প্রথমেই স্বীকার করে নিচ্ছি যে ফল ভালো হওয়াটা খুবই ভালো। জিপিএ-৫ পাওয়া ভালো, সব বিষয়ে জিপিএ-৫ পাওয়া আরও ভালো। কারণ, সবাই জানে, ফল ভালো হলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া যায়। ভবিষ্যতেও অনেক জায়গায় ভালো করা যায়। কিন্তু ফল ভালো না হলে জিপিএ-৫ না পেলে যে সব খারাপ হয়ে যায় তা কিন্তু নয়। মোটেও নয়। এ জন্য ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা যে বন্ধ হয়ে যায়, ভবিষ্যৎ অন্ধকার হয়ে যায়, মোটেও তা নয়।
যেসব পরীক্ষার্থী বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার কথা ভাবছ, তোমাদের জন্য জিপিএ-৫ না পাওয়াটা কোনো সমস্যাই সৃষ্টি করবে না। এই ব্যাপারটা একটু পরে আমি ব্যাখ্যা করব। তার আগে বলি, উচ্চশিক্ষার ভিত্তি কিন্তু জিপিএ-৫ নয়। এই ভিত্তি আসলে জ্ঞান, যা তোমরা এইচএসসি পর্যায় পর্যন্ত অর্জন করেছ। এ ক্ষেত্রে গণিত ও ভাষাগত বিষয় খুবই জরুরি। জ্ঞানের ব্যাপারটা শুনে ঘাবড়ে যেয়ো না। এ জ্ঞান হচ্ছে সচেতনভাবে চিন্তাভাবনা করে ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে তোমরা যা শিখেছ, তারই একটা যোগফল। যারা বই বা নোট মুখস্থ করে জিপিএ-৫ পেয়েছে আর যারা নিজেদের মতো করে শিখে, সচেতনভাবে চিন্তাভাবনা করে একটা বিষয় আত্মস্থ করেও হয়তো জিপিএ-৫ পায়নি, তাদের মধ্যে একটা বড় ধরনের পার্থক্য রয়ে যায়। এই পার্থক্যটা সক্ষমতার। মুখস্থ করে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীটি বেশিদূর যেতে পারবে না। কারণ, মুখস্থবিদ্যা তাকে পুরোটা পথ পার করাতে পারবে না। অথচ অন্য শিক্ষার্থীটি অনেক দূর যাওয়ার যোগ্যতা রাখে।
কিছু বাস্তব উদাহরণ দিই। আমার এক বন্ধু ছিল, এইচএসসিতে দ্বিতীয় শ্রেণি পেয়ে পাস করেছিল। সে এখন যুক্তরাষ্ট্রে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী অধ্যাপক। আমার এক প্রতিবেশী ছেলে, আমার দুই বছর পর এইচএসসিতে প্রায় লাড্ডু পেয়ে কোনোরকমে পাস করেছিল, সে সুইজারল্যান্ডের সার্ন ল্যাবরেটরিতে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করে এখন জার্মানিতে এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীরই ইংরেজিতে ভালো দক্ষতা নেই। একটি টিউটোরিয়াল ক্লাসে সবচেয়ে ভালো তিন শিক্ষার্থীর তিনজনই জিপিএ-৫ পায়নি।
লাড্ডুমার্কা ছেলে বিজ্ঞানী হয় কী করে? জিপিএ-৫ না পাওয়া ছেলেমেয়ে ইংরেজিতে এত ভালো হয় কী করে?
ব্যাপারটা সোজা। এইচএসসির ধাক্কাটা তাদের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে দিয়েছিল। আমার বন্ধু পড়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকাতে সুযোগ পায়নি। তার জেদ চেপে গিয়েছিল, সে ভালো করবে। ভালো কাজের জেদ চাপলে খারাপ করার কোনো উপায় থাকে না। একই বিষয় প্রতিবেশী ওই ছেলেটির ক্ষেত্রেও দেখেছি। আমার টিউটোরিয়ালে তিন ছেলেমেয়ে কঠোর পরিশ্রম করছে। তারা ইন্টারনেটের সুফলটা কাজে লাগাচ্ছে। গুগলে ঢুকে ইংরেজি শিখছে, ইউটিউবে গিয়ে ইংরেজিতে বক্তৃতা শুনছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ছে, লিখছে। আর এক-দেড় বছর পর তারা পাস করে বেরোবে। পৃথিবীর যেকোনো দেশে পড়ার যোগ্যতা তাদের হয়ে গেছে।
আমি আবারও বলছি, জিপিএ-৫ পাওয়া ভালো। কিন্তু না পাওয়াটাও খারাপ না। কারণ, যারা বিদেশে পড়তে যাবে, তাদের কেউ একবার জিজ্ঞেসও করবে না, এসএসসি-এইচএসসিতে ফল কী ছিল।
আমি এ দুই পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পেয়েছিলাম। লেটার মার্কসও ছিল কয়েক বিষয়ে। বিদেশে যখন যাই, ঘটা করে সার্টিফিকেটগুলো মনে করে নিয়ে যাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এক দিনও কেউ এ দুই পরীক্ষা নিয়ে কিছু জানতে চায়নি আমার কাছে।
বিদেশে পড়তে গেলে কিছু পরীক্ষায় ভালো নম্বর পেতে হয়। এখনই যেতে হলে এসএটি আর স্নাতক পাস করে গেলে জিআরই, জি ম্যাট ইত্যাদি পরীক্ষা দিতে হয়। টোয়েফল বা আইইএলটিএস লাগে ইংরেজিতে যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। এগুলোতে যদি প্রথম ৩ থেকে ৫ শতাংশের মধ্যে থাকা যায়, তাহলে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পড়া বা বৃত্তি পাওয়া যায়। আর যারা দেশে থাকবে, পড়াবে, অন্য চাকরি করবে, তাদের জন্য স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল গুরুত্বপূর্ণ।
আমি আবারও বলি, যারা জিপিএ-৫ পাওনি, একটুও বিচলিত হবে না; হতাশ হওয়া বা মুষড়ে পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। তোমরা বরং আমার বন্ধুর মতো পণ করো, আগামী পরীক্ষাগুলোয় দেখিয়ে দেবে। মন দিয়ে পড়া মুখস্থ করে নয়, বরং ভাবনাচিন্তা করে। আর আমার টিউটোরিয়াল ক্লাসের তিন শিক্ষার্থীর মতো ইংরেজিটা শিখে নাও, ভালোমতো রপ্ত করো। ব্যস, ভবিষ্যৎ তোমার হাতে ধরা দেবে।
আর যারা উত্তীর্ণ হতে পারোনি, ভেঙে পোড়ো না। আগামী পরীক্ষা পর্যন্ত যে সময়, কাজে লাগাও। কেন খারাপ হলো ফল, নিজেকে জিজ্ঞাসা করো। ঘাটতিগুলো খুঁজে বের করো। আর এখন থেকেই লেগে পড়ো। পারবে, তোমরা পারবে। এক শবার পারবে।
আরেকটা কথা মনে রেখো, একদিন যখন সফল মানুষ হবে (এখন থেকেই পথে নেমে পড়লে না হওয়ার কোনো কারণ নেই) পেছন ফিরে এইচএসসিতে প্রত্যাশামতো ফল না পাওয়াকে মনেই হয়তো পড়বে না তোমাদের। এক জীবনের ইতিহাসে এইচএসসির ফল বইয়ের একটা পরিচ্ছেদমাত্র, পুরো বই কোনোক্রমেই নয়।