ভোরবেলা আমার ঘুম ভাঙল ফেসবুকের পরিচিত নোটিফিকেশনের আওয়াজে। চোখ খুলে মাথার কাছে রাখা আইপ্যাডে ফেসবুক খুলে দেখি আমার বন্ধু জাউয়াদ আলম, ইত্তেসাফ জামান, মোয়েজ উদ্দীনসহ আরও পঞ্চাশজন আমার একটি ছবিতে ‘লাইক’ দিয়েছে। ছবিটা ছিল জাংফ্রাউয়ের যা ‘দ্য টপ অব ইউরোপ’ বা ইউরোপের চূড়া নামে পরিচিত। আমরা গরমের দেশের মানুষ। ছোটবেলায় যখন রংপুরে থাকতাম তখন শীতের সময় কনকনে শীত পড়ত, কিন্তু সেই শীতে কখনো তুষার পড়তে দেখিনি। সাদা তুষারে ঢাকা জাংফ্রাউ আমার বন্ধুদের কেন, আমার জন্যও ছিল এক বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা। সুইজারল্যান্ডে যাওয়ার উত্সাহের একটা বড় কারণ ছিল এই তুষার দেখা। আমি ওখানে গিয়েও অপেক্ষা করছিলাম কখন পাহাড়ে উঠব, কখন তুষার দেখব।
গত জুনে আমরা উঠেছিলাম সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্নে। এত ছিমছাম একটা শহর যে মনেই হয় না এটি একটি দেশের রাজধানী। জুন ৬-এর সকাল। মায়ের কাছে জানতে চাইলাম আজ কোথায় ঘুরব। উত্তর পেলাম, জাংফ্রাউয়ে। আমার উত্সাহের শেষ নেই। আজ আমার জীবনের একটা বিশেষ দিন, আজ আমি বাস্তবে প্রথম তুষার দেখব। বার্ন থেকে ট্রেনে করে এক ঘণ্টা পর আমরা পৌঁছালাম জুরিখে। তারপর সেখান থেকে ইয়েগার যাওয়ার ট্রেনে উঠলাম। প্রায় ৩৫ মিনিট চলার পর জানালা দিয়ে দেখা গেল সাদা তুষারে ঢাকা আল্পস পর্বতমালা। আমরা ট্রেনের জানালা দিয়ে ছবি তুলতে লাগলাম। ট্রেন চলতে থাকল ছোট-বড় অনেক পাহাড়ের পাশ দিয়ে। কোনো কোনো পাহাড়ের সারা শরীরে শক্ত পাথর হাঁ হয়ে বেরিয়ে আছে। আমি বাবাকে একটা পাহাড় দেখিয়ে বললাম, বাবা দেখো পাহাড়টাকে পরিচিত লাগছে। ঠিক যেন বাবার ল্যাপটপের ওয়াল পেপার। পাহাড়গুলো ধীরে ধীরে বড় হতে থাকল। আমাদের চোখ জুড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশের দৃশ্য দেখে। তখনো তো জানি না আরও কত বিস্ময় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
ইয়েগার স্টেশনে ট্রেন থামলে আমরা নেমে পড়ি। আমি যখন ভেন্ডিং মেশিনে সুইস স্নিকার চকলেট কিনতে ব্যস্ত, মা তখন তিনটি টিকিট কিনে ফেললেন। টিকিটগুলো হলো বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের। এই বিশেষ ট্রেন পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য তৈরি। এমনকি ট্রেন লাইনটাও তৈরি বিশেষভাবে। টিকিট কাউন্টারে থাকা সুইস মেয়েটি মিষ্টি হেসে বলল, আজকের দিনটা রৌদ্রোজ্জ্বল। তোমরা জাংফ্রাউয়ের সৌন্দর্য দেখতে পাবে ভালোভাবেই। আবহাওয়ার পূর্বাভাসও ভালো। গত দুদিন বৃষ্টি হলেও আজ তার সম্ভাবনা নেই। আরও বলল, কেমন লাগল ফেরার পথে তা জানাতে। একটু পর ট্রেন এল। ট্রেনটা সিনেমায় দেখা পুরোনো দিনের ট্রেনের মতো। আমরা উঠে পড়লাম ট্রেনে। ধীরে ধীরে ট্রেনটা ওপরে উঠতে থাকল। ট্রেন লাইনের দুধারেই পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে হঠাৎ হঠাৎ সাদা তুষার জমে আছে। আর পাথরের গায়ে আলগা হয়ে যুক্ত গাছপালা।
ট্রেন গিয়ে থামল ছবির মতো গ্রিন্ডেলওয়ার্ল্ড নামের একটি ছোট্ট স্টেশনে। দেখে কিন্তু মনে হলো একটি ছিমছাম ছোট গ্রাম। এখানে এসে আবার ট্রেন পরিবর্তন করতে হবে। এবার ট্রেন উঠবে খাড়া পাহাড় বেয়ে। রেললাইনের মাঝ বরাবর দেখি খাঁজকাটা আরেকটি লাইন। সেই লাইনের সঙ্গে আমাদের ট্রেনের মাঝ বরাবর বিশেষ চাকা লাগানো। এই রেল পরিচিত ‘কগ হুইল’ হিসেবে। যার ফলে ট্রেনের ইঞ্জিনটা ওপরে ওঠার জন্য বেশি শক্তি অর্জন করে। এটাই আমাদের নিয়ে যাবে পর্বতশৃঙ্গে। স্টেশনে নেমে দেখি শ দুয়েক মানুষ অপেক্ষা করছে ট্রেনে ওঠার জন্য। আমরা প্রথম ট্রেনটিতে উঠতে পারলাম না। পরের ট্রেনের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি। আমাদের সামনে হাতছানি দিয়ে ডাকছে জাংফ্রাউয়ের চূড়া। পাহাড়ের গোড়ায় এখানে-সেখানে জমে আছে সাদা তুষার।
আমরা প্রায় ২৫ মিনিট অপেক্ষার পর ট্রেনে উঠলাম। এবারের ট্রেনটা কিন্তু আধুনিক। মাথার ওপরে মনিটর লাগানো। সেখানে জাংফ্রাউ-সংক্রান্ত নানা তথ্য দেওয়া হচ্ছে। জানলাম এই ট্রেন সার্ভিস পর্যটকদের জন্য প্রথম চালু হয়েছিল ১৯১২ সালে। ৯ কিলোমিটার রেললাইনের ৭ কিলোমিটার রয়েছে একটি টানেলের ভেতর। ৫০ মিনিটে ১ হাজার ৪০০ মিটার উচ্চতায় উঠতে পারে এই রেল। ট্রেন চলতে শুরু করলে দুজন নারী এগিয়ে এলেন ‘লিন্ডথ্’ কোম্পানির চকলেট নিয়ে। সব যাত্রীর কাছে পৌঁছে গেল সেই চকলেট। মুখে পুরতেই বিখ্যাত সুইস চকলেটের দারুণ স্বাদ। এদিকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি চারদিক পুরোই তুষারে ঢাকা। এবার কিন্তু ঠান্ডাও লাগছিল। আমাদের ট্রেন পাহাড়ের গায়ে গায়ে এগিয়ে চলেছে। বাইরে তাকালে একটু ভয়ও লাগছে। কোনো গোলমাল হলেই তো সবাইসহ পড়ে যাব পাহাড় থেকে!
ট্রেন এবার ঢুকল অন্ধকার টানেলে। কিছুক্ষণ পর থেমে গেল। বাইরে দেখা যায় একটি বড় জানালা। ট্রেনের দরজা খুলে গেল। ঘোষণা এল, যে-কেউ নামতে পারে পাহাড় থেকে নিচের দৃশ্য দেখতে। তবে এক মিনিটের মধ্যে ফিরতে হবে। অনেকেই নামল ছবি তুলতে। মিনিট পনেরো পরে আবার একটি জায়গায় ট্রেন থামল। এবার আমি নামলাম। সেই বড় জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি আমরা পাহাড়ের অনেক ওপরে। সেখান থেকে যেন পুরো সুইজারল্যান্ডই দেখা গেল। ট্রেন আবার চলা শুরু করল টানেলের ভেতর দিয়ে। তারপর তা থামল জাংফ্রাউ স্টেশনে—ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু স্টেশনে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩ হাজার ৪৫৪ মিটার। স্থানটা কিছুটা অন্ধকার। আমরা ট্রেন থেকে নেমে আলোর দিকে হাঁটতে থাকলাম। আলোর কাছে গিয়ে দেখি অনেকগুলো রেস্তোরাঁ। মার্কিন থেকে ভারতীয়—সব খাবারই আছে। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে দেখি সেই ‘লিন্ডথ্’ চকলেট কোম্পানির একটা ওয়ার্কশপ। সেখানে দেখানো হচ্ছে কী করে তৈরি হয় এই চকলেট। সেখান থেকে বের হয়ে আমরা আবার একটি টানেল ধরে হাঁটতে থাকলাম। হঠাৎ অনেক ঠান্ডা লাগতে শুরু করল। টানেলের শেষ মাথায় গিয়ে দেখি অনেক আলো। আরও এগিয়ে গিয়ে আমরা পেলাম খোলা আকাশ। ওপরে সূর্য। অনেক রোদ। এতটাই যে আমরা ভালোভাবে চোখ খুলে তাকাতেও পারছিলাম না। একটু ধাতস্থ হওয়ার পর দেখি আমরা তুষারের ওপর দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে শুধুই সাদা তুষার। আমি একবার তুষার হাতে ধরে দেখলাম। ডিপ ফ্রিজের গায়ে অনেক সময় যেমন তুলার মতো বরফ জমে থাকে, অনেকটা সে রকম। আমরা যেন এক সাদার রাজ্যে এসে পৌঁছালাম। শুধু পাহাড়ের মধ্যে কোথাও কোথাও কালো পাথর দেখা যাচ্ছে। সেই পাথর ঢেকে আছে ধবধবে তুষারে। পুরো জায়গাটা একটা উপত্যকার মতো। জানলাম এখানে কৃত্রিম মাঠ বানিয়ে নানা ধরনের খেলাধুলা হয়। ২০১৪ সালে টেনিস তারকা রজার ফেদেরার বরফের মাঝে এখানে প্রদর্শনী ম্যাচ খেলেছেন। বাস্কেটবল তারকা টনি পার্কার এখানে বাস্কেটবল খেলেছেন। এমনকি সুইজারল্যান্ডপ্রবাসী ভারতীয়রা ইংল্যান্ডের জাতীয় ক্রিকেট দলের সঙ্গে খেলেছেন ক্রিকেটও। সুইজারল্যান্ডের জাতীয় ফুটবল দল ফুটবলও খেলেছে এখানে। ভাবো একবার, তুষারের মাঝে খেলাধুলা!
একটু এগিয়ে দেখি বেশ কিছু লোকজন স্নো স্কেটিং করছে। কয়েকজনকে আবার ইয়া বড় বড় হ্যাভারসাক পিঠে নিয়ে হাইকিংয়ের প্রস্তুতি নিতে দেখা গেল। এবার ওপরে তাকিয়ে দেখি একটি তার বেয়ে লোকজন জিপলাইনিং করে নেমে আসছে। আমি ভাবলাম, জিপলাইনিং করতে হবে। এ রকম জায়গায় একটু রোমাঞ্চ না হলে হয়! বাবা-মা প্রথমে উচ্চতা দেখে না করল। পরে তাদের রাজি করিয়ে আমি মই বেয়ে প্রায় ৬ তলা উঁচুতে উঠলাম। ভয় যে হচ্ছিল না তা নয়। সেখানে একজন নারী ইন্সট্রাক্টর বললেন কী করতে হবে। আমি আংটার সঙ্গে থাকা ব্যাগের মতো থলেতে বসে পড়লাম। লাইনটা ঝুলে পড়েছে মাটিতে অনেক উঁচু থেকে নিচুতে। নামতে শুরু করলেই বুঝলাম বাতাসের বেগ অনেক বেশি। দ্রুত নামতে থাকার সময় আমার শরীরে ভয় আর আনন্দ দুই-ই ভর করল। আমি চোখ খুলে চারদিক দেখতে থাকলাম। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আমি নিচে নেমে এলাম। তাকিয়ে দেখি আছাড় খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। নিজেকে ঠিকভাবে সামলে নিলাম। তারপর ধপাস করে ল্যান্ডিং। অনেক দূর থেকে আমার বাবা-মা তাকিয়ে আছেন। আমি জিপলাইনিংয়ের জ্যাকেট খুলে উঠে দাঁড়ালাম। অনেকটা পথ হেঁটে ফিরতে হলো।
ফেরার পথে দেখা হলো বেশ কয়েকটি হাইকার দলের সঙ্গে। দলবেঁধে তারা পাহাড়ের চূড়ায় উঠছে। দূরে যারা আছে তাদের দেখতে ঠিক এক সারি কালো পিঁপড়ার মতো লাগছে। জিপলাইনিংয়ের অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সঙ্গে শেষ হলো আমার জাংফ্রাউ অভিযান। আবার সেই ‘কগ রেল’ ধরে আমরা ফিরে এলাম সমতলে। সঙ্গে নিয়ে এলাম ইউরোপের চূড়ায় রেলভ্রমণের অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা, যা কখনোই ভোলার নয়।