পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়ে গেল ২৫ জুন, ২০২২। তাঁর আগে ২২ জুন সাংবাদিক সম্মেলন এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার স্মরণ করছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীসহ বিশেষজ্ঞদের অবদানের কথা! জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার ছিলেন বিশেষজ্ঞ প্যানেলের প্রধান। ২০২০ সালের ২৮ এপ্রিলে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। তারপর এই প্যানেলের প্রধান হন আমার আরেক শিক্ষক শামীম জেড বসুনিয়া। দেশি-বিদেশি অনেকেই ছিলেন এই প্যানেলে।
যমুনা সেতু প্রকল্পের সময়ও জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার কিংবা আইনুন নিশাত স্যার বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করেছেন। জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের মতোই পানিবিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী আইনুন নিশাত স্যারের নাম তোমরা শুনে থাকবে। যমুনা নদী শাসন কিংবা পদ্মা নদী শাসনের বেলায় কিংবা পরিবেশ-জীববৈচিত্র্য আর মানুষের জীবন-জীবিকা নিশ্চিত করার প্রকল্পগুলোয় আইনুন নিশাত স্যারের অবদান অনেক বেশি থাকে। আইনুন নিশাত স্যার দেশে-বিদেশে জলবায়ুর পরিবর্তন রোধে কাজ করেন, কাজ করেন পানি, নদী, জীব, পরিবেশ, মানুষ নিয়ে।
তোমরা জানো, জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারকে নিয়ে প্রথম আলোয় অনেকবার লিখেছি আমি, লিখেছি আইনুন নিশাত স্যারকে নিয়েও। লিখেছি, তার কারণ শুধু এটাই নয় যে আমি আমার শিক্ষকদের অনেক ভালোবাসা পেয়েছি, আমার লেখা বা বই প্রকাশিত হলে স্যাররা আমাকে ফোন করে উৎসাহ দিয়েছেন, পরামর্শও দিয়েছেন। বরং আমি এই শিক্ষক-প্রকৌশলীদের নিয়ে লিখি, কারণ তাঁদের জীবন থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।
জামিলুর রেজা চৌধুরী সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। আমেরিকার শিকাগোতে প্রখ্যাত প্রকৌশলী এফ আর খানের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু জামিল স্যার দেশে ফিরে আসেন দেশের জন্য কাজ করবেন বলে। তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান ছিলেন। এ দেশের আইটি খাত তাঁর কাছে ঋণী। বিশেষ করে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে কয়েক মাস উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করার সময় এই সব ক্ষেত্রে কাজ করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তিনি, আর এই কাজের দিগন্ত খুলে দিয়ে আসেন। আইনুন নিশাত স্যার এবং জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার এ দেশে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার ভিত্তি তৈরিতে যুক্ত ছিলেন। এখন কিন্তু ঘূর্ণিঝড়–সাইক্লোনে আগের মতো প্রাণহানি ঘটে না। জাতীয় ইমারত নির্মাণ বিধি বা ঢাকা শহরের বিশদ এলাকা পরিকল্পনার (ড্যাপ) সঙ্গে জামিল স্যার যুক্ত ছিলেন। তেমনিভাবে জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার গণিত অলিম্পিয়াড আর পরিবেশ আন্দোলনেও যুক্ত থাকেন। আমার এই দুই শিক্ষকই ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। জামিল স্যার পরে এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়েরও ভিসি হন।
বলছিলাম, এই দুই স্যারের ম্যাজিকটা কী যে তাঁরা জাতীয় পর্যায়ে অবদান রাখতে পারলেন? কেন আমার মতো ছাত্রেরা সকাল–বিকেল তাঁদের স্মরণ করে, সালাম জানায়?
জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার বা আইনুন নিশাত স্যার শুধু বিজ্ঞান বা প্রকৌশলবিদ্যার চর্চা করেননি। জামিল স্যার ছাত্রাবস্থায় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিলেন। প্রচুর বই পড়তেন। সিনেমা দেখতেন। শিক্ষক থাকার সময় চলচ্চিত্র ক্লাব করতেন তিনি। ছবি দেখতেন, দেখাতেন। কোনো ঘটনা ঘটলে তাঁর ব্যাখ্যা দিতেন উপন্যাস থেকে, সাহিত্য থেকে, চলচ্চিত্র থেকে। সমকালীন বাংলা সাহিত্য তাঁর প্রায় মুখস্থ ছিল। আর তাঁর স্মৃতিশক্তি তো ছিল অসাধারণ। তাঁর প্রত্যেক ছাত্রের নাম, ঠিকানা, পেশা তাঁর মুখস্থ থাকত। ছোট উদাহরণ দিই। আমার মতো নগণ্য ছাত্রের কয়জন ভাইবোন, তাঁরা কে কোথায় আছেন, এটাও তাঁর মুখস্থ ছিল। স্মরণশক্তি বাড়ানোর জন্য নিয়মিত সুডোকু মেলাতেন স্যার। প্রথম আলোয় ফোন করে সুডোকুর ভুল ধরিয়ে দিতেন। গাড়িতে চলার সময় সামনের গাড়ির নম্বরপ্লেট দেখে সংখ্যা নিয়ে মনে মনে খেলতেন। গান শুনতেন।
আমি যখন ইঞ্জিনিয়ারিং ছেড়ে সাহিত্য ও সাংবাদিকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিলাম, তখন জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যার ফোন করে আমাকে উৎসাহ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, ‘লেখালেখিতে থেকে যাও, প্রকৌশলীরা লেখালেখি করলে সবারই ভালো হবে।’ আমি এই গল্প অনেকবার বলেছি, বুয়েটের একটা গোলযোগের ব্যাখ্যা জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেছিলেন, ‘তুমি কি কুরোসোয়ার রসোমন ছবিটা দেখেছ? এতে একই ঘটনা বিভিন্নজন দেখে, বিভিন্নজনের বর্ণনা আলাদা হয়। এটাই গল্পটা।’ ভাগ্যিস আমার ছবিটা দেখা ছিল। আমি বলেছিলাম, হ্যাঁ।
স্যারের মৃত্যুর মাত্র কদিন আগে প্রথম আলোর জন্য তার কাছ থেকে ফোনে শুনে একটা লেখা তাঁর নামে তৈরি করেছিলাম। পরদিন তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে এসএমএস পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
জাতীয় জাদুঘরের আর্কাইভের জন্য তাঁর ভিডিও সাক্ষাৎকার আমি নিয়েছি। জাদুঘর কর্তৃপক্ষকে বলব, দুই দিন ধরে ধারণ করা এই সাক্ষাৎকার জনগণের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হোক। তাতে দেশের মানুষের জন্য শিক্ষণীয় অনেক কিছু থাকবে।
আইনুন নিশাত স্যারকে তোমাদের সামনে একদিন নিয়ে আসব। আমাদের ক্লাসে তিনি পড়াতেন গল্প করে করে। তোমরা যখনই কোনো একটা ইঞ্জিনিয়ারিং সমস্যা নিয়ে আইনুন নিশাত স্যারকে প্রশ্ন করবে, স্যার উত্তর দেবেন সাহিত্য থেকে। পদ্মা নদীর মাঝি থেকে। আরণ্যক থেকে। সত্যজিৎ রায় থেকে। আর আছে জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার গল্প। কাজের গল্প। ইতিহাসের গল্প। মোগল আমলে নদী কেমন ছিল, ব্রিটিশ আমলে নদী কেমন ছিল। স্যারের সঙ্গে দেখা হলে বলবেন, ‘তোমার গত লেখায় তুমি যে কৌতুক বলেছ, তার মতো আরেকটা কৌতুক আছে... বা বিভূতিভূষণের এই গল্পে বা রবীন্দ্রনাথের এই নাটকে প্রসঙ্গটা আছে।’
কাজেই ভালো প্রকৌশলী হতে গেলে সাহিত্য পড়তে হবে, বই পড়তে হবে, সিনেমা দেখতে হবে, মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে। ম্যাজিক এটাই। এ কথা কিন্তু পৃথিবীশ্রেষ্ঠ প্রকৌশলী বাংলাদেশের গর্ব এফ আর খান বলে গেছেন, ‘একজন প্রকৌশলীর আপন প্রযুক্তিতে হারিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তাঁকে অবশ্যই জীবনকে উপভোগ করতে পারতে হবে। আর জীবন হলো শিল্প, সংগীত, নাটক এবং সবচেয়ে বড় কথা জীবন হলো মানুষ।’