জুল ভার্নের কল্পনায় বাস্তবের দুনিয়ায়

কথায় বলে, আজ যা কল্পনা তা নাকি আগামীর বাস্তবতা। আর সবাই কি কল্পনা করতে পারে? না, কেউ কেউ পারে। যারা পারে তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জুল ভার্ন। ১৮৫০ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ৫৫ বছরের সাহিত্যজীবনে পৃথিবীবাসীকে তিনি উপহার দিয়েছেন টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, দ্য মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ডসহ অজস্র কল্পবিজ্ঞান কাহিনী।

তিনি লেখায় এমন সব কল্পনার কথা লিখে গেছেন, যা একসময় ছিল কল্পনা, অলীক-ধাঁধা, সময়ের পরিক্রমায় সেই সব ধাঁধা এখন বাস্তব। জুল ভার্নের কল্পনার তেমনি কিছু বাস্তব উদ্ভাবনের গল্প চলো শোনা যাক এবার।

ইলেকট্রিক সাবমেরিন নটিলাস

ফ্রান্সে ১৮৬৩ সালে প্রথম সাবমেরিন তৈরি হয়। সেই সাবমেরিন বাতাসের সাহায্যে চলত। ১৮৬৭ সালে স্প্যানিশ প্রকৌশলী নারসিস মনটুরিওল ইঞ্জিনের সাহায্যে সাবমেরিন তৈরি করেন, যা কিনা পানির নিচে দুই ঘণ্টা থাকতে পারত। সেই সময় প্রকৌশলীরা বাষ্প-বাতাসনির্ভর সাবমেরিন তৈরি করতেন। এরপর ১৮৮৮ সালে বৈদ্যুতিক সাবমেরিন চালু করার চেষ্টা করেন। সেই সাবমেরিন প্রকল্প অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যায়। একই সালে ফরাসি নৌবাহিনী জিমনোট নামের একটি সাবমেরিন তৈরি করে, যা ২০৪টি ব্যাটারির মাধ্যমে চলত। বাস্তবের দুনিয়ার ১৮ বছর আগে অর্থাত্ ১৮৭০ সালে ইলেকট্রিক্যাল সাবমেরিনের কথা লেখেন জুল ভার্ন। টোয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি উপন্যাসে ক্যাপ্টেন নিমোর ছিল এক তিমি আকারের সাবমেরিন। নটিলাস নামের সেই সাবমেরিন পুরোটাই বিদ্যুতে চলত। আর সেই সাবমেরিনেও আধুনিক সাবমেরিনের মতো ডাইনিং রুম, রিডিং রুমসহ সব সুবিধা ছিল। ইলেকট্রিসিটি বা বিদ্যুতের মাধ্যমে যে যানবাহন চলতে পারে, সেই কথাও জুল ভার্ন লিখে রেখে গেছেন ১৮৭০ সালে।

সৌর পাল

১৮৬৫ সালে জুল ভার্ন ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন লেখায় পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়ার এক যন্ত্রের কথা জানান। মানুষ সেই গল্পে সৌরচালিত পালের মাধ্যমে নভো খেয়াযান দিয়ে পৃথিবী থেকে চাঁদে যাওয়ার পরিকল্পনা করে। ২০১০ সালে জাপান প্রথম এমন একটি সৌর পাল মহাকাশে উেক্ষপণ করে। নাসাসহ বিভিন্ন মহাকাশ গবেষণা সংস্থার মতে জুল ভার্নের ভিন্নমাত্রিক আগ্রহ তাঁর কল্পনাকে বিস্তৃত করে দিয়েছে। এ জন্য তাঁকে কল্পনার জাদুকরও বলা যায়।

চন্দ্র যেতে লুনার মডুলাস

মানুষের চাঁদে পা রাখার কয়েক যুগ আগে জুল ভার্ন চন্দ্র জয়ের জন্য এক অদ্ভুত যানের কথা লিখেছিলেন। সেই যানটি ছিল কোনাকৃতির। অনেকটা এখনকার নাসার রকেটগুলোর মতো। জুল ভার্ন এগুলোর নাম দিয়েছিলেন ‘প্রোজেক্টাইল’, যার মাধ্যমে চন্দ্র-পৃথিবীতে আসা-যাওয়া করা যাবে। সেই যান চালানোর জন্য জুল ভার্ন বিশাল এক যন্ত্রের পরিকল্পনা করেন, যা প্রোজেক্টাইলকে অভিকর্ষের বাধা পেরিয়ে পৃথিবীর বাইরে নিক্ষেপ করবে।

আকাশে বিজ্ঞাপন: স্কাইরাইটিং

ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯ বইয়ে জুল ভার্ন অ্যাটমস্ফোরিক অ্যাডভ্যার্টাইজমেন্ট নামে বিশেষ একধরনের বিজ্ঞাপন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করেন। সেই পদ্ধতিতে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন আকাশে লেখার ব্যবস্থা থাকবে। ভার্ন লিখেছেন, মেঘের নিচে ভাসমান সেই বিজ্ঞাপন সবার চোখে পড়তে বাধ্য থাকবে। শহরের মানুষেরা সবাই সেই বিজ্ঞাপন দেখতে পারবে। সেই লেখার ২৫ বছর পরে ১৯১০ দশকে প্রথম বিমানের সাহায্যে আকাশে লেখার চেষ্টার খবর পাওয়া যায়। ১৯৪০ দশকে পেপসি আকাশে বিজ্ঞাপন লেখা প্রচার শুরু করে।

ভিডিও কনফারেন্সিং

২৮৮৯ সালে ফোনোটেলিফোটোর মাধ্যমে মানুষ দূর থেকে কথা বলতে পারবে। এই পদ্ধতিতে তারের মাধ্যমে যুক্ত আয়না দিয়ে ছবি  প্রেরণ করা হবে। ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯ লেখার এক শ বছর বছর পরে ১৯৯০ দশকের পরে ইয়াহু মেসেঞ্জার, স্কাইপের মাধ্যমে আমরা হরহামেশাই ভিডিও কনফারেন্সিং করে কথা বলা শুরু করি। ১৯৬০ দশকে বিভিন্ন মহাকাশ মিশন টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা শুরু হয়। জুল ভার্ন তারও ৭০ বছর আগে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে কথা বলার ধারণা দিয়ে যান।

নভোযান অবতরণ

১৯৫০ সালের পর থেকে মহাকাশ ফেরত নভোযানগুলোকে বেলুনের মাধ্যমে সমুদ্রে অবতরণ করানো হতো। ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন-এর গল্পে চাঁদ থেকে পৃথিবীতে আসা নভোযানগুলো সমুদ্রে অবতরণের কথা জানান জুল ভার্ন। ১৮৬৫ সালে লেখা হয় এই উপন্যাস, তারও ১০৪ বছর পরে ১৯৬৯ সালে মানুষ চন্দ্র জয় করে। অ্যাপোলো ১১ নভোযান পৃথিবীতে বেলুনের সাহায্যে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে।

হেলিকপ্টার

রোবার দ্য কনকুয়েরার উপন্যাসে বিশেষ একটি যন্ত্রযানের কথা লেখেন জুল ভার্ন। সেই যানটি পাখার সাহায্যে চলে। সেই সময় হেলিকপ্টার তৈরির ধারণা প্রচার হলেও সব হেলিকপ্টার কয়লার মাধ্যমে চালানোর ধারণা ছিল, জুল ভার্ন প্রথম বৈদ্যুতিক ব্যাটারির মাধ্যমে সেই যান চলার ধারণা দেন।

টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার ও টক শো

১৯২০-৩০ দশকে প্রথম টেলিভিশন উদ্ভাবনের খবর জানা যায়। ১৯৩০ দশকে লয়েল থমাস প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে সংবাদ উপস্থাপন করেন। শুরুতে ডব্লিউএনবিটি চ্যানেলে সেই সংবাদ প্রচার হতো কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ১৯৪১ সালে দিনে দুবার করে নিয়মিত সংবাদ প্রচার শুরু হয় টেলিভিশনে। এরও ৫১ বছর আগে টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার আর উপস্থাপনার কথা জানা যায় জুল ভার্নের লেখা থেকে। ইন দ্য ইয়ার ২৮৮৯ বইয়ে জুল ভার্ন ভবিষ্যতে সংবাদপত্রের বিকল্প হিসেবে লেখেন, ‘তখন মানুষ এমন উপায়ে সংবাদ দেখবে, যা প্রতিদিন সকালে মানুষকে সংবাদ দেখাবে। সেই সংবাদ অনুষ্ঠানে সাংবাদিক রাজনীতিবিদ আর বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলাপ-আলোচনা করবেন।’ সেই লেখার ধারাবাহিকতায় বলা যায়, এখন যে আমরা টক শো দেখি, তা শত বছর আগে জুল ভার্নই কল্পনা করে গেছেন।

আজ যা কল্পনা তা আগামীর বাস্তবতা, লেখক জুল ভার্নের কল্পনার অনেক কিছুই সে হিসেবে এখন বাস্তব। কল্পনা করতে থাকো, আগামীর পৃথিবী তোমার কল্পনাই বাস্তবে দেখবে।

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক অবলম্বনে