জীবনের শব্দগল্প

একাধিক অর্থ নেই এমন শব্দ খুবই বিরল। তবে একটা শব্দের একাধিক অর্থ সব সময় যে একসঙ্গেই বিদ্যমান থাকবে, এমন নয়। কালে কালে শব্দের যে অর্থটি প্রধান হয়ে ওঠে, সেইটা বাদে বাকি সব অর্থ ঠাঁই পায় অভিধানের পাতায়। অভিধান থেকে খুঁজে আনা সেই রকম কিছু শব্দ নিয়ে এবারের গল্প। এর মধ্যে তিনটি শব্দ তাঁতের।

টানাপড়েন

সংসারে টানাপড়েন থাকে। জীবন চলে টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে। জীবন ও সংসারের নানা রকম সংকট এক কথায় বোঝানোর জন্য টানাপড়েন শব্দটার জুড়ি নেই।

টানাপড়েন শব্দটির উৎস হলো কাপড় বোনার তাঁত। তাঁতের ফ্রেমে বাঁধা দৈর্ঘ্যের সুতোকে বলে টানা। আর প্রস্থের সুতোকে বলে পড়েন। পড়েনের সুতো প্রথমে মাকুতে জড়ানো থাকে। বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁতির হাতের দ্রুত টানে টানার মধ্য দিয়ে মাকু বারবার এদিক-ওদিক ঘুরলেই কাপড় বোনার কাজটি সম্পন্ন হয়।

কাজটি সহজ নয়। টানার সুতোর মধ্যে সুতো জড়ানো মাকু একঘেয়ে গতিতে খটখট শব্দে এদিক-ওদিক করে। পৌনঃপুনিক এই ব্যাপারটা একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকরও। তবু জীবনের তাগিদে তাঁতিকে কাজটা করে যেতে হয়।

তাঁতে কাপড় বোনার কাজের পৌনঃপুনিকতাই এখন সংসার ও জীবনের বিশেষ অবস্থা বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। মানুষ বলে, টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে দিন চলছে। টানাপড়েন কথাটার অর্থ একঘেয়ে ক্লান্তিকর কোনো কিছুর মধ্যে ঝুলে থাকা।

ফ্যাকড়া

অঞ্চলভেদে ফ্যাকড়া শব্দটির নানা রূপ রয়েছে, যেমন ফেকড়া, ফ্যাঁকড়া ইত্যাদি। কাজের মধ্যে, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মধ্যে ফ্যাকড়া লাগে, ফ্যাকড়া বাধানোর অপচেষ্টা চলে, ফ্যাকড়া তোলা হয়। ফ্যাকড়ার সঙ্গে নানা রকম ক্রিয়াপদ যুক্ত হয়।

ফ্যাকড়ার সঙ্গে যে ঝামেলা বা ঝঞ্ঝাট তার মাত্রা কিন্তু খুব বেশি নয়। ফ্যাকড়া খুব সহজেই ঝেড়ে ফেলা যায়।

ফ্যাকড়া শব্দটা এসেছে গাছ থেকে। গাছের উপশাখা বা ছোট ডাল হলো ফ্যাকড়া। ফ্যাকড়া ছেঁটে না দিলে গাছ লম্বা হয় না। তেমনি ফ্যাকড়া ঝেড়ে ফেলতে না পারলে কোনো কাজ করা যায় না। আর এভাবেই গাছের ফ্যাকড়া মুখের কথায় চলে এসেছে।

কাকতালীয়

কাকতালীয় শব্দটি বিশেষণ এবং শব্দটির প্রয়োগও হয় কেবল বিশেষণ হিসেবেই। কার্যকারণহীন দুটি ঘটনা অথবা আকস্মিক যোগাযোগের কারণে সৃষ্ট কোনো ঘটনা বোঝাতে কাকতালীয় শব্দটি ব্যবহার করা হয়। শব্দটি তৈরি হয়েছে কাক ও তাল পড়ার ঘটনা নিয়ে।

তালগাছে তাল পেকেছে। একটা কাক তালগাছের পাশ দিয়ে যেই উড়ে গেল, অমনি পাকা তাল কাঁদিচ্যুত হয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ল। লোকে ভাবল, উড়ে যাওয়া কাকের ডানার হাওয়া লেগে তালটা বুঝি পড়ে গেল। কিন্তু বাস্তবিক ঘটনা তা নয়। কাকের মতো লঘুদেহ একটা পাখির পক্ষে তালের মতো ভারী একটা ফলকে ডানার হাওয়া লাগিয়ে বৃন্তচ্যুত করা অসম্ভব। তাল পাকলে এমনিতেই তা পড়ে যায়। এভাবে প্রকৃত কারণ না হলেও কোনো বিষয়কে কোনো কাজের কারণ বলে মনে করাকে কাকতালীয় বলা হয়।

ছিনিমিনি

ছিনিমিনি ছোটদের একটা চমৎকার খেলা। বড়রাও ছিনিমিনি খেলেন। তবে তাঁরা ছিনিমিনি খেলেন কখনো টাকাপয়সা নিয়ে, কখনো জীবন নিয়ে। ছোটদের ছিনিমিনি খেলার সঙ্গে বড়দের ছিনিমিনি খেলার কোনো মিল নেই।

ছিনিমিনি হলো শান্ত জলাশয় বা পুকুরের ছোট ছেলেমেয়েদের একধরনের জলখেলা। এই খেলায় খোলামকুচি বা মাটির হাঁড়িপাতিলের ভাঙা টুকরো কিংবা চ্যাপ্টা ঢিল পানিতে এমনভাবে ছোড়া হয় যে, তাতে তা ক্রমান্বয়ে একবার পানি ছুঁয়ে আর একবার শূন্যে ভেসে ছুটতে থাকে। খেলাটা পৃথিবীর অনেক দেশেই আছে।

ছোটরা সাইজমতো খোলামকুচি না পেয়ে অনেক সময় ভালো হাঁড়িপাতিল টুকরো করে তা দিয়ে পানিতে ছিনিমিনি খেলে। আর খেলার জন্য মূল্যবান কিছু নষ্ট করার ব্যাপারটা ছোটদের হাত থেকে বড়দের মুখের ভাষায় উঠে এসেছে।

ওতোপ্রোতো

ওতোপ্রোতো ও টানাপড়েন একই ব্যাপার কিন্তু অর্থ আলাদা। কাপড়ের টানার সুতো সংস্কৃতে হলো ওতো আর পোড়েনের সুতো সংস্কৃতে প্রোতো। ওতো আর প্রোতো মিলে ওতোপ্রোতো। ওতোপ্রোতো শব্দের অর্থের মধ্যে ক্লান্তিকর কিছু নেই। ওতোপ্রোতো শব্দের অর্থ হলো পরস্পর গভীরভাবে জড়িত বা পরিব্যাপ্ত।

তবে ওতোপ্রোতো শব্দের মূল অর্থ হলো টানা ও পোড়েনের সুতোর মধ্যে যা পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে অর্থাৎ একটা নকশা, যা ওতো ও প্রোতোর সুতোর সঙ্গে গ্রথিত হয়ে ফুটে রয়েছে।

খেই

কেউ কেউ কথা বলতে গিয়ে খেই হারায়। অন্যদিকে তাঁতি খেই হারায় কাপড় বুনতে গিয়ে।

খেই শব্দের অর্থ হলো সুতোর মুখ বা প্রান্ত। কাপড় বোনার সময় কখনো কখনো টানা কিংবা পোড়েনের সুতো কেটে যায়। খেই জোড়া দিয়ে তাঁতি আবার তাঁত চালানো শুরু করেন। খেই হারিয়ে গেলে তাঁতিকে ঝামেলায় পড়তে হয়। খেই জোড়া দিতে সময় লাগে।

সুতোর খেই তাঁত থেকে উঠে এসেছে আমাদের মুখের কথায়। খেই হারানো বলতে আমরা বুঝি প্রসঙ্গ হারিয়ে যাওয়া। খেই পাওয়া বলতে বুঝি প্রসঙ্গ খুঁজে পাওয়া।