তুমি আজই তোমার বাবা-মাকে বলো তোমাকে নিয়ে বাইরে কোথাও যেতে। এমনকি রাতে বাইরেও খেতে নিয়ে যেতে বলতে পারো। বলো, প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও যেন এ কাজটি হয়। আজকাল দেশে কিন্তু ভালো ভালো অনেক রেস্তোরাঁ হয়েছে, বেড়ানোরও ভালো ভালো জায়গা আছে। বাবা-মা কিন্তু জানতে চাইতে পারেন কেন বাইরে নিয়ে যেতে হবে, কেনইবা খাওয়াতে হবে। তোমাকে একটু বুদ্ধি শিখিয়ে দিই। বলবে—তোমরা যদি বেশি বেশি বাইরে যাও, বাইরে বেশি বেশি খাও , তাহলে দেশের জাতীয় আয় আরও বাড়বে। তোমরা তো দেশকে ভালোবাসো তাই না? জাতীয় আয় বাড়ুক এটা তো চাইতেই পারো।
তুমি এখন আমাকে প্রশ্ন করতে পারো, জাতীয় আয় বিষয়টা কী আর রেস্তোরাঁয় খাওয়ার সঙ্গেই বা এর সম্পর্ক কী? সম্পর্ক তো অবশ্যই আছে। সম্পর্কটা হচ্ছে তোমরা যত বেশি বাইরে যাবে, যত বেশি টাকা খরচ করবে, যত বেশি টাকার লেনদেন হবে , জাতীয় আয় বাড়বে ততই। এবার জাতীয় আয় নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক। কথাটি কিন্তু এখন থেকে মাত্র ৮১ বছরের পুরোনো।
পৃথিবীর বয়স তো এত কম নয়। তাহলে এর আগে কি জাতীয় আয় ধারণাটি ছিল না? ছিল নিশ্চয়ই, তবে ধারণাটি খুব সুস্পষ্ট ছিল না। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ সায়মন কুজটেন এ ধারণার স্রষ্টা বলা যায়। ১৯৩০ সালের মহামন্দার পর অর্থনীতির নীতি নির্ধারণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে তাঁকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি ১৯৩৪ সালে প্রথম জাতীয় আয় পরিমাপের হিসাবের পদ্ধতি করেছিলেন। এ জন্য তিনি ১৯৭১ সালে অর্থনীতিতে নোবেল পান।
অনেকেই মনে করে , গত শতাব্দীতে অর্থনীতির সবচেয়ে বড় কাজের অন্যতম এটি। একটা অর্থনীতি কত দূর এগোল তা বুঝতে হবে জাতীয় আয় বৃদ্ধির হিসাব থেকেই। খুব সহজভাবে বলা যায়, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের নাগরিকেরা তাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ, শ্রম, মূলধনের সাহাযে্য যে পরিমাণ দ্রব্যসামগ্রী উৎপাদন ও বিভিন্ন প্রকার সেবা তৈরি করেন, তারই আর্থিক মূল্যকে জাতীয় আয় বলে। অধ্যাপক আলফ্রেড মার্শাল নামে খুব বড় একজন অর্থনীতিবিদ আছেন। তিনি এই জাতীয় আয়কে বলেছেন জাতীয় লভ্যাংশ। এই জাতীয় আয় থেকেই মূলত একটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ও জনগণের জীবনধারণের মান সম্বন্ধে একটি ধারণা পাওয়া যায়। এ থেকে অর্থনৈতিক পরিকল্পনাও সহজে নেওয়া সম্ভব হয়। কারণ , একটি দেশের নীতিনির্ধারকেরা তখন বুঝতে পারে দেশটি কোথায় এগিয়ে আছে, কোথায় পিছিয়ে গেছে।
জাতীয় আয়ের আলোচনায় আমরা তিনটি ধারণা পাই। একটি হচ্ছে মোট দেশজ বা অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট-জিডিপি), মোট জাতীয় উৎপাদন (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট-জিএনপি) এবং নিট জাতীয় উৎপাদন (নিট ন্যাশনাল প্রোডাক্ট-এনএনপি)। তিনটি ধারণার কথাই কিন্তু মনে রাখা দরকার। কারণ , তোমরা প্রায়ই এই কথাগুলো নানা ধরনের আলোচনায় পাবে। জিডিপি হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশে যে দ্রব্য ও সেবা পাওয়া যায় তার আর্থিক মূল্য। এখন ধরা যাক উৎপাদন করতে হলে যন্ত্রপাতি লাগে। মূলধনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে করতে এরও একধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়। এই ক্ষতিপূরণের জন্য অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়। তা না হলের পরের বছর উৎপাদন কমে যাবে। এই অর্থ ভোগ বা ওই বছরের উৎপাদনে ব্যবহার করা হয় না। একে বলা হয় অবচয়। এই অর্থ বাদ দিলে যা পাওয়া যাবে সেটাই নিট জাতীয় উৎপাদন বা এনএনপি। আর জিএনপি মূলত একটি দেশের নাগরিকদের উৎপাদন দ্রব্য ও সেবার মোট মূল্য। এ ক্ষেত্রে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্স বা প্রবাসী-আয়কে গণনার মধ্যে ধরব, কিন্তু বাদ যাবে আমদানি ব্যয়। প্রশ্ন হচ্ছে একটা দেশের মানুষ কোথায় কী কাজ করে সেই হিসাব কীভাবে রাখা সম্ভব? আমরা জানি , জাতীয় আয় পরিমাপের তিনটি পদ্ধতি আছে। যেমন, উৎপাদন পদ্ধতি, আয় পদ্ধতি ও ব্যয় পদ্ধতি। আবার চূড়ান্ত দ্রব্য প্রবাহ হিসাব এবং আয় বা ব্যয় প্রবাহ হিসাব পদ্ধতিতেও জাতীয় আয় পরিমাপ করা যায়। এ ছাড়া মূল্য সংযোজন পদ্ধতিতেও জাতীয় আয় পরিমাপ করা সম্ভব।
তোমরা জাতীয় আয় নিয়ে আলোচনার সময় আরও দুটি ধারণা হয়তো পাও। যেমন মাথাপিছু জাতীয় আয় এবং ক্রয়ক্ষমতার সমতা ভিত্তিতে মাথাপিছু আয় বা পিপিপি। এর মধ্যে মাথাপিছু আয় বের করা সম্ভবত সবচেয়ে সহজ। একটি দেশের মোট আয়কে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলেও পাওয়া যায় মাথাপিছু জাতীয় আয়। যেমন বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ১ হাজার ৩১৪ ডলার, যা টাকার অঙ্কে ১ লাখ ৩ হাজার ২৬ টাকা। পিপিপি বা পারচেজিং পাওয়ার প্যারিটি ধারণাটি আজকাল অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়। এর বাংলা হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা সমতা। মূলত বিভিন্ন দেশের মুদ্রার প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা পরিমাপের জনপ্রিয় সূচক এটি। ১৯১৮ সালে সুইডেনের অর্থনীতিবিদ গুস্তাফ কাসেল এই ধারণার জনক। ধরা যাক যুক্তরাষ্ট্রে বাজারে এক কেজি চালের মূল্য এক ডলার। এই এক ডলারে বাংলাদেশি মুদ্রায় পাওয়া যায় ৮০ টাকা। ৮০ টাকায় দুই কেজি চাল পাওয়া যায়। সুতরাং এখানে আমাদের টাকার ক্রয়ক্ষমতা কিন্তু বেশি। সুতরাং দেখা যায়, মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বাংলাদেশ হয়তো বিশ্বের দেশের তুলনায় অনেক পিছিয়ে, কিন্তু পিপিপিতে এগিয়ে। যেমন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবে পিপিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৩ হাজার ৩৯১ ডলার। মাথাপিছু আয় ও পিপিপি—সব দিক থেকেই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী দেশ এখন কাতার। এর পরেই আছে লুক্সেমবার্গ, সিঙ্গাপুর, ব্রুনেই দারুসসালাম ও কুয়েত। তবে এটা বলে রাখি , সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে সব মিলিয়ে সবচেয়ে বড় দেশ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এরপরেই আছে চীন।
একটা কথা বলে রাখি, মাথাপিছু আয় বেশি মানেই যে একটি দেশ খুব ভালো আছে তা কিন্তু নয়। ধরো, রহিম নামের একজনের আয় নয় হাজার টাকা। আর করিমের আয় এক হাজার টাকা। এর অর্থ দুজনের মাথাপিছু গড় আয় পাঁচ হাজার টাকা। তার মানে তো এই নয় যে দুজনেরই আয় সমান। সুতরাং এখানেই আয়বৈষম্যের বিষয়টি চলে আসে। সুতরাং এ আলোচনায় সবশেষে মনে রাখতে হবে জাতীয় আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়। উন্নয়ন আরও অনেক বড় বিষয়। সেই আলোচনাও আমরা পরে করব।
অলংকরণ: রাজীব