল। অ্যাপোলো নভোযান পৃথিবীর মহাকর্ষের টান কাটিয়ে মহাকাশে পৌঁছেছিল আধুনিক প্রযুক্তি কাজ লাগিয়ে। সেখানে ভার্ন কাজে লাগিয়েছিলেন স্রেফ তাঁর ক্ষুরধার কল্পনাশক্তি।
ভার্নের কল্পনাতেও অনেক ভুল ছিল। যেমন তাঁর নায়কেরা নভোযানের ভেতর খাটে শুয়ে-বসে আরামেই চাঁদের দিকে যাত্রা করেছিল। তাদের সফরসঙ্গী ছিল দুটি পোষা কুকুর। এদের মধ্যে একটা পথে মারাও যায়। তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থাও ছিল বেশ ভালো। খাওয়ার জন্য ৬টি মুরগি নেওয়া হয়েছিল। সেগুলো কেটেকুটে নভোযানের ভেতরে গ্যাসের চুলায় রান্না করা হয়েছিল। হিসাবের ত্রুটির কারণে ভার্নের নায়কেরা চাঁদে নামতে পারেনি। সেটা সৌভাগ্যই বলতে হবে। কারণ, নিল আর্মস্ট্রংদের মতো এত সুরক্ষিত স্পেসস্যুট তাদের ছিল না। কাজেই বাতাস বা অক্সিজেনহীন চাঁদের মাটিতেই নেমেই তাদের অক্কা পেতে হতো। এ রকম আরও অনেক বৈজ্ঞানিক ত্রুটি রয়ে গেছে ভার্নের উপন্যাসে। তারপরও অনেকের ধারণা, অ্যাপোলো অভিযানে নানাভাবেই অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে তাঁর উপন্যাস দুটি। তাই চন্দ্র অভিযান নিয়ে, অ্যাপোলোর সাফল্য নিয়ে যত দিন আলোচনা চলবে, তত দিন অনিবার্যভাবে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবেন জুল ভার্ন আর তাঁর লেখা ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন।